ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান
ধর্মবিশারদ দাবিদারদের অনেকেই ধর্মীয় আচার-আচরণ এবং বিধিনিষেধ সম্পর্কে মনগড়া সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকেন। আবার অনেকে ধর্মের দোহাই দিয়ে ধর্ম সংরক্ষণে জিহাদেরও ডাক দিয়ে থাকেন। ধর্মীয় মূল্যবোধের দৃষ্টিতে এটি চরম অন্যায়। কারণ জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানব সন্তানকেই আল্লাহ তা’আলা সৃষ্টি করেছেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৭০: নিশ্চয়ই আমি আদম-সন্তানকে মর্যাদা দান করেছি, আমি তাদেরকে স্থলে ও জলে চলাচলের বাহন দান করেছি; তাদেরকে উত্তম জীবনোপকরণ প্রদান করেছি এবং তাদেরকে অনেক সৃষ্ট বস্তুর উপর শ্রেষ্ঠত্ব দান করেছি। {১৭-বনী ইসরাঈল}। কাজেই তাদের বিচার করার এবং শাস্তি দেওয়ার অধিকার একমাত্র প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলারই। কারও মন্তব্য ধর্মীয় মূল্যবোধের দৃষ্টিতে আপত্তিকর হলেও তাকে শাস্তি দেওয়া বা ক্ষমা করার একমাত্র এক্তিয়ার সবই মহান আল্লাহরই । আল্লাহ তা’আলার কাছে সকলেই ফিরে যাবেন। আল-কুর’আনের সত্যতা সর্ম্পকে সুনিশ্চিত হয়েও বহু মানুষ ইসলামকে অস্বীকার করেছে। তাদের ব্যাপারে রাসূলের (সঃ) কোন দায়-দায়িত্ব ছিল না। এর নিশ্চয়তা দিয়ে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৩৩: আমি অবশ্যই জানি তাদের কথা তোমাকে কি দুঃখ দেয়। তারা তো তোমাকে প্রত্যাখান করে না, পাপীরা আল্লাহর নিদর্শনকেই নিন্দা করে। ৩৪: তোমার পূর্বেও প্রেরিত পুরুষেরা প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল; ধৈর্য এবং দৃঢ়তার সাথে তারা তাদের প্রত্যাখ্যান ও অন্যায় আচরণ সহ্য করেছিল যতক্ষণ পর্যন্ত না আমার সাহায্য তাদের কাছে পৌঁছায়। [৬-আন’আম}; ৮২: তারপরেও যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তোমার কতর্ব্য কেবল সুস্পষ্ট বার্তা প্রচার করা। {১৬-নাহ্ল}। আবার অনেকেই বিশ^াস স্থাপন করেও স্বীয় আচরণ, কর্ম ও বক্তব্যে সীমালংঘন করে শিরকে জড়িত হয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১০৫: নভোমন্ডল ও ভূমন্ডলের কত নিদর্শনের পাশ দিয়ে ওরা চলে যায়; কিন্তু সেগুলোর কাছ থেকে তারা দূরে সরে থাকে। ১০৬: তাদেও অধিকাংশই আল্লাহর প্রতি বিশ^াস স্থাপন করে না অন্যদেরকে তার অংশীদার না করে।{১২-ইউসুফ}। প্রবৃত্তির চাহিদাকে প্রাধান্য দিয়ে যারা জীবন পরিচালনা করেন তারা বস্তুতঃ প্রবৃত্তির ইবাদত করে এবং প্রবৃত্তিকে আল্লাহ তা’আলার সাথে শরিক স্থির করেন। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন , ৪৩: তুমি কি এমন লোককে দেখতে পাও যে তার নিজের বাসনাকে তার আরাধ্য হিসেবে গ্রহণ করে? তুমি তার ব্যবস্থাপক হতে পারবে? ৪৪: তুমি কি মনে কর তাদের অধিকাংশ শোনে বা বোঝে? তারা কেবল গবাদি পশুর মতো, বরং তারা অধিকতর পথভ্রষ্ট। {২৫-ফুরকান}। শিরকে লিপ্তদেরও দয়াময় আল্লাহ তা’আলা তাঁর সীমাহীন অনুগ্রহ থেকে বঞ্চিত করেন না। নিজের আত্মীয়-স্বজনের অনেকেই রাসূল (সঃ)-কে প্রত্যাখ্যান করায় রাসূল (সঃ) অত্যন্ত কষ্ট পেতেন। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৬: যদি তারা এই বিষয়বস্তুর [আল-কুর’আন, পরকাল, শাস্তি, পুরস্কার ইত্যাদি] প্রতি বিশ^াস স্থাপন না করে, তবে তাদের পশ্চাতে সম্ভবতঃ তুমি পরিতাপ করতে করতে নিজের প্রাণ নিপাত করবে।{১৮-কাহ্্ফ}। হিদায়েত আসে আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে। যদি কেউ সত্যের সন্ধান পেয়েও সত্যকে বারবার অস্বীকার করে তবে আল্লাহ তা’আলা তার হৃদয়ের দরজা বন্ধ করে দেন যাতে হিদায়েতের আলো অন্তরে পৌঁছাতে না পারে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৯৯: আর তোমার পরওয়ারদেগার যদি চাইতেন. তবে পৃথিবীর বুকে যারা রয়েছে, তাদের সবাই ঈমান নিয়ে আসতো সমবেতভাবে। তুমি কি মানুষের উপর জবরদস্তী করবে ঈমান আনার জন্যে। ১০০: আর কারো ঈমান আনা হতে পারে না, যতক্ষণ না আল্লাহর হুকুম হয়। পক্ষান্তরে তিনি অপবিত্রতা আরোপ করেন যারা বুদ্ধি প্রয়োগ করে না তাদের উপর। { ১০-ইফনুস}। অর্থাৎ তোমার দায়িত্ব হচ্ছে দাওয়াত দেওয়া, সৎপথে আনার দায়িত্ব তোমার নয়। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ২৭২: তাদেরক সৎপথে আনার দায় তোমার নয়। বরং আল্লাহ যাকে ইচ্ছা সৎপথে পরিচালিত করেন। (২-বাকারাহ}।
আদম সন্তান সৃষ্টি হয়েছে ধর্মীয় এবং প্রবৃত্তির স্বাধীনতা নিয়ে। তাই ধর্ম বেছে নেয়ার এবং ধর্ম সর্ম্পকে মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা মানুষের রয়েছে। সবাইকে মরতে হবে, অতঃপর প্রতিপালক আল্লাহ তা’আলার সম্মুখে উপস্থিত হয়ে স্বীয় কর্ম, বিশ^াস ইত্যাদিও জবাবদিহি করতে হবে। আল্লাহ বলেছেন, ১০৭: আল্লাহ ইচ্ছা করলে তারা অলীক উপাস্য গ্রহণ করতো না। কিন্তু আমি তোমাকে তাদের কার্যক্রমের পর্যবেক্ষক করি নি, কিংবা তাদের বিষয়াদি নিষ্পত্তি করার জন্যে তোমাকে নিযুক্ত করা হয়নি। ৬০: অবশেষে তার [আল্লাহ তা’আলার] কাছেই হবে তোমাদের প্রত্যাবর্তন। তারপর যা কিছু তোমরা করেছিলে তার যথার্থরূপ তিনি তোমাদের কাছে উদ্ঘাটিত করবেন। {৬-আন’আম}; ১৫: যে সুপথে চলে সে নিজের কল্যাণের জন্যেই চলে, আর যে বিপথে চলে, সে নিজের ক্ষতি করেই চলে। কোন বোঝা বহনকারী অন্যেও বোঝা বহণ করতে পাওে না। (১৭-বনী-ইসরাঈল}। কাজেই মুসলিম উম্মাহকে বুঝতে হবে যে আল্লাহ তা’আলার অনুগ্রহ ছাড়া কেউ হিদায়েত প্রাপ্ত হয় না।
