দৈন্য অভিশাপ নয় সাফল্যের সোপান

এস এম মোজাম্মল হক :

আশা বর্তমান অবস্থা থেকে ঈপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছার দৃঢ় পদক্ষেপের মানসিক অঙ্গীকার। আশা সর্বদা হতাশার বিপরীতে ইতিবাচক চিন্তা-চেতনার ধারক-বাহক, যা সব সময় সাফল্যের স্বপ্নে বিভোর করে তোলে। যার মধ্যে আশা নেই, সে প্রাণহীন জড় পদার্থতুল্য। আশা যেমন উন্নত জীবন ও স্বপ্নপূরণের পথে গতি সঞ্চার করে, তেমনি দুঃখ-দুর্দশা লাঘবে অন্তর্নিহিত ঘুমন্ত শক্তিকে জাগ্রত করে সাফল্যের পথে এগিয়ে নেয়। আশা এমনই এক শক্তি, যা দুর্বলকে সাহস জোগায়। শত প্রতিকূলতার মাঝেও আশা মানুষকে সুন্দর ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখায়। পৃথিবীর ঘটে যাওয়া সব বড় বড় বিজয়, দুর্বলের অত্যাচারীকে পরাজিত করার সাহস, মানুষের শূন্য হাতে শুরু করে বিশাল কিছু অর্জন-সবকিছুর পেছনেই আশার ভূমিকা অপরিসীম। আশা কথাটি সম্ভাবনার প্রতীক। আশা আছে বলেই জীবন থেকে নতুন প্রাণের সঞ্চার হয়। হতাশাগ্রস্ত জীবন মানুষকে তিলে তিলে শেষ করে দেয়। শত প্রতিকূলতার মধ্যে থেকেও আশা পরিত্যাগ না করে সামনের দিকে এগিয়ে চলাই সফলতার চাবিকাঠি। বিশ্বের অধিকাংশ খ্যাতনামা ব্যক্তিই প্রথম জীবনে কষ্ট-ক্লেশে কাটালেও আশা তাদের মনোবল দুর্বল করতে পারেনি। বরং প্রবল আশা ও মানসিক শক্তিবলে তা অতিক্রম করেই সফলতার স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছেন তারা। তাদের জীবনের অপ্রতিরোধ্য সফলতার উদাহরণ পরবর্তী প্রজন্মের কাছে অনুপ্রেরণার উৎস।

‘সংসার সাগরে দুঃখ তরঙ্গের খেলা আশা তার একমাত্র ভেলা’-জীবন-সংসার কখনো কুসুমাস্তীর্ণ নয়। সুখ-দুঃখের মিশেলেই জীবন। এককভাবে কারো জীবন কখনো পরম সুখে কাটে না। এই বাস্তবতা মেনে নিয়েই জীবন পরিচালনা করতে হয়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে ভীরু ব্যতীত সাময়িক দুঃখ-দুর্দশা দেখে কেউ ভয় পায় না বরং দুঃখের সাগর পাড়ি দিয়ে সাফল্যের তীরে নোঙর করতে পারাই প্রকৃত কর্মীর কাজ। উঁচু এবং সমৃদ্ধ অবস্থায় জীবনের শুরু হলে কোনো কারণে তা থেকে অবনতি ঘটলে সে অবস্থা মানিয়ে নেওয়া খুব কঠিন হয়ে পড়ে। পক্ষান্তরে সাধারণ অবস্থা থেকে ধীরে ধীরে উন্নতি লাভ হলে ধৈর্য, প্রশিক্ষণ ও জীবনে সব পর্যায়ে মানিয়ে চলার যে বাস্তব অভিজ্ঞতা সঞ্চার হয়, জীবনকে এগিয়ে নিতে এবং সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের সাথে নিড়ির সম্পর্ক বজায় রাখতে পারা অতি সহজ হয়। হয়তো সে কারণেই সৃষ্টিজগতের সেবার জন্য উপরওয়ালা যাদের নির্বাচিত করেন, ধাপে ধাপে তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে যোগ্য করে তোলেন। তবে এ ক্ষেত্রে একটি বিষয় লক্ষণীয়, এসব যোগ্য লোকেরা জীবনের শুরুতে দারিদ্র্যের মধ্যে কাটালেও ছোটকাল থেকেই তাদের নৈতিক চরিত্র থাকে অতি উন্নত, যা সফলতার পথে তাদের এগিয়ে নিতে এবং সাধারণ মানুষের নিকট তাদের গ্রহণযোগ্যতা তৈরিতে অসাধারণ ভূমিকা রাখে। তদুপরি জীবনে স্বাচ্ছন্দ্যে চলার জন্য অর্থের প্রয়োজন থাকলেও অর্থই জীবনে সফলতার জন্য একমাত্র উপাদান নয়। আর্থিক সচ্ছলতা হতে পারে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবন পরিচালনার একটি অনুষঙ্গ মাত্র। সাফল্য একটি ভিন্ন বিষয়, যা বহুমাত্রিক, যেমন শিক্ষা, গবেষণা, কর্ম, উদ্ভাবন এরূপ নানা বিষয়ে দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জনের ওপর নির্ভরশীল। সবচেয়ে বড় কথা, যিনি যে কর্মই বেছে নিয়েছেন, সেই কর্মের প্রতি নিষ্ঠাবান হলে সেই কর্মের মাধ্যমেই তিনি সফলতা অর্জন করতে পারেন। প্রয়োজন শুধু লক্ষ্য অর্জনে অবিচল নিষ্ঠা, আন্তরিকতা ও ন্যায়ানুগ কর্মপ্রচেষ্টা। বাকিটা সময় এবং ভাগ্যের ওপর ছেড়ে দিলে তারাই সফলতার শিখরে পৌঁছে দেবে। ইতিহাস থেকে যার শিক্ষা ও উদাহরণ অবলোকন করা যেতে পারে।

