‘নজরুল শুধু বাংলাদেশের নয়, সমগ্র বিশ্ববাসীর

নিউজার্সিতে ১৯তম নজরুল সম্মেলন

ঠিকানা রিপোর্ট : ‘বিদ্রোহী কবি’ নামে খ্যাত বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম শুধু বাংলাদেশের বা বাংলা ভাষাভাষী মানুষের কবিই নন, তিনি সমগ্র বিশ্ববাসীর কবি। কেননা, তার কবিতা, গানে বিশ্বের সব নিপীড়িত, নির্যাতিত গণমানুষের কথা ছাড়াও মানুষের প্রেম-প্রণয় আর ভালোবাসার কথাই তুলে ধরেছেন। তাঁর লেখা সব ধর্ম-বর্ণ, মত আর পথকে এক করে অসাম্প্রদায়িক মানবতাকে এক করেছে। কবি নজরুলকে জানতে, বুঝতে আর অনুধাবন করতে হলে, তাঁকে নিয়ে আরো গবেষণা করতে হবে। তার লেখা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে হবে, সর্বোপরি বিশ্ব দরবারে কবি নজরুলকে তুলে ধরতে হবে।’
এমন আহ্বানের মধ্য দিয়ে নিউজার্সিতে অনুষ্ঠিত হলো দু’দিনের ১৯তম উত্তর আমেরিকা নজরুল সম্মেলন-২০২২। তবে দেশ ও প্রবাসের শিল্পী ও সংগঠনগুলোর অনুষ্ঠান পরিবেশনা মুগ্ধ করলেও দর্শক-শ্রোতার খরা ছিলো লক্ষ্যণীয়।
নিউজার্সির ইস্ট ব্রুন্সউইকস্থ জেএমপি আর্ট সেন্টারে গত ১৩-১৪ আগস্ট এ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। এবারের সম্মেলনের শ্লোগান ছিলো ‘চির উন্নত মম শির’। সম্মেলনের আয়োজক সংগঠন হচ্ছে শতদল। এবারের সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি ছিলেন কবি নাতনী খিলখিল কাজী, বাংলাদেশের প্রখ্যাত নজরুল সঙ্গীত শিল্পী ওস্তাদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, শিল্পী সুজিত মুস্তফা ও শিল্পী লীনা তাপসী।


এতে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সি রাজ্যসহ উত্তর আমেরিকার ১২টি সংগঠন অংশ নেয়।
দু’দিনের এই সম্মেলনের কর্মকান্ডের মধ্যে ছিলো কবি নজরুলের জীবন ও কর্ম নিয়ে আলোচনা, সেমিনার, প্রদর্শনী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। প্রতিদিন বেলা ২টায় শুরু হয়ে অনুষ্ঠান চলে রাত ১০টা পর্যন্ত। এছাড়াও মূল মঞ্চের বাইরে ছিলো একটি বই, একটি খবারের স্টলসহ একাধিক শাড়ি-কাপড় ইমিটেশন গহনার স্টল প্রভৃতি।
এদিকে দু’বছর পর পর নজরুল সম্মেলন হওয়ার কথা থাকলেও এর ব্যতিক্রম ঘটেছে। তবে আগামী ২০২৪ সালে নজরুল সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে কানাডার টরন্টোয়। এর আয়োজক সংগঠন থাকবে ইলোরা আমীন নেতৃত্বাধীন তরঙ্গ। তবে কোন সংগঠন চাইলে আগামী বছর নজরুল সম্মেলন আয়োজন করার বিষয়টি নর্থ আমেরিকা নজরুল কনফারেন্স কমিটি (এনএএনসিসি) বিবেচনা করবে বলে জানা