দ্বিদলীয় বৃত্ত : ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলা

মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম

বছরের পর বছর, দশকের পর দশক বয়ে যাচ্ছেÑ এর মাঝে সরকার আসছে-যাচ্ছে কিন্তু মানুষের জীবনের অসহায়ত্ব-দুর্গতি-যন্ত্রণা দূর হচ্ছে না। শুধু দুঃশাসন-অপশাসনের পর্যায়ক্রমিক আগমন-নির্গমন ঘটছে মাত্র। কিন্তু আমজনতার ওপর শোষণ-বৈষম্যের বোঝা অব্যাহতই থেকে যাচ্ছে। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকছে, শুধু তার কারণেই এমনটি হচ্ছে না। এটি হচ্ছে একাধারে কোন দল ক্ষমতায় আছে এবং তার পাশাপাশি কোন অর্থনৈতিক নীতি-ব্যবস্থায় দেশ চলছে তার কারণেও। ক্ষমতার সুবিধা লাভকারী ও চরম দলকানা কিছু মানুষ ছাড়া সবাই স্বীকার করে থাকেন, বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের নেতাকর্মী-ক্যাডারদের লুটপাট, সন্ত্রাস, বেআইনি দাপট ও অত্যাচারে জনগণ আজ অতিষ্ঠ। তারা এই দুঃসহ অবস্থার অবসান চায়। কিন্তু এ জন্য যেনতেন উপায়ে গদির বদল ঘটালেই শুধু হবে না। গদি বদলের পাশাপাশি দেশের দুটি ‘মূলধারার’ বুর্জোয়া দল যে লুটপাটতন্ত্রের ব্যবস্থা অনুসরণ করে মেয়াদপরম্পরায় দেশ চালাচ্ছে, তারও অবসান ঘটাতে হবে।
সে কারণে দেশবাসীর সামনে এখন সমান গুরুত্বপূর্ণ দুটি কর্তব্য হলো দেশকে আওয়ামী দুঃশাসন থেকে মুক্ত করা এবং একই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির দ্বিদলীয় বৃত্ত ভেঙে দেশকে মুক্তিযুদ্ধের মৌলিক নীতিধারায় ফিরিয়ে আনা। দেশবাসী বর্তমান দুঃশাসন থেকে মুক্তি চায়। কিন্তু ফুটন্ত কড়াই থেকে জ্বলন্ত চুলায় নিক্ষিপ্ত হতে চায় না। তারা আপদ-বিপদ দুটো থেকেই মুক্ত হতে চায়। এ জন্য যা অপরিহার্য তা হলো, দেশে বিকল্প বাম-গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক শক্তি গড়ে তোলা।
দেশের রাজনীতি আজ ‘বাস্তব অর্থে’ (ফব-ভবপঃড়) দ্বিদলীয় ব্যবস্থার কাঠামোতে আটকা পড়ে আছে। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে এখন আধিপত্য বিস্তার করে আছে বুর্জোয়া ধারার দুটি রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। রাজনীতির মঞ্চে অর্থপূর্ণ মূল শক্তি হয়ে আছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি কেবল এই দুটি দল। এর বাইরে অন্য কোনো দল বা শক্তির স্বাধীন অস্তিত্ব বজায় রাখাটাই প্রায় অসম্ভব করে তোলা হয়েছে। তাদের জন্য কেবল প্রান্তিক সত্তা হিসেবে কিংবা এই দল দুটির কোনো একটির অনুষঙ্গ ‘বি-টিম’ হিসেবে স্থান করে দেওয়া হয়েছে।