কাজেই জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের সাথে সদাচরণ করা মুসলমানদের নৈতিক দায়িত্ব। রাসুল (সঃ) বলেছেন, নিশ্চয় আল্লাহ তা’আলা সে লোকদেরকে শাস্তি দিবেন, যারা দুনিয়ার মানুষকে অন্যায়ভাবে সাজা দেয়।{মুসলিম, ৬৪২৪}। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১০৭: বিশ^জগতের প্রতি কেবল রহমতস্বরূপ আমি তোমাকে পাঠিয়েছি।{২১-আম্বিয়া}। রাসূলের (সঃ) চারিএিক বৈশিষ্ট্যের প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা আরো বলেছেন, ৪: এবং নিশ্চয় তুমি শ্রেষ্ঠ চরিত্রের অধিকারী। {৬৮-কালাম}। এ কারণেই রাসূল (সঃ) মহামানব, শ্রেষ্ঠ মানব ও রহমতের নিদর্শন। বাল্যকাল থেকেই রাসূলের (সঃ) চরিত্র ও আচরণ ছিল সর্বোত্তম, ভালোবাসার রহমতে ভরপুর। মানবজাতির জন্যে রাসূল (সঃ)-কে আল্লাহ তা’আলা করেছেন আদর্শের প্রতীক। রাসূলের (সঃ) আদর্শ অনুসরণ করা মুসলিম উম্মাহর অপরিহার্য কর্তব্য। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ২১: তোমাদের মধ্যে যারা আল্লাহ ও আখিরাতকে ভয় করে এবং অনবরত আল্লাহকে স্মরণ করে তাদের জন্যে আল্লাহর রাসূলের মধ্যে রয়েছে অর্পূব জীবনাদর্শ।{৩৩-আহযাব}।
যে সকল মুসলমান রাসূলের (সঃ) জীবনাদর্শকে গুরুত্ব না দিয়ে প্রবৃত্তির তাড়নায় জীবন-যাপন করে তারাই বিভ্রান্ত ও বিপথগামী। হিং¯্রতা, বর্বরতা, নৃশংসতা, সাম্প্রদায়িকতা, মানব হত্যা, গর্হিত কর্মকান্ডে জড়ানো ইত্যাদি সবই অদৃশ্য শয়তানের প্ররোচণায় মানব প্রবৃত্তির চাহিদায় ঘটে থাকে। নিজের অপকর্মকে ন্যায্য হিসেবে প্রমাণ করার জন্য অনেকেই ধর্মকে হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করে। উল্লেখ্য যে, মূসা (আঃ) নবুওয়াত লাভের পূর্বে ফিরআউনের দরবারে এক ব্যক্তিকে হত্যা করেন। একাজ যে শয়তানের প্ররোচণায় হয়েছে সেটা বুঝতে পেরে যে উক্তি করেছিলেন, সে সর্ম্পকে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৫: সে [মূসা (আঃ)] নগরে প্রবেশ করলো যখন তার অধিবাসীরা অসর্তক ছিল; তখন সে সেখানে কলহরত দু’টি লোককে দেখতে পেলো; তাদের মধ্যে একজন ছিল তার সপক্ষীয় এবং অন্যজন শত্রুপক্ষীয়। তার সপক্ষীয় লোকটি তার শত্রুর বিরুদ্ধে তার কাছে সাহায্যেও আবেদন জানায়; তখন মূসা তাকে মুষ্ঠাঘাত করে; তাতেই তার জীবনের অবসান ঘটে। সে বললো “এটা শয়তানের কাজ; নিশ্চয় সে প্ররোচণাকারী সুস্পষ্ট শত্রু।”{২৮-কাসাস}। রাসূল (স) এর উম্মতদের উদ্দেশ্যে আল্লাহ তা’আলা বলেন, ৩১: বল, ‘তোমরা যদি আল্লাহকে ভালোবাস, তবে আমাকে অনুসরণ কর। আল্লাহ তোমাদেরকে ভালোবাসবেন এবং তোমাদের পাপ মার্জনা করে দেবেন। আল্লাহ অত্যন্ত ক্ষমাশীল ও পরম দয়ালু। ৩২: বল, আল্লাহ এবং রাসূলের আদেশ পালন কর। কিন্তু যদি তারা ঘুরে যায়, তবে নিশ্চয়ই আল্লাহ বিশ^াস বর্জনকারীকে ভালোবাসেন না।{৩-ইমরান}।
অথচ মিথ্যা অজুহাতে সন্ত্রাসী এবং ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর সাম্প্রদায়িক হিং¯্রতা, নৃশংসতা এবং নিষ্ঠুর কর্মকান্ডে বর্তমান বিশ্ব সয়লাব হয়ে গেছে। মানবতার শত্রু শয়তান বিভ্রান্তির জাল বিস্তার করে মানুষ খুনে ইন্ধন যোগাচ্ছে। বাংলাদেশের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী মানুষ স্মরণাতীত কাল থেকে সৌহার্দপূর্ণ সম্পর্ক বজায় রেখে বসবাস করে আসছিলেন। অথচ বর্তমানে বাংলাদেশেও ধর্মীয় উগ্রবাদ ধীরে ধীরে মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে। মুসলিম উম্মাহর একটি অংশ ভুলে গিয়েছে যে, ইসলাম আল্লাহ তা’আলার মনোনীত প্রতিষ্ঠিত দ্বীন বা ধর্ম। ইসলামের বিরোধিতা এবং ধর্মীয় বিধিনিষেধের সমালোচনা করে মানুষ নিজেরাই নিজের উপর জুলুম করেন। অতীতে যারাই একাজ করেছেন তারাই বিভিন্নভাবে অপমানিত হয়েছেন। কাজেই ধর্ম সর্ম্পকে কারো আচরণে, কথায়, বক্তৃতায় আপত্তিজনক কিছু থাকলে মুসলিম হিসেবে তাকে ধৈর্যসহকারে বোঝানো অথবা শান্তিপূর্ণ পরিবেশে বক্তৃতা বা প্রবন্ধ লিখে বিষয়টি পরিষ্কার করা দরকার। তাতে যদি তার মধ্যে পরিবর্তন দেখা না যায় তবে ক্ষমার পথ বেছে নেয়াই হচ্ছে বুদ্ধিমানে কাজ। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৩৪: সমান নয় ভালো ও মন্দ। জরয়াবে তাই বল যা উৎকৃষ্ট। তখন দেখবে তোমার সাথে যে ব্যক্তির শত্রুতা রয়েছে, সে যেন অন্তরঙ্গ বন্ধু। ৩৫: এ চরিত্র তারাই লাভ করে, যারা সবর করে এবং এ চরিত্রের অধিকারী তারাই হয়, যারা অত্যন্ত ভাগ্যবান। {৪১-হা-মীম-সিজদাহ}। এটি অত্যন্ত কঠিন কাজ তবুও চেষ্টা করলে অসাধ্য সাধন করা যায়। উদাহরণস্বরূপ: মক্কা জীবনে কাফের নেতৃবৃন্দের অত্যাচার, নিপীড়ন, শারীরিক নির্যাতন, উপহাস, ইসলাম সর্ম্পকে কটূক্তি এবং রাসূল (সঃ)-কে উম্মাদ হিসেবে আখ্যায়িত করা ছিল নিত্যদিনের ব্যাপার। তা সত্ত্বেও রাসূল (সঃ) কাউকে অভিশাপ দেননি। সহাবাদেরকে ধৈর্যধারণ করার জন্য উৎসাহ দিয়েছেন। আবু হুরাইরা (রাঃ) বলেছেন, রাসূলে পাক (সঃ)-কে একবার বলা হলো, ইয়া রাসূলাল্লাহ (সঃ)! আপনি মুশরিকদেও প্রতি অভিসম্পাত করুন। তিনি (সঃ) বললেন, আমি তো অভিসম্পাতকারীরূপে প্রেরিত হইনি; বরং আমাকে পাঠানো হয়েছে রহমতস্বরূপ।{মুসলিম, ৬৩৭৮}।
