দ্বাদশ নির্বাচনকে ঘিরে অজানা রহস্য

নূরুল ইসলাম : বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর থেকে গত ৫০ বছরে যারা সরকারপ্রধান হয়েছেন, তাদের মধ্যে কেউ ছিলেন রাষ্ট্রপতি, কেউ প্রধানমন্ত্রী, কেউ প্রধান উপদেষ্টা আবার কেউ সামরিক শাসন জারি করে সামরিক প্রশাসক হিসেবে দেশ শাসন করেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমে সংসদীয় পদ্ধতির সরকার করে রাষ্ট্রপতি থেকে প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন। আবার ১৯৭৫ সালে রাষ্ট্রপতিশাসিত সরকার পুনঃপ্রবর্তন করে রাষ্ট্রপতি হয়েছিলেন।
তবে একক দল হিসেবে সবচেয়ে বেশি সময় ধরে ক্ষমতায় আছে আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা সবচেয়ে বেশি সময় ধরে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে সরকারপ্রধানের দায়িত্ব পালন করছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের প্রধান রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বিএনপি ক্ষমতায় ছিল প্রায় ১৩ বছর। আর প্রয়াত হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ প্রথমে সামরিক আইন প্রশাসক ও পরে রাষ্ট্রপতি হিসেবে প্রায় ৯ বছর দেশ শাসন করেছেন। সরকারপ্রধান হওয়া এবং পদত্যাগের আগে নানা আলামত দেশের সুশীল সমাজ, রাষ্ট্রবিশ্লেষক, গোয়েন্দা সংস্থাসহ অনেকের কাছেই পাওয়া যেত। সেই পথ এখন দিনে দিনে রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে।
বিশেষ করে নানাভাবে বাংলাদেশ রাষ্ট্রে নেতৃত্ব দেওয়া ব্যক্তিত্ব তাজউদ্দীন আহমদ, শেখ মুজিবুর রহমান, মো. মনসুর আলী, খন্দকার মোশতাক আহমদ, আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েম, মওদুদ আহমেদ, জিয়াউর রহমান, কাজী জাফর আহমেদ, সাহাবুদ্দীন আহমদ, খালেদা জিয়া, মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, শেখ হাসিনা, ইয়াজউদ্দীন আহম্মেদ, ফখরুদ্দীন আহমদ- তাদের বিষয়ে চোখ রেখে গতিধারা বোঝা যেত। এবারই কেবল ব্যতিক্রম- তার কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে না।
সাধারণত প্রতিটি নির্বাচনের দু-এক বছর আগ থেকেই দৃশ্যপট ধারণা পাওয়া যেত, কী হবে কিংবা কী ঘটতে পারে। কিন্তু এবার দ্বাদশ নির্বাচনের আগে তার কোনো ধারণা পাওয়া যাচ্ছে না। এ নিয়ে এক অজানা রহস্য সৃষ্টি হয়েছে। দেশের প্রথম সারির নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট কেউ বুঝতেই পারছেন না এবার দ্বাদশ নির্বাচনে কী ঘটতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও আগাম কোনো তথ্য নেই।
শেখ হাসিনা চতুর্থবারের মতো নেতৃত্ব দিচ্ছেন; আবারও কি তিনি টিকে যাবেন, নাকি অতীতের কোনো ঘটনার জন্য সরে যাবেন, তা আগ থেকেই অনুমান করা যাচ্ছে না। শক্তভাবে মাঠ দখলে রেখে অতীতের মতো সরকারবিরোধী দলগুলোকে ঠান্ডা রেখে সরকার নিজেদের ঘরে রাখার চেষ্টা করছে। আবার বিএনপিসহ অনেক রাজনৈতিক দল আর শীতল হবে না বলে ঘোষণা দিয়ে রাজপথে শক্তভাবে অবস্থান নিচ্ছে। তবে ক্ষমতাসীনরা চাচ্ছে যেকোনো মূল্যে আবারও শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচন বাস্তবায়ন করতে। সেটি এবার করতে পারবেন কি না, তা এখনো নিশ্চিতভাবে বলা যাচ্ছে না।
