নজরুলের অমর সব সৃষ্টি পৃথিবীকে দিতে পারে নতুন দিকনির্দেশনা

নজরুল স্বরণে

ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ :

বিশ্ব মানবতার মহান কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতা, গান ও দর্শনকে প্রবাসী বাঙালি এবং পৃথিবীর সকল মানুষের কাছে পরিচিত করার জন্য ৩২ বছর আগে উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন শুরু হয়েছিল।

নজরুল ছিলেন অন্যায়, অবিচার আর অনিয়মের প্রতি আপসহীন চির বিদ্রোহী কবি। ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতার কথা কংগ্রেসের আগেই প্রথম ঘোষণা দিয়েছিলেন নজরুল ইসলাম। ব্রিটিশ বিরোধিতার জন্য জেল খেটেছিলেন, কিন্তু জেলে বসেই পৃথিবীর সকল রাজনৈতিক জেলবন্দীকে জেলের শিকল ভাঙার জন্য গান গেয়ে আহ্বান করেছিলেন। জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে সকল অন্যায়, অবিচার ও সামাজিক অধঃপতনের বিরুদ্ধে সারা জীবন প্রতিবাদ করে গিয়েছিলেন নজরুল।

মাত্র ২৩ বছরের সক্রিয় সৃষ্টিশীল জীবনে বাংলা ভাষার অবিস্মরণীয় সব বিপ্লবী কবিতা, প্রবন্ধ লিখে আর জ্বালাময়ী সব বক্তৃতা করে মাঠে-ময়দানে ছুটে বেড়িয়েছেন এবং তিনিই আবার সবচেয়ে বেশি সংগীতও রচনা করেছিলেন।
প্রথমবারের মতো নানা ধরনের নানা দেশের সুর নিয়ে সমৃদ্ধ করেছিলেন বাংলা সংগীতকে, তৈরি করেছিলেন নতুন রাগরাগিণী। আবার ধর্মীয় সংগীতকেও দিয়েছিলেন নতুন মর্যাদা। নজরুল ছিলেন ভীষণ অসাম্প্রদায়িক, যিনি অভূতপূর্ব ইসলামিক সংগীতের প্রবর্তক আবার শ্যামা সংগীতেরও শ্রেষ্ঠ গীতিকার ও সুরকার।
ব্রিটিশদের পক্ষপাতিত্বের জন্য বাঙালি মুসলমানরা যখন বাংলা ভাষা চর্চা করতে অনাগ্রহী, তখন নজরুল এসে ভেঙে দিলেন সেই বাঁধ। সেই সময় দুর্বল বাঙালি মুসলিম সমাজকে তিনি কয়েক শ বছর এগিয়ে দিয়ে গেলেন।
উত্তর আমেরিকার ইতিহাস, সাহিত্য, সংস্কৃতিতে নজরুল ছিলেন প্রায় অজ্ঞাত।
সাম্য, সম্প্রীতি আর মানবতার কবি নজরুলের অমর সব সৃষ্টি বর্তমানে দিশেহারা অন্যায়-অবিচারে জর্জরিত পৃথিবীকে দিতে পারে নতুন এক দিকনির্দেশনা। সেই লক্ষ্যে নজরুলকে বিশ্বায়ন করার অভিপ্রায়ে আমেরিকার নজরুল সম্মেলনের উদ্যোগ ছিল একটি ক্ষুদ্র পদক্ষেপ।

৩২ বছর আগে মাহমুদ বিল্লাহর উদ্যোগে নিউজার্সির ‘সৌখিন শিল্পীগোষ্ঠী’র নিবেদন প্রথম নজরুল সম্মেলনের প্রধান অতিথি ছিলেন কিংবদন্তি শিল্পী ফিরোজা বেগম। তিনি সেদিন বলেছিলেন, ‘আমি মানবতার জয়গান নিয়ে তূর্যবাদকতার মতো সম্মান পাওয়ার আর কাউকে তো দেখি না।’
বস্টনে দ্বিতীয় সম্মেলনে প্রধান অতিথি ছিলেন নজরুল অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। নজরুল সম্মেলনের পক্ষে তৈরি ডকুমেন্টারিটিকে নজরুলকে নিয়ে তৈরি তৎকালের তিনটি ডকুমেন্টারির মধ্যে শ্রেষ্ঠ বলে তিনি বিবেচনা করেছিলেন। বিভিন্ন সময়ের উত্তর আমেরিকার নজরুল সম্মেলনে ভারত, জাপান, নেদারল্যান্ডস থেকেও নজরুল গবেষক এবং নজরুলপ্রেমী বিদেশি বন্ধুরা যোগ দিয়ে নজরুল সম্মেলনকে পরিচিতি আর গতিময়তা দিয়েছেন।

নজরুল সম্মেলনের কমিটির কর্ণধারেরা প্রতি দুই বছর স্বাগতিক সংগঠনগুলোকে দায়িত্ব দিয়ে থাকেন। যৌথ উদ্যোগে হলেও সামগ্রিকভাবে স্বাগতিক সংগঠন দায়িত্ব পালন করে। সম্মেলন কমিটির বহু বছরের চেয়ারম্যান ড. সুলতান আহমেদ, বর্তমান চেয়ারম্যান মোশাররাফ হুসেইন, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ, ইসি মেম্বার ওয়াহিদ হুসাইনী, সাংবাদিক রোকেয়া হায়দার, মাহমুদ বিল্লাহ, ডা. ওয়াদুদ ভূঁইয়া, হিরণ চৌধুরী, কবির কিরণ, এ্যানি ফেরদৌস, সেলিমা আশরাফ, নিলুফার জাহান, নিভা রহমান, ইলোরা আমিন, সুস্মিতা গুহ রায়, জাহিদ হুসাইনসহ অন্যদের দিকনির্দেশনা কমিটিকে উৎসাহ দিচ্ছে। এবারও নজরুল সম্মেলন কমিটি ‘বুলবুল’ নাম দিয়ে সুন্দর ও তথ্যবহুল সংকলন বের করে। এবারের সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি অ্যান্থনি পিউস গোমেজ। সম্মেলনের কর্মতৎপরতায় নজরুলসংগীত আজ প্রবাসের বিভিন্ন অনুষ্ঠানে প্রাধান্য পাচ্ছে।

আজ বেশ কয়েকজন আমেরিকান হয়েছেন নজরুল গবেষক। বস্টনের সাজেদ কামালসহ অন্যদের নজরুলের অনুবাদ পড়ে তারা বাকরুদ্ধ! নিজেরা নতুন বই লিখেছেন। ইংরেজিতে নজরুল প্রকাশনা বাড়ছে। গুলশান আরা কাজী ও কাজী শাহজাহান দম্পতির উদ্যোগে ক্যালিফোর্নিয়ার স্টেট ইউনিভার্সিটি এবং ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটে আজ নজরুলের ওপর স্টাডি শুরু হয়েছে। তারা আজ বাংলাদেশ ও কলকাতার সঙ্গে সমন্বয় সাধন করে এই বিশ্বায়ন প্রক্রিয়ার গতি তৈরি করেছেন।

নিউজার্সিতে এবার ১৯তম নজরুল সম্মেলন শেষ হলো। এবারের সম্মেলনের একটি বড় দিক ছিল সম্মেলনের এক বছর আগে থেকে কনভেনর কবির কিরণের ‘শতদল’ টেলিভিশনের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও কলকাতার নজরুল ইনস্টিটিউটের অনেক কর্মকর্তা, শিল্পী, গবেষক ও লেখকের সমন্বয় ঘটিয়ে এক নতুন আবহ তৈরি করেছিল শতদল গোষ্ঠী। সহযোগিতায় ছিলেন সচিব হাসান আমজাদ, রাহাত চৌধুরী, ড. রফিক খান ও সাবরিনা কবির ছন্দা। শতদলের এই প্রচার ছিল আমাদের কবিকে বিশ্বায়ন করার এক অভিনব পন্থা। আমরা গত ৩২ বছর দেখেছি, দুই দিনব্যাপী যেকোনো সম্মেলনে প্রবাসে ব্যস্ত মানুষের উপস্থিতির ওপর কোনো ভরসা করা যায় না। তাই এই উদ্যোগকে প্রচার ও প্রসার করার জন্যই এই অভিনব নতুন পদক্ষেপটি নেওয়া হয়।