অর্থই সব অনর্থের মূল। জগতে অনর্থ সৃষ্টির বহুবিধ কারণ থাকলেও অর্থ বা স্বার্থের কারণেই বেশির ভাগ বিবাদ-বৈষম্য ও হানাহানির সৃষ্টি। ‘অনর্থের মূল’ বলতে অর্থই যে সব সময় অনর্থ ঘটায় তা নয়, বরং অর্থসংশ্লিষ্টতার কারণে লোভ-লালসা হেতু চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনায়াসে প্রভাবিত হতে পারে। ফলে অর্থের আয়-ব্যয়, সংরক্ষণ-বণ্টন ইত্যাদি পর্যায়ে সব সময় বিবেকবোধ ঠিক রেখে চলা যেমন অসম্ভব হয়ে পড়ে, তেমনি স্খলনজনিত অনেক জটিলতারও সম্মুখীন হতে হয়। মানুষের ব্যক্তিগত ও সামাজিক পর্যায়ে নানাবিধ অনাকাক্সিক্ষত সমস্যার কারণে বহু অঘটন সৃষ্টির শঙ্কা তৈরি হয়, সেটিই অর্থের কারণে অনর্থ সৃষ্টির মূলকথা। অর্থ ব্যতীত জীবনযাপনের চাহিদাসমূহের কিছুই মেটানো সম্ভব নয়। তাই জীবনধারণের জন্য অর্থের প্রয়োজন অপরিসীম। অর্থ উপার্জন নিজ পরিবার-পরিজনের স্বাভাবিক চাহিদা মেটানো ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের সুখ-সমৃদ্ধি ও বাড়তি সুখ-স্বাচ্ছন্দ্যের প্রয়োজনে এমনকি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সঞ্চয় ও অন্য ধনাঢ্য ব্যক্তিদের সাথে আর্থিক প্রতিযোগিতার কারণেও হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রয়োজনের স্বাভাবিক সীমা-পরিসীমা নির্দিষ্ট নয়, তবে বংশপরম্পরায় দারিদ্র্যসীমার ঊর্ধ্বে অবস্থানকারী পূর্বপুরুষদের আর্থিক অবস্থার সমপর্যায় বা তা থেকে কিছুটা উপরে অবস্থানের বিষয়টি স্বাভাবিক বিবেচনা করা যেতে পারে। তবে বৈধভাবে রোজগার করে প্রয়োজনের অতিরিক্ত সম্পদের মালিক হওয়াও দোষের কিছু নয়। দোষের তখনই, যখন অসম প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয়ে অনৈতিক উপায়ে সীমাহীন অর্থ-বৈভবের মালিকানা অর্জনের জন্য অবৈধ ও নিন্দনীয় উপায়ে অর্থসম্পদ কুক্ষিগত করার প্রয়াস পায়। এসব ক্ষেত্রে সেবা প্রদানকারী ব্যক্তিবর্গ যেহেতু সারাক্ষণ জনসাধারণের তীক্ষè পর্যবেক্ষণের আওতায় থাকেন, তাই এ ব্যাপারে তাদের ব্যক্তিগত সততা ও সচেতনতা অবলম্বন খুবই জরুরি। অন্যথায় সামান্য স্খলনের কারণে দীর্ঘদিনের সততার অনুশীলনে অর্জিত সুনাম মুহূর্তেই ধ্বংস হয়ে যেতে পারে, যা শুধু নিজের জীবনই ক্ষতিগ্রস্ত করবে না, পরবর্তী প্রজন্মও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। সুতরাং ন্যায়ভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বৈধ পথ অনুসরণ করা সবার উচিত।

লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক