দেশ আনন্দে নিউইয়র্ক

ইশতিয়াক রুপু :

দেশ থেকে বেশ কয়েকটি দিন শান্তিতে কাটিয়ে নিউইয়র্কে ফিরে আসার পর আজব বিষয় ঘটতে থাকে। প্রথমে দীর্ঘ বিমানযাত্রার প্রবল ঝক্কির ফলাফলে নিদ্রাচক্রের বেতাল অ্যাকশন। সারাক্ষণ ঝিমুনির মধ্যে কাটাতে হয় ইচ্ছার বিপরীতে। এত সবের পরও বাইরে বেরোতে হয় পারিবারিক নানা প্রয়োজন মেটাতে। ডাক্তার আর ফার্মেসি তো আছেই। সেখানে যাওয়া ফরজ। নিত্যদিনের বাজার সারতে গ্রোসারিতে গেলে মাছের ফ্রিজারে চোখ বোলানো স্বাভাবিক। এ ছাড়া মাংস বিক্রির এলাকায় দাঁড়াতে হয় কিছুক্ষণ। ফ্রিজারে সাজিয়ে রাখা মাংসের জাতের হেরফের থাকলেও দাম নিয়ে কোনো লুকোচুরি নেই। দেশের চিত্র ভিন্ন।

কসাইখানার সামনে ঝুলিয়ে রাখা মাংসের দাম হাঁকা হয় খরিদ্দারের লেবাস ও চেহারা দেখে। কর্তৃপক্ষের দাম হয়তো ৬০০-৭০০ টাকা কেজি, যা আপনাকে দেখামাত্র বলবে, সাব-স্পেশাল মাংস। এক হাজার টাকা কেজির কমে বিক্রি করলে পোষায় না। আপনি ততক্ষণে বলির পাঁঠা। মিষ্টি মিষ্টি কথা আর বড় ঘরের সাহেব, খানেওয়ালা পাবলিক বলে কসাই আপনার পকেটকে গড়ের মাঠ বানিয়ে দেবে নিমেষে। মাছে-ভাতে খাঁটি বাঙালি আমরা। মাছ ছাড়া আমাদের কীভাবে চলে বলুন? দোকানের মধ্যভাগে হাফ ডজন বড় আকারের ফ্রিজার-ভর্তি নানান জাতের দেশি ও আমেরিকান মাছ। সবগুলো প্যাকেটবন্দী ও ফ্রোজেন। দেখলেই মনে হয়ে প্যাকেট-ভর্তি প্লাস্টিকের ছোট-বড় পিস সুন্দর করে সাজিয়ে রাখা।

ফিরে আসি দেশের স্মৃতি স্মরণে। দেশে প্রতিদিন ঘুম ভাঙত ভোরে। ফজরের আজান শুনে। ছোট বোন মিলি ছিল তখন বাসায়। একদিন কথা প্রসঙ্গে আমাকে জিজ্ঞেস করে, নিউইয়র্কে তোমাকে এত শান্তিতে ঘুমাতে দেখিনি। সারা রাত বারবার বিছানা ছেড়ে সিটিং রুমে বসে ফোন হাতে নয়তো টিভি ছেড়ে বসে আছ। অস্থির অবস্থায় অথচ দেশে এসে নিজ বাসায় রাত ১০টা বাজতে না বাজতে আব্বার বিছানায় ঘুমিয়ে যাও ভোরের আজান শোনা পর্যন্ত, কোনো বিরতি ছাড়াই। ওর কথা শুনে আমিও ভাবতাম, এ কোন জাদু। অথবা কোন রহস্য কিংবা মায়া। বালিশে মাথা ছোঁয়ানো মাত্র মনে হতো, কোনো এক অদৃশ্য হাত মাথায় বুলিয়ে দিচ্ছে, স্নেহ আর মমতামাখা নিবিড় ছোঁয়া। টের পেয়েছি খুব নিকট ছিল প্রশান্তির অদৃশ্য অনুভব। তা শুধু এক বা দুদিন নয়, মাসখানেক নিজ বাসায় ছিলাম, প্রতিদিন বা রাতে সেই অনুভব টের পেয়েছি নিয়মিত। আপন বাসা ছেড়ে বাইরে থাকতে মন সায় দিত না। রাজধানী শহর ঢাকায় গেলেও কোনো এক অদৃশ্য টানে ফিরে আসতাম ওই দিন নিজ গৃহে। বাবার বিছানায় ঘুমানোর টান অনুভব করেছি প্রবলভাবে। সত্যি বলছি। এখানে বিজ্ঞান আর যুক্তি সব বিষয় হার মানবে শর্তছাড়া।

মফস্বল শহরের ভোরের চিত্র একেবারে আলাদা। ভোরের আলো ফোটে মনোরম রূপ নিয়ে। এর ওপর সারি সারি সবুজ বৃক্ষে পাখির সুমধুর ডাক। নিজেকে উতলা করে দেয়। নিয়ে যায় ভিন্ন এক ভালোবাসার প্রশান্তির রাজ্যে। চিত্রের বর্ণনা হয়তো করা যেতে পারে। তবে হৃদয়জুড়ে অনুভবের অজানা সংলাপ আর টুকরো স্মৃতি আঁকা সহজ নয়। উত্তর ভিটায় পাকা দালান আর দক্ষিণ ভিটায় সেমিপাকা, কাঠের ব্যাটনের ৬০-৬৫ বছরের পুরোনো বাংলো টাইপের ঘরের মধ্যের পাকা উঠোনে বসে সকালের চা ও টোস্ট বিস্কুট গ্রহণের স্বাদ অতুলনীয়।
ধীরে ধীরে শহর জেগে ওঠে। পূর্বের আকাশে সূর্য ওঠে। প্রাতর্ভ্রমণকারীদের দলে দলে হেঁটে চলা শুরু হয় শহরের পূর্ব প্রান্তের কলেজ রোড-সংলগ্ন প্রশস্ত রাস্তাজুড়ে। পাশাপাশি ধীরে ধীরে তৈরি হচ্ছি। শহরের উত্তর পাশ ধরে বয়ে যাওয়া সুরমা নদীর পাড়ে শত বছরের পুরোনো মাছ ও সবজির বাজারে যাব বলে। নিজ হাতে মাছ-সবজিসহ সব ধরনের বাজার করার শখ আজকালের নয়। ছোটবেলায় দেখে এসেছি, প্রতিদিন সকালে বাবার বাজারমুখী ছুটে যাওয়া। ৯টা ৩০ মিনিটে স্থানীয় বাজার অভিমুখে যাত্রা শুরু। বাসার সার্বক্ষণিক কেয়ারটেকার জন আর আমি দুজনে চেপে বসলাম রিকশায়।

কিশোর বয়সে প্রয়াত আব্বাকে দেখভাল করতে আসা জন পুরোদস্তুর এক যুবক। তাই এক রিকশায় বসতে গেলে দুজনের বেশ কষ্ট হয়। বিশেষ করে, বাজার শেষে ফেরত যাত্রায় একসঙ্গে বসা বেশ মুশকিল হয়ে পড়ে। সেই ছোটবেলা থেকে দেখা আসা নদীর ভাঙনকবলিত মাছবাজারের আকর্ষণীয় অংশ হলো নদীর পাড়। যেখানে পসরা সাজায় স্থানীয় স্থায়ী ও অস্থায়ী জেলেরা। যারা মাছ ধরে এলাকার হাওর, নদী, খাল-বিল থেকে। সেখানেই মেলে নানান জাতের টাটকা ছোট-বড় আর মাঝারি আকারের মাছ। আমার বেশি পছন্দ দেশি কালো রঙের ছোট-বড় টেংরা, রুপালি ঝিলিকের মধ্যম সাইজের চাপিলা এবং ফলি আর লালি পাবদা (গল্পকার হুমায়ূন স্যারের বিশেষ পছন্দ)। লালি পাবদা হলো মোটামুটি মাঝারি আকারের, তবে পেটের নিচে লালচে আভা থাকবেই। এবার যথেষ্ট টেংরা মাছ কিনেছি প্রায় প্রতিদিন। সঙ্গে বিভিন্ন জাত আর আকারের ডাঁটা সবজি। বাজারে ঢোকার মুখে পুরোনো জেলগেটের সামনের পুকুরপাড়ে কয়েক জাতের তাজা শাক আর ডাঁটা নিয়ে বসত শ্যামল নামের একটি ছেলে। বিচিত্র নামের তাজা শাকের চার-পাঁচ আঁটি আর তিন-চার আঁটি তাজা ডাঁটা ব্যাগে ঢুকিয়ে অপেক্ষা করত আমার। না নিয়ে পারতাম না। মিষ্টি করে হাসতে হাসতে বলত, সাব নেউকা! বেশেবা মজা লাগব। একেবারে তাজা।

মার্চ মাসের মাঝামাঝি একদিন সকালে কয়েক জাতের মাছ কিনে এসে দাঁড়িয়েছি সবজি বাজারে। হঠাৎ কানে এল ফোনের মেসেঞ্জারে রিং হচ্ছে। ফোন হাতে অবাক। সুদূর নিউইয়র্ক থেকে কল এসেছে। কল করেছেন নিউইয়র্ক নগরীর পরিচিত মুখ বারী হোম কেয়ারের কর্ণধার আসেফ বারী টুটুল ভাই। নিউইয়র্কে তখন রাতের শুরু। অনেক উৎসাহ নিয়ে জানতে চাইলেন কেমন আছি? আর বর্তমানে কোথায় আছি? বললাম কাঁচাবাজারে অবস্থান করছি। মাছ নিয়েছি। এখন টাটকা শাক ও সবজি নিচ্ছি। আগ্রহ দেখালেন সুরমাপাড়ের একসময়ের শান্ত মফস্বল শহরের মাছ ও সবজি বাজার দেখবেন। দুজনের ফোনের ক্যামেরা অন হলো। আমার ফোনের ক্যামেরায় থরে থরে সাজিয়ে রাখা ঘন সবুজের সতেজ পাতা নিয়ে নানা রকমের তাজা শাক আর সবুজ সাজে সজ্জিত করলা, সিম ও কচি লাউ আর কাঁচকলার সমারোহ। সাত সাগর তেরো নদীর অপর পাড়ের হাডসন নদীর তীরের একজন সফল অভিবাসী লং আইল্যান্ডে অত্যাধুনিক বাড়িতে বসে পথের পাশে অস্থায়ী বাজারের তাকে সাজানো অপরূপ সৌন্দর্য নিয়ে নিজেকে মেলে ধরে বাংলার কৃষকের ফলানো হরেক জাতের তাজা শাকসবজি ও আনাজ ডেকে বলেছে, এসো হে খোকা! সবুজের ভালোবাসায় বিমোহিত হয়ে হাজার মাইল দূরে থেকো না। বিমূর্ত আর মৌনতা অদূরে ছুড়ে ফেলে পাশে এসে বলো, হে সবুজ প্রকৃতি, তোমায় আজও আমি ভালোবাসি! বড্ড ভালোবাসি।

লেখক : ছড়াকার ও গীতিকার।