নবুওয়াতের দশম বছরে উম্মাহর মাতা খাদীজা (রাঃ) এবং পিতৃতূল ¯েœহপরায়ণ চাচা আবু তালেব মৃত্যুবরণ করলে রাসূল (সঃ) মক্কায় সামাজিকভাবে নিরাপত্তাহীন হয়ে পড়েন। এমতাবস্থায় মক্কার নিকটবর্তী ত্যায়েবে দূরসম্পর্কীয় আত্মীয়দের কাছে যান ইসলামের দাওয়াত দিতে। তারা ইসলামের দাওয়াত গ্রহণ না করে রাসূল (সঃ)-এর উপর ইট-পাথর ছুড়ে তার পবিত্র দেহ ক্ষত-বিক্ষত করেছিল। তাঁর পবিত্র পদদ্বয় রক্তাক্ত হল। এমতাবস্থায় রাসূল (সঃ) নিজের অক্ষমতা ও অসহায়তা জানিয়ে আল্লাহ তা’আলার কাছে প্রার্থনা করেন। অতঃপর মক্কায় ফিরার পথে আল-মানাযিল নামক জায়গায় আল্লাহ তা’আলার আদেশে জীব্রাঈল (আঃ) পাহাড়ের তত্ত্বাবধায়ক ফিরেশতাসহ এসে রাসূল (সঃ)-কে সালাম দিয়ে বললেন, আল্লাহ তা’আলা আপনার প্রার্থনা শুনেছেন। তাই আপনার সাহায্যে পাহাড়ের তত্বাবধায়ক ফিরেশতা প্রেরণ করেছেন। আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে মক্কার দুই পাশের্^র পাহাড় দিয়ে গোটা শহরকে ধ্বংস করে দিতে পারি। উত্তরে রাসূল (সঃ) বললেন, আমি বরং চাই তদের প্রজন্ম থেকে অনেকেই এক আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করুক।
অনুরূপ ওহুদের যুদ্ধে মুসলিম উম্মাহ সামায়িকভাবে পরাজিত হন। রাসূলের (সঃ) মাড়ির দাত ভেঙ্গে গুরুতরভাবে আহত হন। মুখ-মন্ডল রক্তাক্ত হয়ে যায়। মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। রক্ত মুছে ফেলার সময় মহানবী (স) বলেছিলেন, আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করার জন্য আহ্বান করার জন্য যে জাতি তাদের কাছে প্রেরিত রাসূলের (সঃ) মুখ-মন্ডল কেটে মাড়ির দাত ভেঙ্গে দেয়, সে জাতি কিভাবে সাফল্যের আশা করতে পারে।” আত-তবারী বলেন, রাসূল (সঃ) আরো বলেছিলেন, ‘ আল্লাহর লানত তাদের উপর, যারা তাদের রাসূলের মুখ রক্ত দিয়ে লেপে দেয়’। তখনই আল্লাহ তা’আলা আয়াত নাযিল করে হাবীবকে জানিয়ে দেন, ১২৮: তিনি তাদের [ওহুদের যুদ্ধে যারা রাসূল (সঃ) আক্রমণ করেছিল] প্রতি ক্ষমাশীল হবেন, না তাদের কাজের জন্যে তাদেরকে শাস্তি দেবেন- এই ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কাজ তোমার নয়, আল্লাহর।{৩-ইমরান}। এই আয়াত মুসলিম উম্মাহর জন্যে অত্যন্ত গুরুত্বর্পূণ। ওহুদের যুদ্ধের পর খালেদ বিন ওয়ালিদ (রাঃ) সহ আরো অনেকে ইসলাম গ্রহণ করেছিলেন। কাজেই বলা যায়, হয়ত আজ যে ব্যক্তি ইসলামের বিরুদ্ধে কথা বলেন, ধর্মীয় মূল্যবোধের সমালোচনা করেন, ভবিষ্যতে সে হয়তো একনিষ্ঠ ইবাদী হয়ে ইসলামের জন্য কাজ করবেন। এব্যাপারে কারো ধারণা নাই। উপরোক্ত আয়াত নাযিল হলে রাসূল (সঃ) কিছু সময়ের জন্য নীরবতা পালন করে বলেন, ও আমার প্রতিপালক! আমার অজ্ঞ সম্প্রদায়কে ক্ষমা কর, তাদের জ্ঞান নাই।’ আরো বলেন, হে আমার প্রতিপালক! আমার সম্প্রদায়কে হিদায়েত দান কর, তাদের কোন জ্ঞান নাই।’{ফাত-আল বারী, ৭:৩৭৩, ৩৬৬; দি সিল্ড নেকতার, পৃষ্ঠা ২৬৮, সফি-উর-রহমান আল-মোবারকপুরী }।