গেছে। গত ১৪ আগস্ট সকালে হোটেল লবিতে অনুষ্ঠিত এনএএনসিসি’র কোর কমিটির সভায় পরবর্তী সম্মেলনের বিষয়ে সিদ্ধান্ত হয়। অপরদিকে এবারের নজরুল সম্মেলন থেকে প্রতি বছর কবি পুত্র প্রখ্যাত আবৃত্তিকার ‘কাজী সব্যসাচী’র নামে অ্যাওয়ার্ড প্রদানের সিদ্ধান্ত হয়েছে। এ বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনীত হন ভয়েস অব আমেরিকা’র বাংলা বিভাগের সাবেক প্রধান, আবৃত্তিকার ইকবাল বাহার চৌধুরী। অ্যাওয়ার্ডটি ঘোষণার পর ইকবাল বাহার চৌধুরীর ভিডিও বার্তা পর্দায় প্রচার করা হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সম্মেলনে যোগ দিতে পারেনি।
সম্মেলনের প্রথমদিন (১৩ আগস্ট) নজরুল বিষয়ক সেমিনার ছাড়াও অন্যান্য অনুষ্ঠানের মাঝে সন্ধ্যায় আনুষ্ঠানিকভাবে ১৯তম নজরুল সম্মেলনের উদ্বোধন করেন এনএএনসিসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন। এ সময় মঞ্চে আমন্ত্রিত অতিথি ছাড়াও বিশেষ অতিথি যথাক্রমে রায়হানুল ইসলাম, ওয়াশিংটন ইউনিভর্সিটি অব সাইন্স এন্ড টেকনোলজির চ্যান্সেলর ইঞ্জিনিয়ার আবু বকর হানিপ এবং এনএএনসিসি’র ভাইস চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. জিয়াউদ্দন আহমেদ, সদস্য ড. সুলতান আহমেদ, রোকেয়া হায়দার, ডা. ওয়াদুদ ভূঁইয়া, সম্মেলনের প্রধান সমন্বয়কারী রাহাত চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। উদ্বোধনী পর্বে সংক্ষিপ্ত শুভেচ্ছা
বক্তব্য রাখেন- সম্মেলনের কনভেনর মোহাম্মদ কবীর কিরণ ও সদস্য সচিব হাসান আমজাদ খান।
অপরাহ্নে মূল মঞ্চের বাইরে একটি কক্ষে বিষয়ভিত্তিক সেমিনার অনুষ্ঠিত হয়। এতে আমন্ত্রিত অতিথি, নজরুল বিশেষজ্ঞ ও এনএএনসিসি’র শীর্ষ কর্মকর্তারা অংশ নেন। সেমিনারগুলোতে দর্শক-শ্রোতার উপস্থিতি ছিলো আরো কম। এদিন নিউইয়র্ক ঢাকা ড্রামার প্রযোজনায় কাজী নজরুল ইসলামের ছোট গল্প অবলম্বনে নাটক ‘রাক্ষুসী’ মঞ্চস্থ হয়। এর নাট্যরূপ ও নির্দেশনায় ছিলেন বিশিষ্ট অভিনেত্রী শিরীন বকুল। নাটকটি উপস্থিত দর্শক-শ্রেতাদের মুগ্ধ করে।
প্রথমদিন পরিবেশিত শতদল ও বাংলাদেশ এসোসিয়েশন অব নিউজার্সি (বিএএনজে)-এর পরিবেশনাও সবাইকে মুগ্ধ করে। সম্মেলনের দ্বিতীয়দিন (১৪ আগস্ট) সন্ধ্যায় ও রাতে বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পারফর্মিং আর্টস-বিপা ‘মনেরও রং লেগেছে’ ও ‘বিদ্রোহী’ শিরোনামে বিশেষ অনুষ্ঠান প্রদর্শন করে। এটি উপস্থিত দর্শক-শ্রোতাদের মুগ্ধ করার পাশাপাশি ব্যাপক প্রশংসা কুড়ায়। সম্মেলনের মূল অনুষ্ঠান উপস্থাপনায় ছিলেন