এবারের সম্মেলনে বেশ কিছু চমকপ্রদ আকর্ষণ ছিল। তার মধ্যে নতুন প্রজন্মের ১০ জনকে নিয়ে চমৎকার সেমিনার করিয়েছিলেন কাজী শাহজাহান ও গুলশান আরা কাজী। সেমিনারের বক্তাদের মধ্যে ছিলেন ভয়েস অব আমেরিকার রোকেয়া হায়দার ও আনিস আহমেদ, অনুবাদক ড. মুস্তাফা মুনির, অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দিন আহমেদ এবং দুজন অবাঙালি অধ্যাপক। একজন অধ্যাপক উইনস্টন লেংলি, যিনি একজন নজরুল গবেষক এবং অসাধারণ বাগ্মী। তিনি ইউনিভার্সিটি অব ম্যাসাচুসাসের প্রাক্তন ভিসি। তিনি নজরুলকে আবিষ্কার করতে করতে এতই অভিভূত যে তিনি এই সম্মেলনে তার রিটায়ারমেন্টের ৩০ শতাংশ বেতন নজরুলের ওপর স্টাডি করার জন্য ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাটকে অনুদান হিসেবে দেওয়ার ঘোষণা দিলেন। আরেকজন হলেন অধ্যাপক ড. জোসেফ চ্যাং, যিনি ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাট এশিয়ান স্টাডি ডিপার্টমেন্টের প্রধান এবং নজরুল স্টাডিরও প্রধান। তিনি তার বক্তব্যে নজরুলের গান, কবিতা ও দর্শনকে উপজীব্য করে পৃথিবীর নির্যাতিত মানুষের পক্ষে কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা তুলে ধরেন। তা ছাড়া দুই দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ থেকে আসা স্বনামধন্য শিল্পীবৃন্দ ওস্তাদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, ড. লীনা তাপসী, সুজিত মুস্তাফা, নজরুলের নাতনি এবং গবেষক ও বোর্ড মেম্বার খিলখিল কাজী, অস্ট্রেলিয়া থেকে শিল্পী আদিলা নূর।

৩২তম নজরুল সম্মেলনের আমন্ত্রিত এই গুণী শিল্পীদের নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় অন্যান্য সংগঠনও অনুষ্ঠান করতে পারছে। নজরুল সম্মেলনের এই অবদান কাজী নজরুল ইসলামের সংগীত ও দর্শনকে প্রবাসী বাঙালিদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একটি অঙ্গীকার। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বিভিন্ন স্টেট থেকে অংশ নিয়েছে বহু প্রতিষ্ঠান। উৎসাহ-উদ্দীপনা নিয়ে অনেক দিনের প্রশিক্ষণ নিয়ে তৈরি হয়ে এসেছেন তারা। গান, কবিতা, নৃত্য ও নাটিকার মাধ্যমে সবাইকে মুগ্ধ রেখেছিলেন। সবার সঙ্গেই ছিল অসাধারণ নতুন প্রজন্মের উপস্থিতি। এই সম্মেলনেই প্রথমবারের মতো ‘কাজী সব্যসাচী’ সম্মাননা ঘোষণা করা হয়। এবার এই সম্মাননা পেয়েছেন কিংবদন্তি আবৃত্তিকার ভয়েস অব আমেরিকার প্রাক্তন প্রধান ইকবাল বাহার চৌধুরী।

প্রবাসের গতানুগতিক আনন্দ অনুষ্ঠানের সঙ্গে নজরুল সম্মেলনের উদ্দেশ্য আর মাহাত্ম্য যেন হারিয়ে না যায়। দুই দিনব্যাপী যেকোনো বড় অনুষ্ঠানে কিছু ভুলত্রুটি অনিচ্ছা সত্ত্বেও হয়ে যায়। তাই বলে প্রাপ্তির বিশালতাটাও যেন আমরা ভুলে না যাই। সকল নজরুলপ্রেমীর আন্তরিক সহযোগিতা, সহায়তা এবং সম্পৃক্ততা নজরুলকে বিশ্বায়ন করার এই আন্দোলনে আমাদের নিজেদেরই সম্মানিত করবে। যে কটি ভুলত্রুটি হয়েছে, তার মধ্যে আনন্দের অতিশয্যে প্রবাসের নামকরা সংগঠনগুলো তাদের নির্ধারিত সময়ের অতিরিক্ত সময় নেওয়ায় কিছু সংগঠন অনুষ্ঠান করতে পারেনি, এমনকি অতিথি শিল্পীরা প্রাপ্য সময় পাননি। এর যেন পুনরাবৃত্তি না হয়। তবে সম্মেলনটি ছিল একটি মিলনমেলা, যার প্রধান উদ্দেশ্য কাজী নজরুল ইসলামকে ঘিরে গড়ে উঠবে একটি আন্দোলন, যার দ্যুতি ছড়িয়ে পড়বে আমাদের বুকের মাঝে এবং বিশ্বের সব প্রান্তে।

‘শতদল’ বহু ত্যাগ স্বীকার করে নিবেদন করেছে এই সফল নজরুল সম্মেলন। তাদের আরো সহায়তা করেছেন রায়হানুল ইসলাম চৌধুরী, আবু বকর হানিপ, রাহাত হোসাইন নাজু, গোলাম ফারুক ভূঁইয়া, ইউনিভার্সিটি অব কানেকটিকাট, মাহবুবুর ভূঁইয়া। তাদের সবাইকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।