সর্বশেষ ২০১৮ সালের নির্বাচনে বিএনপি যখন খালেদা জিয়াকে কারাগারে রেখে ড. কামাল হোসেনকে নিয়ে ঐক্যফ্রন্ট গঠন করে, তখনই দেশের বড় অংশের কাছে তথ্য ছিল ড. কামাল হোসেনের মাধ্যমে বিএনপির ভরাডুবি হবে এবং আওয়ামী লীগ আবারো সরকার গঠন করবে। কিন্তু দ্বাদশে এসে পুরোনো দৃশ্য সব বদলে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, এখনো দ্বাদশ নির্বাচনের বাকি আছে ১৪ মাস। কিন্তু তার আগেই আবহাওয়া ইতিমধ্যে গরম হতে শুরু করেছে। মারামারি, লাঠালাঠি চলছে। লাশ পড়া শুরু হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ মাঠে। দেশে ও দেশের বাইরের কূটনীতি সমানভাবে চালিয়ে যাচ্ছে। আবার বিএনপিও অতীতের রাজনৈতিক বডি ল্যাঙ্গুয়েজ চেঞ্জ করে ফেলেছে। মাঠ ধরে রাখলেও হরতাল-অবরোধের মতো সহিংস কোনো কর্মসূচিতে যাবে না। মাঠে থাকতে নির্দেশ দিয়েছে নেতাদের আবার বিশেষ পাড়ায়ও যাতায়াত শুরু করেছে দলটি।
জানা যায়, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচন ভারত ছাড়া কেউ ভালোভাবে নেয়নি। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলো বাংলাদেশের গণতন্ত্র রক্ষার প্রতি জোর দিয়েছে। ফলে ঢাকায় কর্মরত বিদেশি কূটনীতিকেরাও বাংলাদেশের রাজনীতিতে স্থিতিশীলতা এবং আরো বেশি বিনিয়োগের প্রত্যাশা থেকে বাংলাদেশের গণতন্ত্র, আইনের শাসন, মানবাধিকার রক্ষা এবং মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নিশ্চিত করার চেষ্টায় দেন-দরবার চালিয়ে যাচ্ছেন। তারা কখনো ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সংলাপ করছেন, কখনো মাঠের বিরোধী দল বিএনপির সঙ্গে সংলাপে বসছেন।
এদিকে নির্বাচন কমিশনের রোডম্যাপ নিয়েও ইতিমধ্যে বিতর্ক উঠেছে। রাজনৈতিক মতামতকে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মাত্র চারটি দল ইভিএমের পক্ষে মত দিলেও ইসির দাবি ১২টি দল মত দিয়েছে। আবার প্রথম লক্ষ্য-উদ্দেশ্যে বলা হয়েছে, ইচ্ছুক অংশগ্রহণকারী দলগুলোকে নিয়ে নির্বাচন করা। কিন্তু সংবিধানে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের কথা বললেও তা ইসির হিসাবে নেই। প্রধান নির্বাচন কমিশনার হাবিবুল আউয়ালও তার নীতিতে ঠিক নেই বলে অভিযোগ রয়েছে। কখনো তিনি বলছেন দেড়শ আসনে দ্বাদশে ভোট করবেন, আবার কখনো বলছেন রাজনৈতিক ঐকমত্য হলে ইভিএম বাদ দেবেন। দেশের প্রায় ৯২ শতাংশ রাজনৈতিক দল ইভিএমকে না ঘোষণা দিলেও শেষ পর্যন্ত ইসি কি চারটি দলকে গুরুত্ব দিয়েই ইভিএমে ভোট বাস্তবায়ন করতে পারবে? রাজনৈতিক মাঠে এখন এমন ক্ষোভের প্রশ্ন।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা বলছেন, বাংলাদেশের সব নির্বাচনের আগে-পরে অনেক রহস্য থাকে। এবারও রয়েছে। তবে এবারের বার্তার চূড়ান্ত কিছু এখনই বলা যাচ্ছে না। তবে দেশের মানুষ অপরাজনীতি থেকে রেহাই পেতে চাচ্ছে। আবার বিদেশি মহল থেকেও নানা বক্তব্য আসছে। শেখ হাসিনা তার অধীনে আবারো নির্বাচন চাচ্ছেন, তা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত বাস্তবায়িত হবে কি না, তা এখনো নিশ্চিত করে বলা যাচ্ছে না। আবার তার অধীনে নির্বাচন হলেই এবার হিসাব সরকারের ঘরে থাকবে, তাও ধারণা করা যাচ্ছে না। কারণ বাংলাদেশে এবার নির্বাচন নিয়ে বহুমুখী চাপ রয়েছে।