বিশেষ প্রতিনিধি : মাদকবিরোধী অভিযানে বন্দুকযুদ্ধের নামে শতাধিক ব্যক্তির নিহত হওয়ার ঘটনার ক্রিয়া-বিক্রিয়া বাংলাদেশের সীমানা ছাড়িয়ে গেছে। যুক্তরাজ্যের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য টেলিগ্রাফ মাদকবিরোধী অভিযানকে ‘একতরফা যুদ্ধ’ উল্লেখ করে বলেছে, রাজনৈতিক হত্যাকা-গুলোকে আড়াল করতেই ব্যবহৃত হচ্ছে এই অভিযান। প্রতিবেদনটির শিরোনামও ভয়াবহ : বাংলাদেশ ড্রাগস ওয়ার ইউজড টু হাইড পলিটিক্যাল অ্যাসাসিনেশনস। একে তুলনা করা হয়েছে ফিলিপাইনে চলমান মাদকবিরোধী যুদ্ধের সঙ্গে। বেশ কয়েকটি কিলিংয়ের ঘটনা উল্লেখ করে বলা হয়েছে, নির্বাচন সামনে রেখে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে দমন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকা-কে যৌক্তিক প্রমাণের উদ্দেশ্যেই চালানো হচ্ছে অভিযানটি।
টেকনাফে একরাম প্রথম হত্যা না হলেও এতে গুলির অডিও প্রকাশসহ কয়েকটি হত্যার ঘটনা বিশ্ব বিবেককেও নাড়া দিয়েছে। বিদেশি প্রভাবশালী কিছু গণমাধ্যমে চাঞ্চল্যকর কিছু প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে, যা বাংলাদেশের গণমাধ্যমের পক্ষে সম্ভব নয়। বিভিন্ন সূত্রের বরাতে টেলিগ্রাফ জানিয়েছে, বাংলাদেশে মাদকের লাভজনক কারবারে ওতপ্রোতভাবে জড়িত রাজনীতি এবং পুলিশের দুর্নীতি। এই অভিযান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিধন ও যারা সরকারের অনেক কিছু জানে তাদের চুপ করিয়ে দিতে বাহিনীগুলোকে সুযোগ করে দেবে। নির্বাচন যত ঘনিয়ে আসবে, এ যুদ্ধে কিংবা অন্যান্য অজুহাতে তত বেশি লোককে হত্যার শঙ্কা করা হয়েছে রিপোর্টটিতে। অন্যদিকে জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধবিষয়ক দফতর অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইমÑইউএনওডিসি বলেছে, তারা বাংলাদেশের পরিস্থিতির ওপর নজর রাখছে। ক্ষোভ জানিয়েছেন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট। তার ভাষায়, ‘এত সংখ্যক মানুষের মৃত্যুতে আমি উদ্বিগ্ন।’
জাতিসংঘের মানবাধিকার-বিষয়ক হাইকমিশনও খতিয়ে দেখছে পরিস্থিতি। সুইজারল্যান্ডের জেনেভা সফররত আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের কাছে এ বিষয়ে জানতে চেয়েছেন হাইকমিশনার জেইদ রা’দ আল হোসেইন। জবাবে তিনি বলেছেন, চলমান অভিযানটি সাময়িক। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আসামাত্র এ অভিযান শেষ করা হবে। কিন্তু সরকারের ভেতরের সিদ্ধান্ত এমন নয়। টেকনাফে একরামের ঘটনাটিতে বেশি নাড়া পড়ায় গত কদিন যুদ্ধ বা হত্যার ঘটনা কিছু কমলেও তুলে নিয়ে যাওয়া থামেনি।
এসব তুলে নেওয়া মানুষের কিছুসংখ্যককে আটক বা গ্রেফতার দেখিয়ে রেখে দেওয়া হচ্ছে। সময়মতো তাদেরও যুদ্ধে নিহত দেখানো হয় কি না, সেই টেনশন থেকে মুক্ত নন স্বজনেরা। চলমান অভিযানটিতে মাদকাসক্ত নামে টার্গেট করা হয়েছে কয়েক হাজার মানুষকে। আর অভিযান মানেই বন্দুকযুদ্ধ। এর শিকার এরই মধ্যে এক শ ছাড়িয়ে গেছে। স্থানীয় মানবাধিকার সংগঠনগুলোর উদ্বেগকে আমলে নিতেই নারাজ সরকার। র্যাব-পুলিশ আত্মরক্ষার্থেই গুলি করছে, সরকারের এমন দাবিকে শুধু হাস্যকর নয়, তামাশা বলে ক্ষোভ তাদের। তুলে নিয়ে হত্যা করা হচ্ছে, নিহত ব্যক্তিদের স্বজনদের দাবি সরাসরি নাকচ করে দিচ্ছে সংশ্লিষ্টরা। উপরন্তু তাদেরও একই পরিণতির হুমকি দিয়ে স্তব্ধ করে দেওয়া হচ্ছে।
এ বন্দুক অভিযানের পূর্বাপরে বিশ্বের দেশে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার হার বেড়ে গেছে। হত্যা-ত্রাসের রাষ্ট্রযন্ত্রের হাত থেকে বাঁচতে এই আশ্রয়ভিক্ষা। জাতিসংঘের হিসাবে গত পাঁচ বছরে বাংলাদেশে রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছে দেড় লাখের মতো বাংলাদেশি। অর্থাৎ প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৮০ জন। সম্প্রতি এ হার আরো বেড়ে গেছে। সংখ্যায় অগুনতি। তাদের আরজির ভাষা ও বর্ণনা প্রায় একই রকমের। হত্যার শঙ্কা, একাধিক মিথ্যা মামলা, বাড়িতে নিরাপদে থাকতে না পারার পরিপ্রেক্ষিতে নানা দেশ-মহাদেশ, নদী-সাগর পেরিয়ে বিভিন্ন দালালের মাধ্যমে বিদেশে এসে প্রাণে বাঁচতে আশ্রয় ভিক্ষা করে তারা। আশ্রয়ের আবেদনে দেশের বিরুদ্ধে আনা হয় বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ। আবেদনে দেশকে তুলনা করা হচ্ছে জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ, বিস্তীর্ণ শ্মশান, রক্তস্নাত কসাইখানার সঙ্গে। রিমান্ডে কুৎসিত-বিকৃত নানা নিপীড়নের বর্ণনার মধ্যে থাকছে হাজার ওয়াট আলো চোখে ফেলে পিটুনি, নখের মধ্যে সুচ ঢোকানো, কখনো কখনো নখও উপড়ে ফেলা, শরীরে ইলেকট্রিক শক, নাক দিয়ে রক্ত বের না হওয়া পর্যন্ত পা বেঁধে উল্টো ঝুলিয়ে রাখা।
মাথার খুলির সঙ্গে রিভলবার ঠেকিয়ে গুলির তথ্য-প্রমাণও বাদ নেই। দেশে চলমান বন্দুকযুদ্ধ নগদ প্রমাণ হিসেবে আশ্রয়প্রার্থীদের বেশ সুবিধা করে দিয়েছে। এমনিতেই গত বছর কয়েক ভিন দেশে বাড়ছে বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়প্রার্থীর সংখ্যা। বৈধ-অবৈধ যেভাবেই হোক বিদেশে গিয়ে মানবিক কারণ দেখিয়ে আশ্রয় প্রার্থনা করছেন তারা। বেশির ভাগ দেশে নির্বাচিত গণতান্ত্রিক সরকার থাকায় আদালতে নিষ্পত্তি বা সিদ্ধান্ত হওয়ার আগে কোনো বাংলাদেশিকেই সরাসরি বহিষ্কার করা হচ্ছে না। ইরাক, সোমালিয়া, সিরিয়ার মতো দেশগুলোর সঙ্গে আশ্রয়প্রার্থী তালিকার ওপরের দিকে বাংলাদেশের অবস্থান।
সংখ্যাগতভাবে তা বেশি ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন-ইইউভুক্ত দেশগুলোতে। এসব দেশে শুধু ২০১৬ সালেই ১৭ হাজার ২৫০ জন বাংলাদেশি রাজনৈতিক আশ্রয়ের আবেদন করেছেন। ২০১৭-১৮ সালের হিসাব এখনো অপ্রকাশিত। এর আগে ২০১২ সাল থেকে আবেদন করেছেন ৬৪ হাজার ২১৫ জন। ইইউর পরিসংখ্যানভিত্তিক অধিদপ্তর ইউরোস্ট্যাটের তথ্য অনুযায়ী, ইউরোপে ঢোকা বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের মধ্যে ১৭তম অবস্থানে বাংলাদেশ। আর যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও কানাডার মতো দেশগুলোতেও বাংলাদেশিদের সংখ্যা বাড়ছেই। দক্ষিণ আফ্রিকার মতো দেশও বাদ যাচ্ছে না। বৈধ উপায়ে যাওয়ার ব্যবস্থা না থাকায় দক্ষিণ আফ্রিকায় অবৈধভাবে ঢুকেছে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশি। সেখানে তুলনামূলক কম সময়ে রাজনৈতিক আশ্রয় মিলছে। দেশটিতে গত পাঁচ বছরে রাজনৈতিক আশ্রয়ভিক্ষা চেয়ে আবেদন করেছেন ২৬ হাজারের বেশি বাংলাদেশি।
বিশ্বের দেশে দেশে বাংলাদেশিদের এভাবে রাজনৈতিক আশ্রয়ভিক্ষার সংবাদে বিরক্ত ঢাকা। কারণ রাজনৈতিক আশ্রয়ের জন্য আবেদন-সংক্রান্ত খবর এবং তথ্য-পরিসংখ্যান অত্যন্ত আশঙ্কাজনক। আবেদনকারীদের অনেকে তথ্য-প্রমাণসহ নিপীড়নের ভয়ানক বিবরণ দিচ্ছেন। তাদের বেশির ভাগই বিএনপি ও জামায়াতের নেতা-কর্মী। আবেদনকারীদের বর্ণিত বিষয়ে কোনো কোনো দেশের পক্ষ থেকে নানা পন্থায় খোঁজ ও অনুসন্ধান চালানো হচ্ছে। বেশ প্রমাণও পাচ্ছে তারা। এর ফলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে দেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুন্ন হচ্ছে। সরকারের জন্য এটি ভীষণ বিরক্তিকর। দেশের সুনাম নষ্ট করতেই কিছু মানুষ বিদেশে রাজনৈতিক আশ্রয় চাচ্ছে বলে মনে করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। শনাক্ত করে তাদের দেশে ফিরিয়ে আনতেও চায় মন্ত্রণালয়। কিন্তু পেরে উঠছে না আইনি সীমাবদ্ধতার কারণে।