স্বাভাবিক ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে এই অবস্থার উদ্ভব হয়নি। বামপন্থী ও জাতীয়তাবাদী এই দুটি ধারার যুগপৎ অবদানের মধ্য দিয়েই রচিত হয়েছিল মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি। সংগঠিত হয়েছিল আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। বহুদিন ধরে বামপন্থীরাই ছিল আওয়ামী লীগের সঙ্গে পাল্লা দেওয়ার মতো শক্তি। বামপন্থীরা এখন দুর্বল। তাদের জায়গা এখন নিয়ে নিয়েছে বিএনপি। আসলে বিএনপিকে সেই জায়গায় সুপরিকল্পিতভাবে নিয়ে আসা হয়েছে। ‘রাজনৈতিক-ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর মাধ্যমে তা ঘটানো হয়েছে। সুপরিকল্পিত নীলনকশা অনুসারেই আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি দলকে ‘বড় দল’ তথা ‘মূলধারার দল’ হয়ে ওঠার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে। দেশে এভাবে একটি দ্বিমেরুভিত্তিক রাজনৈতিক কাঠামোর জন্ম দেওয়া হয়েছে। ওয়ান-ইলেভেনের সময় মাত্র দুই বছরের হোঁচট খাওয়ার ঘটনা বাদ দিলে, প্রায় তিন দশক ধরে এ দেশে এই (ফব-ভবপঃড়) দ্বিমেরুভিত্তিক দ্বিদলীয় ব্যবস্থাই চালু রয়েছে এবং তা এখনো সযতেœ লালন করা হচ্ছে।
একটি গণতান্ত্রিক দেশে সক্রিয় রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আকার ও শক্তিতে ছোট অথবা বড় হওয়াটি অস্বাভাবিক নয়। রাজনৈতিক পরিম-লের অসংখ্য উপাদানের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার মধ্য দিয়েই নির্ধারিত হয় রাজনৈতিক অঙ্গনে বিভিন্ন দলের শক্তি-সামর্থ্য। সময়ের প্রবাহে ছোট দল বড় হয়, বড় দল ছোট হয়ে যায়। নতুন দল জন্ম নেয়, আবার পুরনো দল লুপ্ত হয়। এই প্রক্রিয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে কাজ করে জনগণের চেতনার স্তর, তাদের আবেগ-অনুভূতি, আশা-আকাক্সক্ষা, সামাজিক মনস্তত্ত্ব ইত্যাদি। সেই সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ হলো একটি দলের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক দক্ষতা। উল্লিখিত এই দুই দিকের পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার গতিময়তার দ্বারাই রাজনৈতিক দলের শক্তি-ভিত্তির পরিমাপ ও তার উত্থান-পতন নির্ধারিত হওয়ার কথা। কিন্তু যদি পরিকল্পিত নীলনকশা অনুসারে দুটি দলকে স্থায়ীভাবে ‘মূলধারার’ দল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য অন্যান্য দল, শক্তি বা শক্তি-সমাবেশকে কৃত্রিমভাবে পেছনে ঠেলে রাখা হয়, তা হলে তা অবধারিতভাবে গণতান্ত্রিক রাজনীতির স্বাভাবিক প্রক্রিয়ার ক্ষেত্রে বিকৃতির জন্ম দেয়। আমাদের দেশে তেমনই ঘটছে। প্রধানত দেশি-বিদেশি শক্তিধর মহলবিশেষের সচেতন ‘রাজনৈতিক ইঞ্জিনিয়ারিং’-এর পরিকল্পিত প্রয়াসের মাধ্যমে দেশকে বর্তমানে অনেকটা স্থায়ীভাবে একটি ‘বাস্তব অর্থে’ (ফব-ভবপঃড়) দ্বিদলীয় ব্যবস্থায় আটকে ফেলা হয়েছে।
সাম্রাজ্যবাদ ও দেশীয় লুটেরা ধনিকগোষ্ঠী পাকিস্তানি আমলে যে লুটপাটতন্ত্র দেশবাসীর ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল, রাজনৈতিক উপরিকাঠামো হিসেবে তার সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ছিল ‘স্বৈরাচারী’ ব্যবস্থা। দেশি-বিদেশি শক্তির এই শোষণ প্রক্রিয়ার সঙ্গে ‘গণতন্ত্র’ শুধু বেমানানই ছিল না, তা ছিল অবাধ লুটপাটের পথে একটি গুরুতর বাধাও। সে কারণেই পাকিস্তানে কখনই গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হতে দেওয়া হয়নি। মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানি আমলের শোষণব্যবস্থা তথা লুটেরা পুঁজিবাদী ব্যবস্থা পরিত্যাগ করে সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের যাত্রা শুরু হয়েছিল। ‘গণতন্ত্র’ ছিল এই লক্ষ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাজনৈতিক উপরিকাঠামো। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করে দেশে এক প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক পটপরিবর্তন ঘটানো হয়েছিল। সমাজতন্ত্রের লক্ষ্য পরিত্যাগ করে দেশকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদ তথা নয়া-উদারবাদী অবাধ বাজার অর্থনীতির ব্যবস্থায়। ‘স্বৈরতন্ত্রের’ এই ‘আর্থসামাজিক জমিনের’ ওপর যে ‘গণতন্ত্রের’ ফুল ফোটানো সম্ভব হয় না, গত চার দশকের বেশি সময়ের অভিজ্ঞতা সে কথা প্রমাণ করেছে।
১৯৭৫-এর পর প্রায় আড়াই দশক ধরে দেশে চলেছে ‘সমর নায়ক’ জেনারেল জিয়া ও জেনারেল এরশাদের শাসন। দেশবাসীর ওপর চেপে বসেছিল সামরিক শাসন, বেসামরিক লেবাসে সামরিক বাহিনীর কর্তৃত্ব ইত্যাদি। গড়ে তোলা হয়েছিল স্বৈরাচারের রাজনৈতিক উপরিকাঠামো। দেশি-বিদেশি শোষকরা এক-একজন স্বৈরশাসককে নিয়ন্ত্রণে রেখে তাদের লুটপাটের নিশ্চয়তার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু নব্বইয়ে স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে গণতন্ত্রের জন্য জনগণের জীবনপণ রক্তক্ষয়ী গণসংগ্রামের বিজয়ের ফলে তাদের সে সুযোগ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ফলে তারা তাদের ব্লুপ্রিন্ট বদলাতে বাধ্য হয়েছিল।
এরশাদ স্বৈরাচারের পতনের পর দেশে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র, বেসামরিক রাজনৈতিক সরকারের অধীনে রাষ্ট্র পরিচালনা ইত্যাদি ব্যবস্থা ফিরে এসেছিল। নতুন পটভূমিতে শোষণ অব্যাহত রাখার পথ নিয়ে সাম্রাজ্যবাদ, বিদেশি দাতা সংস্থাগুলো, দেশীয় লুটেরা প্রমুখ শোষকগোষ্ঠী দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে উঠেছিল। তাদের ভয় ছিল এই যে, ভোটের মাধ্যমে সরকার প্রতিষ্ঠার ব্যবস্থা চালু হলে যেকোনো সময় ক্ষমতার হাতবদল ঘটে যেতে পারে এবং সরকার বদলের সঙ্গে সঙ্গে রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক-সামাজিক নীতি পরিবর্তিত হওয়ারও সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। কোনো নতুন সরকার এসে দেশকে যদি ‘সাম্রাজ্যবাদনির্ভর লুটেরা পুঁজিবাদের’ বর্তমান ব্যবস্থা থেকে সরিয়ে নেয়, তা হলে তাদের এত দিনের অবিরাম লুটপাটের সুযোগ হয়তো ক্ষুন্ন হয়ে যেতে পারে। এ অবস্থায় তারা নতুন ‘গণতান্ত্রিক’ রাজনৈতিক উপরিকাঠামোর মধ্যেই তাদের শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার পথ খুঁজতে শুরু করেছিল।