মদীনায় এক ইহুদী রাসূল (সঃ)-কে যাদু দিয়ে কষ্ট দিয়েছিল। তার পরিচয় পাওয়া সত্ত্বেও তাকে তিনি শাস্তি দেননি। মোনাফেক সরদার আব্দুল্লাহ বিন ওবায়ে ইবনে সালুলের ইসলাম বিরোধী কর্মকান্ড এবং রাসূল (সঃ)-কে হত্যা করার বিভিন্ন পরিকল্পনার মূল নেতা সম্পর্কে জ্ঞাত হয়েও রাসূল (সঃ) তার শাস্তির ব্যবস্থা করেন নি। রাসূল (সঃ) নিজের ক্ষতির ব্যাপারে কখনোই রাগ করেননি প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি তবে আল্লাহ তা’আলার মর্যাদা বিনষ্ট করলে তার জন্যে রাগ করতেন। এব্যাপারে আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূলুল্লাহ (সঃ) ব্যক্তিগত [কোন ক্ষতি বা কষ্টের] কারণে [কারো উপরে কখনো] প্রতিশোধ গ্রহণ করেননি। কিন্তু যদি আল্লাহর আইনগত সার্বভৌমত্বের মর্যাদা বা সম্ভ্রম বিনষ্ট করা হতো তবে আল্লাহর সন্তুষ্টিলাভের জন্যে তিনি তার প্রতিশোধ নিতেন। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৩, ৩২৯৬}।
ওহুদের যুদ্ধে সাময়িক পরাজয়ের পিছনে কারণ ছিল কতিপয় সাহাবার রাসূলের (সঃ) নিদের্শকে অমান্য করা। রাসূল (সঃ) তাদেরকে ক্ষমা ও তাদের জন্য দো’য়া করেন। রসূলের (সঃ) প্রশংসায় আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৫৯: আল্লাহর করুণাবশতঃ তুমি তাদের সাথে সদয় আচরণ কর। তুমি যদি কঠোর ও রুক্ষ হৃদয়ের হতে, তারা তোমার কাছ থেকে সরে পড়তো। কাজেই তুমি তাদেরকে মার্জনা কর এবং গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে তাদের সাথে পরামর্শ কর। তারপর যখন তুমি কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করবে, তখন আল্লাহর উপর নির্ভর করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ, তার উপর নির্ভরকারীদেরকে ভালোবাসেন। {৩-ইমরান}। ওহুদের পর মাদীনার পাশর্^বর্তী এলাকার বিভিন্ন গোত্র মুসলিম উম্মাহর উপর আক্রমণের পরিকল্পনা করে। এদের পরিকল্পনা বানচাল করতে গিয়ে বহু সাহাবা শহীদ হয়েছেন। উম্মাহ হিসেবে রাসূলের (সঃ) চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য অনুসরণ না করলে আল্লাহ তা’আলার ভালোবাসা পাওয়া এবং বেহেশতবাসী হওয়া যাবে না। মুসলিম উম্মাহর জ্ঞানী আলেম, বুদ্ধিজীবীসহ সকলের দায়িত্ব রয়েছে বিশ^জগতের রহমত রাসূলের (সঃ) জীবনাদর্শ সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করে নতুন প্রজন্মের সামনে উদাহরণ সৃষ্টি করা। ইসলামের দোহাই দিয়ে হত্যার মত জঘণ্য কাজে নিজে জড়ানো কিংবা অন্যকে জড়াতে অনুপ্রাণিত করা ইসলামের মৌলিক আদর্শ এবং জীবন বিধানের পুরোপুরি বিরোধী। ধর্ম বিরোধী কর্মে জড়িত হয়ে আল্লাহ তা’আলার মনোনীত শান্তি প্রতিষ্ঠার দ্বীন ইসলামের প্রতি মানুষের হৃদয়ে বিতৃষ্ণা সৃষ্টি করা মানে আল্লাহ তা’আলার কঠোর শাস্তির জন্য নিজেকে প্রস্তুত রাখ।
আইওয়া।