নিউইয়র্কের দুই বিশিষ্ট উপস্থাপিকা ও নিউজ প্রেজেন্টার সাদিয়া খন্দকার এবং শামসুন্নাহার নিম্মি। এছাড়াও স্থানীয় উপস্থাপক ও উপস্থাপিকারা বিভিন্ন পর্ব সঞ্চালনায় ছিলেন। সম্মেলনের বিভিন্ন দিন উল্লেখযোগ্য শিল্পীদের মধ্যে অষ্ট্রেলিয়ার সিডনী থেকে আগত আদিলা নূরসহ সঙ্গীত পরিবেশন করেন সামিয়া মাহবুব, গায়ত্রী সাহা, সুচরিতা ঘোষ প্রমুখ।
বিভিন্ন পর্বে আবৃত্তি করেন ডা. ফারুক আজম, কবীর কিরণ প্রমুখ। সম্মেলনটি উপলক্ষে ‘চির উন্নত মম শির’ শীর্ষক ম্যাগাজিন প্রকাশ করা হয়।
খিলিখিল কাজীর ক্ষোভ : সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে অংশ নেয়া কবি নজরুল ইসলামের নাতনী খিলখিল কাজী ১৪ আগস্ট রাতে মঞ্চে উঠে গান না গেয়ে কবিকে নিয়ে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন এবং ‘বিদ্রোহী’ কবিতাসহ কবির লেখা ২/৩টি কবিতা পাঠ কওে শোনান। এ সময় তিনি বলেন, আজকের সম্মেলনে আমার বাবা কবি সব্যসাচীর নামে ‘অ্যাওয়ার্ড’ উৎসর্গ করা হয়েছে। এতে আমি খুশি হলেও, যাঁর জন্য তার নামে অ্যাওয়ার্ড হলো, সেই সব্যসাচীর কণ্ঠে ‘বিদ্রোহী’ কবিতার অংশ দর্শক-শ্রোতাদেও শোনানো হলো না, এটা উচিৎ ছিলো।
মন খুলে গাইতে পারলেন না শিল্পীরা : দু’দিনের সম্মেলনে দেশ-বিদেশ ও প্রবাসের শিল্পীরা সঙ্গীত পরিবেশন করা ছাড়াও অন্যান্য পারফর্ম করার কথা থাকলেও তারা প্রাণভরে তাদের পরিবেশনা করতে পারেননি। আয়োজকদের পরিকল্পনার ত্রুটির কারণে শতদলসহ আরো একাধিক সংগঠনের পরিবেশনা শেষ পর্যন্ত বাতিল করতে হয়েছে। অপরদিকে ঢাকা থেকে আগত ওস্তাদ সালাহউদ্দিন আহমেদ, শিল্পী সুজিত মুস্তফা ও শিল্পী লীনা তাপসীকে মাত্র তিনটি করে গান পরিবেশন করতে হয়েছে। এতে শিল্পীরাও যেমন অতৃপ্তি প্রকাশ করেছেন, তেমনি উপস্থিত দর্শকরাও।
সম্মেলনের শেষদিন (১৪ আগস্ট) আমন্ত্রিত অতিথি, বিশেষ অতিথি এবং এনএএনসিসি’র শীর্ষ নেতৃবৃন্দকে প্ল্যাক প্রদান আর উত্তরীয় পরিয়ে সম্মানিত করা হয়। এর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলামনাই এসোসিয়েশন নিউইয়র্ক-এর পক্ষ সম্মেলনের কনভেনর মোহাম্মদ কবীর কিরণ ও সদস্য সচিব হাসান আমজাদ খানকে প্ল্যাক প্রদান করে সম্মানিত করেন ফরিদা আক্তার ও মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ।
এছাড়াও ২০২৪ সালের সম্মেলনের (টরন্টো, কানাডা) ঘোষণা দেন এনএএনসিসি’র চেয়ারম্যান মোহাম্মদ মোশাররফ হোসাইন।
রাত ১০টায় কনভেনর কবীর কিরণের কণ্ঠে ‘যদি আর বাঁশি না বাজে’ কবিতা আবৃত্তির মধ্য দিয়ে সম্মেলনের সমাপ্তি ঘটে।