সেই পথ তারা পেয়ে গিয়েছিল ‘ফব-ভবপঃড় দ্বিদলীয় মেরুকরণভিত্তিক ব্যবস্থার’ ফর্মুলায়। এই ফর্মুলা অনুসরণ করে সব দলকে নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করার অধিকার দিলেও শুধু আওয়ামী লীগ ও বিএনপি এই দুটি দলকেই রাষ্ট্রক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার মতো সক্ষমতাসম্পন্ন ‘বড় দল’ হওয়ার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছিল। অন্য সব দল যাতে রাষ্ট্রক্ষমতার প্রশ্নে অর্থপূর্ণ শক্তিসম্পন্ন না হয়ে উঠতে পারে, তা নিশ্চিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছিল। ক্ষমতার হাতবদল হলেও তা যেন এই দুই দলের গ-ির মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সেই সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকে সাম্রাজ্যবাদ ও লুটেরা ধনিক শ্রেণিসহ দেশি-বিদেশি শোষকদের নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবে রাষ্ট্রীয় নীতির শোষণমূলক চরিত্রের কোনো পরিবর্তন যেন কোনোক্রমেই না ঘটতে পারে তার ব্যবস্থা করা হয়েছিল। এভাবে শোষক শ্রেণি দেশে বহুদলীয় গণতন্ত্র বহাল রাখার লোক দেখানো প্রদর্শনের পাশাপাশি তাদের শোষণ প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার একটি ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে পেরেছিল।
দ্বিদলীয় ব্যবস্থার এই ছক কার্যকর করার জন্য রাজনীতিকে অর্থশক্তি, মিডিয়ার আনুকূল্য, বিত্তবানদের সমর্থন, বিদেশিদের অনুকম্পা ইত্যাদির ওপর আরও বেশি নির্ভরশীল করে তোলা হয়েছিল। সামাজিক মনস্তত্ত্বে এই দুটি দলকে ‘সরকারি দল’ ও ‘বিরোধী দল’ হিসেবে স্থায়ীভাবে প্রবিষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। মানুষের ভাবনা গ-িবদ্ধ করে ফেলা হয়েছিল নৌকা না হয় ধানের শীষে; আওয়ামী লীগ না হয় বিএনপিতে। অর্থাৎ যিনি আওয়ামীভুক্ত নন, ধরে নিতে হবে যে তিনি নিশ্চয়ই বিএনপির লোক আর যিনি বিএনপিভুক্ত নন তিনি নিঃসন্দেহে আওয়ামীপন্থী। কেউ যে আওয়ামীপন্থী না হয়েও বিএনপিবিরোধী হতে পারেন কিংবা বিএনপিপন্থী না হয়েও আওয়ামী লীগের বিরোধী হতে পারেন সেই ধারণাটিই মানুষের চিন্তা থেকে তারা অনেকটা পরিমাণে সরিয়ে দিতে পেরেছিল। এখনো এ রকম পরিস্থিতিই বহাল আছে। তবে এই দুটি দলের বাইরে ‘বিকল্প শক্তি’ পাওয়ার প্রত্যাশা দিন-দিন আরও প্রসারিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগ ও বিএনপিকেন্দ্রিক দ্বিদলীয় মেরুকরণের এই ‘ছক’ টিকিয়ে রাখা এখন ক্রমেই অসম্ভব হয়ে উঠছে। লুটপাটের ভাগবাটোয়ারা নিয়ে দুটি দলের মধ্যে দ্বন্দ্ব-সংঘাত এখন এমন তীব্র হয়ে উঠেছে যে, ক্ষমতার