ঠিকানা রিপোর্ট : গত ২০ নভেম্বর যুক্তরাষ্ট্রর পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীন ইনটারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডম বিভাগ (আইআরএফ)-এর অনুমোদন ক্রমে বাংলাদেশে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ‘বাংলাদেশে ক্রমবর্ধমান সংখ্যালঘু নির্যাতন : সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দেশ ও সভ্য দুনিয়ার জন্য এর পরিণাম’ শিরোনামে একটি ভার্চুয়াল কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। সংগঠনের অন্যতম সভাপতি অধ্যাপক নবেন্দু দত্তের সভাপতিত্বে এবং ডক্টর দ্বিজেন ভট্টাচার্যের পরিচালনায় সকাল ১০টা থেকে দুপুর ১২টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত আড়াই ঘণ্টাব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভার উদ্বোধন করেন যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া বিভাগের অধীন নেপাল, শ্রীলঙ্কা, মালদ্বীপ, ভুটান ও বাংলাদেশে ইউনিটের প্রধান অমিত মাথুর। অমিত মাথুরের পরপরই সভায় বক্তব্য রাখেন ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশন্যাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের সিনিয়র পলিসি অ্যানালিস্ট নায়ালা মুহাম্মদ। নায়ালা মুহাম্মদের বক্তব্য প্রদানের পরপরই শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন- কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদের অন্যতম সভাপতি নির্মল রোজারিও। এই সভায় যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মোট তিনজন কর্মকর্তা এবং ইউএস কমিশন অন ইন্টারন্যাশনাল রিলিজিয়াস ফ্রিডমের একজন ছাড়াও সংযুক্ত ছিলেন ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের একাধিক কর্মকর্তা।
বাংলাদেশে, ভারত, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, নিউজিল্যান্ড, ইংল্যান্ড, হলান্ড, বেলজিয়াম, ফ্রান্স, সুইডেন, ইতালি, জার্মানিসহ বিভিন্ন দেশের ঐক্য পরিষদ নেতৃবৃন্দ ও সদস্য, বিভিন্ন দেশের কয়েকটি মানবাধিকার সংস্থা ও এনজিও মিলে মোট ১৪৫ জন দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতিতে অনুষ্ঠিত এই কনফারেন্সে প্যানেলিস্ট বা নিবন্ধ উপস্থাপক ছিলেন ১০ জন। উপস্থাপকগণ হলেন- কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক ও ওয়ার ক্রাইম ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত, গণফোরামের কার্য নির্বাহী সভাপতি ও কেন্দ্রীয় ঐক্য পরিষদেরে প্রেসিডিয়াম সদস্য সুপ্রিম কোর্ট অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী, ড. রিচার্ড বেনিকন, সাংবাদিক সেলিম সামাদ, ড. কোনরাড এলস্ট, অ্যাডভোকেট রবীন্দ্র ঘোষ, ড. মোহিত রায়, রোজালিন কস্টা, যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের সিনিওর পলিসি ডিরেক্টর ও লেখক শিতাংশু গুহ এবং সাংবাদিক পুলক ঘটক।
সভায় প্যানালিস্টদের এক এক জন সংখ্যালঘু নির্যাতনের এক একটি বিশেষ দিকের বর্ণনা ও বিশ্লেষণের ওপর জোর দিয়ে তাঁদের নিবন্ধ উপস্থাপন করেন। তবে সবাই সংখ্যালঘু নির্যাতক হিসেবে ইসলামী জাতীয়তাবাদী, ইসলামী মৌলবাদী ও উগ্রপন্থী সন্ত্রাসীদের চিহ্নিত করেন এবং বলেন যে, নির্যাতনের লক্ষ্য হচ্ছে দেশকে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ও আদিবাসী শূন্য করে ফের পাকিস্তানের মতো একটি ধর্মীয় রাষ্ট্রে পরিণত করা, যা নির্যাতকরা নির্যাতন করার সময় সরাসরিই বলে থাকে।
উপস্থাপকগণ বলেন যে, যদিও সংখ্যালঘু নির্যাতকরা প্রধানত ইসলামী জাতীয়তাবাদী-মৌলবাদী উগ্রপন্থী, মাঝে মধ্যে তথাকথিত প্রগতিশীল দলের নেতা ও কর্মীরাও সম্পৃক্ত থাকেন। আর সরকারও প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে মদদদাতার ভূমিকা পালন করে। তারা বলেন, দেশ স্বাধীন হওয়ার অব্যবহিত পরই শত্রুসম্পত্তির বাতিল না করে, এমনকি ১৯৭৪ সালে হাইকোর্ট সেটাকে বাতিল করার পরও এই কালো আইনটিকে ব্যবহার করে সংখ্যালঘু, বিশেষত হিন্দুদের কাছ থেকে আড়াই মিলিয়ন একরেরও বেশি জমি অধিগ্রহণ করা; সংখ্যালঘু নির্যাতকদের বিচার করে শাস্তি দিতে সরকারে ব্যর্থতা বা অনীহা, এমন কি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কমিশন প্রদত্ত চিহ্নিত অপরাধীদেরও বিচারের আওতায় না আনা; পার্বত্য চট্টগ্রামে নিরাপত্তা বাহিনীর প্রত্যক্ষ সহায়তায় আদিবাসীদের ঘরবাড়িতে অগ্নিসংযোগ করে, গণধর্ষণ ও গণহত্যা করে তাদের উচ্ছেদ করে যেমন- লোগাং, নানিয়ার চর ও লংগদুতে দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, এসব সংখ্যালঘু নির্যাতন ও উৎখাতে সরকারই সম্পৃক্ততার উদাহরণ বলে তারা মত প্রকাশ করেন। কয়েকজন বক্তা বলেন যে, ২০১২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫০০০ মুসলমান কর্তৃক রামুর বৌদ্ধদের গণনির্যাতন দিয়ে শুরু করে এ পর্যন্ত বহুবার সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সদস্যদের ফেসবুক হ্যাক করে কিংবা তাদের নামে ফেসবুক খুলে তাতে ইসলাম ও নবীর বিরুদ্ধে আপত্তিকর মন্তব্য বা স্ট্যাটাস দিয়ে, সেটাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে সংখ্যালঘু গ্রামে শত সহস্র ধর্মীয় জাতীয়তাবাদী-মৌলবাদী-উগ্রপন্থীদের বিভৎস আক্রমণ সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রক্রিয়ায় ব্যবহৃত অস্ত্র সম্ভারে একটি নতুন মারণাস্ত্রের সংযোজন। কারণ এক দিকে সন্ত্রাসীরা এর ব্যবহার করে সংখ্যালঘুদের বাড়িঘর পুড়ে দিয়ে, তাদের নারীর সম্ভ্রমসহ সব কিছু লুটপাট করে নিয়ে ওদের ঘর ছাড়া, দেশ ছাড়া করছে। অন্য দিকে তথাকথিত প্রগতিশীল সরকার ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টকে ব্ল্যাসফেমি আইনের পরিবর্তে ব্যবহারপূর্বক অপরাধীদের গ্রেফতার করে বিচারের অওতায় এনে শাস্তি না দিয়ে বরং নিরপরাধ অত্যাচারিতদের গ্রেফতার করে জেলে পুরছে এবং ইদানীং দু’জনকে সাত বছর করে কারাদণ্ডও দিয়েছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে, সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে ইসলামী জাতীয়তাবাদী-মৌলবাদী-উগ্রপন্থী ও সরকারের যৌথ উদ্যোগে।
সভায় যুক্তরাষ্ট্র ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে বাংলাদেশে থেকে সংখ্যালঘু উৎখাত প্রক্রিয়ার বেশ কিছু সচিত্র দলিলপত্র প্রদর্শন করা হয়। যার মধ্যে ছিল সম্প্রতি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক কুশল চক্রবর্তীকে কানাডা থেকে রায়হান প্রেরিত ভিডিওতে দেশের সব হিন্দুকে ২০২৫ সালের মধ্যে নিশ্চিহ্ন করার জন্য ১০ হাজার ছেলে তাদের ‘আমিরের নির্দেশের অপেক্ষায়’ আছে বলে হুমকি, আগামী ২৫ বছরের মধ্যে দেশ হিন্দু শূন্য হবে বলে প্রফেসার বারাকাতের ভবিষ্যদ্বাণী সংবলিত মিডিয়া রিপোর্ট, লোগাং ম্যাসাকারের প্রতিক্রিয়ায় স্পিকার ন্যানিস পেলোসিসহ সতেরোজন ইউএস কগ্রেসম্যান কর্তৃক সাবেক প্রধানমনত্রী বেগম জিয়াকে লেখা চিঠি, একই রাতে একই স্থলে ২০০ হিন্দু মেয়েকে ধর্ষণ করার মিডিয়া রিপোর্ট, পাঠ্য বইয়ে অমুসলমানদেরকে পশুর সঙ্গে তুলনা করা, টেক্সট বই থেকে অমুসলমান লেখক ছাঁটাই এবং হিন্দুদের সম্পত্তি দখলে উৎসাহিত করা, সংখ্যালঘুদের ধর্ম ও তাদের সম্পর্কে জঘণ্য ভাষায় আপত্তিকর মন্তব্য করা। এসব তথ্য প্রদান করে ঐক্য পরিষদের পক্ষ থেকে শঙ্কা প্রকাশ করা হয় যে, দেশ সেই নব্বই দশকের শেষ দিকে এবং ২০০১-২০০৫-এ যে ভয়াবহ অবস্থায় পৌঁছেছিল, আবার সেদিকে ধাবমান।
এই ভার্চুয়াল সভায় প্যানালিস্টরা বাংলাদেশে চলমান সংখ্যালঘু নির্যাতনের যে দুটি প্রধান কারণ চিহ্নিত করেন সেগুলো হলো ১৯৭২ সালের সংবিধানকে পরিবর্তন করে তাতে রাষ্ট্রধর্ম সংযুক্ত করা, আর সংখ্যালঘু নির্যাতকদের বিচার ও শাস্তির ব্যবস্থা না করে সরকার কর্তৃক প্রকারান্তরে তাদের সন্ত্রাসের মাধ্যমে দেশ থেকে সংখ্যালঘু বিতাড়নের লাইসেন্স প্রদান করা। তারা এই সমস্যার সমাধানকল্পে বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে নিম্নলিখিত পদক্ষেপগুলো গ্রহণের জন্য সুপারিশ করেন- ১. ডিজিটাল সিকিউরিটি আইনের অপব্যবহার করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের যেসব নিরপরাধে সদস্যদের জেলে নেয়া হয়েছে, তাদের অবিলম্বে মুক্তি দেয়া এবং যাদের ইতোমধ্যেই কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে, তাদের কেইসগুলো পুনঃতদন্তপূর্বক পুনর্বিবেচনা করা। ব্লাসফেমি আইনের মতো সংখ্যালঘুদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করার সংস্কৃতি বন্ধ করা। ২. ১৯৭২ সালের সংবিধান অবিলম্বে পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে দেশে প্রকৃত অর্থে ধর্মনিরপেক্ষ গণতন্ত্রে প্রত্যাবর্তন। ৩. একটি হেইট স্পিচ ও ক্রাইম আইন পাস করে ১৯৭২ সালের অক্টোবর মাস থেকে এ’ পর্যন্ত যত সংখ্যালঘু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে, সেগুলোর অপরাধীদের বিশেষ ট্রাইব্যুনালে বিচারপূর্বক শাস্তির বিধান করে, নির্যাতিতদের যথেষ্ট পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রদান করা। বিচারপতি সাহাবুদ্দীন কমিশন প্রদত্ত অপরাধী-তালিকা গেজেট হিসাবে প্রকাশ করে সেটা ধরে হেইট স্পিচ ও ক্রাইম আইনের প্রয়োগ করে এই প্রক্রিয়াটি শুরু করা। ৪. যেভাবে ইসলামী ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়েছিল ঠিক সেইভাবে হিন্দু, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক পৃথক ফাউন্ডেশন গঠন করা। ৫. সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংখ্যালঘু কমিশন এবং সংখ্যালঘু সুরক্ষা আইন প্রণয়ন করা। ৬. ১৯৯৭ সালের পার্বত্য শান্তি চুক্তির পূর্ণ বাস্তবায়ন করা। ৭. সংখ্যালঘুদের জাতীয় জীবনের সকল পর্যায়ে ক্ষমতায়ন করা এবং নিরাপত্তা বাহিনী, সেনা বাহিনীসহ সব মন্ত্রণালয়ে বিপুল হারে নিায়োগ প্রদান। ৮. অত্যাচারিত হয়ে/অত্যাচারের ভয়ে পূর্ব পুরুষের ভিটেমাটি ফেলে, প্রাণের ভয়ে দেশত্যগী সংখ্যালঘু যাদের ‘শত্রু’ ঘোষণা করে সম্পত্তি জবরদখল করে নেয়া হয়েছিল, তাদের উত্তরাধিকারীগণ বর্তমানে যে দেশেই বসবাস করুন না কেন, তাদেরকে তাদের সম্পত্তি বা এর ন্যায্যমূল্য ফেরত পাওয়ার বিধান করা। যেমনটি করেছে তুরস্ক বা জার্মানি- শত্রু সম্পত্তি বতিল আইন সংশোধনপূর্বক, অবিলম্বে বাস্তবায়ন করা।