নওগাঁ : রাজমিস্ত্রি স্বামীর এক সহকর্মীর সঙ্গে কাজকর্মের সুবাদে মোবাইল ফোনে কথা হয় তার স্ত্রীর। বিষয়টিকে অনৈতিক আখ্যা দিয়ে উভয় পরিবারকেই সমাজচ্যুত করেছেন সমাজের মাতবররা। একইসঙ্গে দুইশর বেশি নারী শ্রমিকের গ্রামের বাইরে কাজ করার ওপর নিষেধাজ্ঞা জারি করেছেন তারা। এর ফলে নারী শ্রমিকরা সরকার ঘোষিত ৪০ দিনের কর্মসৃজন কর্মসূচিতেও কাজ করতে পারছেন না।
ঘটনাটি ঘটেছে নওগাঁর রানীনগর উপজেলার কালীগ্রাম ইউনিয়নের হরিপুর গ্রামে। নিষেধাজ্ঞার শিকার নারী শ্রমিকরা এখন তাদের জীবন-জীবিকা নিয়ে উদ্বিগ্ন ও দিশেহারা। এনজিওর কিস্তিও পরিশোধ করতে পারছেন না তারা। এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা সোনিয়া বিনতে তাবিব জানিয়েছেন, সমাজের লোকজন এমন করার ক্ষমতা রাখেন না। খোঁজ নিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অবশ্য সমাজের সভাপতি খোকন চন্দ্র মোহন্ত সমাজচ্যুত করার কিংবা এ ধরনের নিষেধাজ্ঞা জারির বিষয়টি অস্বীকার করেছেন। তিনি বলেছেন, কালীপদ ও তার জামাইকে গ্রামের সালিশ বৈঠকে ডাকা হয়েছিল। তারা সেখানে উপস্থিত না হয়ে বরং মাতবরদের অপমান করেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, রানীনগর উপজেলার হরিপুর গ্রামের কালীপদের (৫৫) মেয়ের সঙ্গে একই গ্রামের মানিক প্রামাণিকের ছেলে অনন্ত চন্দ্রের বিয়ে হয়। অনন্ত একই গ্রামের কয়েকজন শ্রমিককে নিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করেন। তার কাজকর্মের সুবাদে একই গ্রামের বিনোদ চন্দ্রের ছেলে নিপেন চন্দ্রের সঙ্গে অনন্তের স্ত্রীর মোবাইল ফোনে কথা হয়। এভাবে কথা বলাকে অনৈতিক কর্মকা- আখ্যা দিয়ে সমাজপতিরা মাসখানেক আগে সালিশ করে বিনোদকে ছয় হাজার টাকা জরিমানা করেন। পরে গত ১০ এপ্রিল রাতে সমাজের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা আবারও সালিশি বৈঠকের আয়োজন করেনÑ যাতে কালীপদ, জামাই অনন্ত ও তার স্ত্রীকে হাজির হতে বলা হয়। তারা বৈঠকে না যাওয়ায় সমাজপতিরা কালীপদ, অনন্তসহ দুই পরিবারকেই সমাজচ্যুত করার ঘোষণা দেন।
পাশাপাশি সমাজপতিরা ঘোষণা দেন, গ্রামের নারীরা বাইরে কাজ বা চলাফেরা করায় এলাকার পরিবেশ ও সুনাম নষ্ট হচ্ছে। তাই হরিপুর গ্রামের কোনো নারী শ্রমিক গ্রামের বাইরে কাজ করতে পারবেন না।
সমাজচ্যুত কালীপদ জানান, একই গ্রামের এক ছেলের সঙ্গে তার মেয়ে মোবাইল ফোনে কথা বলায় মাতব্বরা গত ১০ এপ্রিল সালিশ বসিয়ে তাদের সমাজচ্যুত করেছেন। গ্রামের মাতব্বর কমিটির সভাপতি খোকনের সভাপতিত্বে এ সালিশ হয়েছে। গ্রামের সবাই এড়িয়ে চলছে তাদের।
হরিপুর গ্রামের ভ্যানচালক দীনেশ চন্দ্র জানান, নিষেধাজ্ঞা থাকায় তাদের ভ্যানে নেওয়া হচ্ছে না। একই গ্রামের স্বপন চন্দ্রের স্ত্রী রেখা জানান, কালীপদ ও তার জামাইকে গ্রামে আটক দেওয়া হয়েছে। তাদের সঙ্গে কথা বলা যাবে না বলে তার স্বামী তাকে জানিয়েছেন।
গ্রামের নারী শ্রমিক ফুল কুমারী (৩২), ডোহরি (৫৮), ধলি (২৮), লক্ষ¥ী রানীসহ (৫৫) বেশ কয়েকজন নারী শ্রমিক জানান, সমাজের সভাপতি খোকন বৈঠকে হুকুম জারি করেছেন, গ্রামের কোনো নারী শ্রমিক গ্রামের বাইরে কাজ করতে পারবেন না। বাজার করতে পারবেন না। সরকারের ৪০ দিনের কর্মসূচির কাজও করা যাবে না। তাদের কেউ কেউ কান্নায় ভেঙে পড়ে বলেন, কাজ-কর্ম করতে না পারলে সংসার চলবে কী করে? এনজিও ও ব্যাংকের কিস্তি দেব কী করে?
রানীনগর থানার ওসি এ এস এম সিদ্দিকুর রহমান জানান, এ ধরনের কোনো অভিযোগ তারা পাননি। অভিযোগ পেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।