হাতবদলের ‘মিউজিক্যাল চেয়ার’ কার্যকর করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠেছে। ‘সুবিধাবঞ্চিত হওয়ার’ এবং ক্ষমতায় থেকে লুটপাট ও অন্যান্য অপরাধ করার জন্য ‘বিচারের সম্মুখীন হওয়ার’ ভয়ে ক্ষমতাসীন দল অব্যাহতভাবে ক্ষমতায় থাকার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে। এ জন্য তারা সব রকম ফন্দি-ফিকির, জোর-জবরদস্তি, ষড়যন্ত্র-চক্রান্ত ইত্যাদির আশ্রয় নিচ্ছে। ক্ষমতায় থাকাকালে বিএনপিও তেমনই চেষ্টা করেছে। তবে তারা সফল হয়নি। আওয়ামী লীগ আশা করছে, তারা সফল হবে। ফলে ‘ক্ষমতার মিউজিক্যাল চেয়ার’ কার্যকর করা এখন প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়েছে।
এ দিকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি তথাকথিত ‘মূলধারার’ এ দুটি দলের ক্ষমতাকেন্দ্রিক, স্বার্থান্ধ ও দেউলিয়া রাজনীতির সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে বেড়ে উঠেছে জামায়াত-শিবির, হেফাজত ইত্যাদিসহ স্বাধীনতাবিরোধী সাম্প্রদায়িক ধর্মান্ধ উগ্র ফ্যাসিস্ট শক্তি। এই দুটি দলের ভেতরে ‘আদর্শ-চিন্তার’ ওপর ‘ক্ষমতা-চিন্তা’ স্থান করে নেওয়ায় এসব বিপজ্জনক অপশক্তি এই দুটি দলের ক্ষমতার গাণিতিক হিসাবকে কাজে লাগিয়ে, তাদের সাম্প্রদায়িক দেশদ্রোহী এজেন্ডাকে এগিয়ে নিতে সক্ষম হচ্ছে। দেশের সামনে এরা প্রধান বিপদ হিসেবে বিরাজ করছে।
মুক্তিযুদ্ধের পর দেশে যে রাজনৈতিক শক্তি-ভারসাম্য ছিল, তা এখন বদলে গেছে। নানা ঘটনার মধ্য দিয়ে সেটি এখন ডানপন্থার দিকে প্রবলভাবে ঝুঁকে পড়েছে। দেশি-বিদেশি শোষকেরা পরিস্থিতিকে এই অবস্থার মধ্যে ‘ফ্রিজ’ করে রাখতে চায়। এ কথা তাই যুক্তিযুক্তভাবে বলা যায়, একমাত্র প্রকৃত বামপন্থী শক্তির উত্থানের মধ্য দিয়ে এবং সেই শক্তিকে ভিত্তি করে দ্বিদলীয় মেরুকরণের বাইরে একটি ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্প’ গড়ার মাধ্যমেই দক্ষিণপন্থার দিকে দেশ ঝুঁকে পড়লে বর্তমান অবস্থা পরিবর্তন করা সম্ভব।
দেশের রাজনীতি বর্তমানে যেভাবে দ্বিদলীয় মেরুকরণের কাঠামোতে আটকা পড়ে আছে তার ফলে জনগণের সামনে ‘ফুটন্ত কড়াই’ এবং ‘জ্বলন্ত চুলার’ মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়া ছাড়া কোনো গত্যন্তর থাকছে না। কিন্তু জনগণ ক্রমেই এ বিষয়টি অনুধাবন করতে সক্ষম হচ্ছে যে, এর কোনোটাতেই তাদের জীবনের যন্ত্রণা দূর হবে না। জনগণের যন্ত্রণা-দুর্ভোগ দূর করতে হলে ‘মন্দের ভালো’ মেনে নিয়ে চলার অধ্যায়ের অবসান ঘটানোর কর্তব্যটি আজ ‘ফরজ’ হয়ে উঠেছে। সে জন্য আজ মুখ ফেরাতে হবে বামপন্থার দিকে। দ্বিদলীয় মেরুকরণের বিষময় বৃত্তটি ভেঙে ‘বাম-গণতান্ত্রিক বিকল্পের’ উত্থান ঘটাতে হবে। এ কর্তব্য ফেলে রাখা বা তাকে অবহেলা করার অর্থ হবে ইতিহাসের কাছে অপরাধী হওয়া।
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি