সৈয়দ মামুনুর রশীদ :
আজ যাঁকে নিয়ে লিখছি, তিনি একজন স্বনামধন্য নজরুল-সংগীতশিল্পী ড. নিরুপমা রহমান নীরা। মা-বাবার দেওয়া ডাকনাম ‘নীরা’। এই মিষ্টি নামটির যেমন একটি সুরেলা উচ্চারণ রয়েছে, তেমনি দেখতেও তিনি অত্যন্ত সুন্দরী। দীর্ঘ দুই দশক ধরে অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন শহরের অভিবাসী। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে শিক্ষকতা ও গবেষণা পেশায় নিয়োজিত আছেন। কন্যাসন্তান ও স্বামীকে নিয়ে তাঁর ছোট্ট সংসার। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজ, সাংসারিক ব্যস্ততা আর শাস্ত্রীয় সংগীত নিয়ে তাঁর যাপিত জীবনকে সুরেলায় উদ্্যাপন করেন। জীবন চলার পথে সংগীত হচ্ছে সংগীতজ্ঞ নিরুপমা রহমান নীরার কাছে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য সত্ত্বা। তাই এই সত্ত্বাকে তিনি মনেপ্রাণে ভালোবাসেন। সেই ছোট্টবেলায় তিন বছর বয়স থেকে সংগীতের প্রতি অনুরাগ ও অনুশীলনের সূচনা, যখন তাঁর স্কুলে যাওয়ার মতো বয়সই হয়নি। যখন বিদ্যাপীঠে যাওয়ার সময় হয়েছিল, তখন থেকেই বাংলা বর্ণমালার সাথে তাল মিলিয়ে হারমোনিয়ামে সারেগামাপা শেখার চর্চা শুরু হয়ে গেল। ছোটবেলায় গানের প্রতি এমন দুর্বার আকর্ষণ দেখে বাবা-মা তাঁর তৃতীয় জন্মবার্ষিকীতে উপহার হিসেবে একটি হারমোনিয়াম দিয়েছিলেন এবং তাঁর চতুর্থ জন্মবার্ষিকীতে উপহার দেন একটি তানপুরা, যা কিনা নীরার উচ্চতার চেয়ে প্রায় আড়াই গুণের মতো লম্বা আর ওজনে তার ওজনের চেয়ে দ্বিগুণ হবে। সেই ছোটবেলার তিন নিত্যসঙ্গীর মধ্যে ছিল বই, হারমোনিয়াম ও তানপুরা।
নিউইয়র্কের ৩১তম বইমেলায় আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে এসেছিলেন আমাদের মাঝে। চার দিনের বইমেলার প্রতিদিনই ছিলেন মেলার আঙিনায়। বিভিন্ন সেমিনারে অংশগ্রহণ করেছেন। নজরুলসংগীত পরিবেশন করেছেন। ড. নিরুপমা রহমানকে আগে থেকে জানলেও তাঁকেসহ তাঁর গান শোনার সৌভাগ্যের অভিজ্ঞতা এই প্রথম। কোনো দিনই নীরার নজরুলসংগীত এত কাছাকাছি থেকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো শোনার সুযোগ হয়ে ওঠেনি। এমনকি তিনি এত শ্রুতিমধুর কণ্ঠের অধিকারী, তা কখনো অনুধাবন করতে পারিনি। মেলার প্রথম দিন তাঁর কণ্ঠে নজরুলসংগীত শুনে যেভাবে মুগ্ধতায় আপ্লুত হয়েছিলাম, তার বিগত অভিজ্ঞতার স্বাদ মেলার সমাপনীর একক অনুষ্ঠান আবার আমাকে পুনরাবৃত্তির তৃপ্ততা দিয়েছে।
আশির দশকের স্মৃতি মনে পড়ে যায়। মান্না দে ও ভূপেন হাজারিকার গান শোনার জন্য উতলা হয়ে উঠতাম। এই নিউইয়র্কে ওই দুজন গুণী শিল্পীর লাইভ অনুষ্ঠান ভুলেও মিস করিনি। প্রাণভরে বিভোর হয়ে শুনতাম প্রতিটি গান ও গানের পটভূমিকা। অনেক দিন পর সেই পরিবেশের পুনরাবৃত্তি দেখলাম সংগীতজ্ঞ নিরুপমার অনবদ্য নজরুলসংগীত পরিবেশনায়। তাঁর পরিবেশিত প্রতিটি গানের প্রেক্ষাপটে নজরুলকে তুলে ধরেছেন সুরের বৈচিত্র্যতায়। তিনি নিজেই বলেছেন, শাস্ত্রীয় সংগীত চর্চার মধ্য দিয়ে তাঁর সংগীতের জগতে অনুপ্রবেশ। তাই নজরুলের গানে সেই শাস্ত্রীয় সংগীতের মিল খুঁজে পান বলেই নজরুলসংগীতকে তাঁর প্রিয় সংগীতরূপে বেছে নিয়েছেন। মেলার প্রথম দিনে তাঁর কণ্ঠে নজরুলসংগীতের অসাধারণ পরিবেশন শুনে মুগ্ধ হয়ে যাই। নিজেও নজরুলের গানের দারুণ ভক্ত। তাই স্বভাবতই নীরার কণ্ঠে নজরুলের গান শুনে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মনস্থির করলাম, মেলার সমাপনী অনুষ্ঠান কোনোক্রমেই মিস করা যাবে না। মেলার সমাপনীর শেষ পর্বে দীর্ঘ সময়ের জন্য নজরুলের গানের মালা নিয়ে হাজির হবেন ড. নিরুপমা রহমান। তাই ওইদিন নিজেও নজরুলসংগীতের তিনটি অনুরোধ নিয়ে হাজির হলাম মেলা প্রাঙ্গণে। মেলায় অপেক্ষা করতে লাগলাম ড. নিরুপমার আগমনের জন্য। দূর থেকে দেখতে পেলাম তিনি হালকা আকাশি রঙের জামদানি শাড়ি পরে গাড়ি থেকে নেমে মেলার দিকে এগিয়ে আসছেন। ছুটে গেলাম তাঁর সম্মুখে। অভ্যর্থনার সম্ভাষণ জানিয়ে বললাম, ‘নজরুলসংগীতের একজন ভক্ত হিসেবে আমার তিনটি গানের অনুরোধ আছে।’ সবুজ রঙের চিরকুট তাঁর হাতে দিয়ে পুনরায় জানালাম, ‘তিনটি গানের কলি আছে, গানগুলো গাইলে খুশি হব।’ তিনি ঠিক আছে বলে স্বীকৃতিসূচক মাথা নেড়ে চিরকুটটি নিয়ে চলে গেলেন। তিনটি গানের মধ্যে একটি গানের অনুরোধ রক্ষা করে আমাকে যথেষ্ট খুশি করেছেন। গানটি ছিল, ‘মেঘ মেদুর বরষায় কোথা তুমি, ফুল ছড়ায়ে কাঁদে বনভূমি ॥’
খুব সুন্দর করে গুছিয়ে গুছিয়ে কথা বলেন ড. নিরুপমা। কথা বলার এই আর্ট সবার আয়ত্তে থাকে না। এই কথা বলার নিপুণতা যাদের থাকে, তারা সহজেই মানুষের কাছে তাদের বক্তব্যের মূল বিষয়কে পৌঁছে দিতে পারেন। ড. নিরুপমার মাঝে এই গুণটি আমরা দেখতে পাই বলেই তিনি সুর আর কথার মাধুর্য মিশিয়ে যা নিবেদন করেন, তা সকলের মনগ্রাহী হয়ে ওঠে। অতএব, এ নিয়েই তাঁর শিল্পীসত্ত্বা এবং তাঁর যাপিত জীবনের উদ্্যাপন। অস্ট্রেলিয়ার অভিবাসিত কর্মব্যস্ততার মধ্যে কীভাবে সংগীতকে লালন করেন, এ প্রশ্নের জবাবে প্রায়ই বলে থাকেন, ‘গানটা আমার জীবনাচরণের অংশ। আমি কাজ করতে করতে, রান্না করতে করতে গান গাই। কিংবা ক্লাসের ফাঁকে ক্যাম্পাসে হাঁটতে হাঁটতে বা ড্রাইভ করতে করতে গান গাই। আমি আসলে গান গাই না, গান আমি যাপন করি।’ তিনি যখন নয় বছরের মেয়ে, তখন তার একটি স্মৃতি আমাদের সাথে শেয়ার করেন। সেই কিশোরী বয়সে প্রথম শ্রেণিতে পড়ার সময়ে একবার তাঁর মা-বাবার সঙ্গে পণ্ডিত যশরাজের উচ্চাঙ্গসংগীতের অনুষ্ঠানে যেতে হয়। মা-বাবার সাথে সামনের সারিতে বসে তিনি পণ্ডিত যশরাজের সঙ্গে তাঁদের মতো করে তালের সাথে মাথা নাড়াচ্ছিলেন। এতে উচ্চাঙ্গশিল্পীর মনোযোগ আকর্ষণ করেন। অনুষ্ঠান শেষে একদিন নীরাকে তাঁদের কাছে সংগীতের তালিম নিতে তাঁদের দায়িত্বে ছেড়ে দেওয়ার জন্য অভিভাবকের কাছে অনুরোধ করেছিলেন। মা শিক্ষয়িত্রী ছিলেন বলে শিক্ষা ব্যতিরেকে শুধু সংগীতের জন্য এ প্রস্তাবে রাজি হননি।
সংগীতজ্ঞ নিরুপমা রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি ভাষাতত্ত্বে মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। তবে স্নাতক ডিগ্রি নিয়েছেন যাদবপুর ইউনিভার্সিটি থেকে। তারপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন অধ্যাপনা করে পিএইচডি ডিগ্রির জন্য অস্ট্রেলিয়ায় পাড়ি জমান। সেই দেশের মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটি থেকে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন। বর্তমানে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির কলা ও সমাজবিজ্ঞান অনুষদে শিক্ষকতা করছেন।
প্রত্যেক শিল্পী চান জনপ্রিয় গান গেয়ে জনপ্রিয় হতে। বিখ্যাত হওয়ার প্রবণতা সব শিল্পীর মধ্যে থাকবেÑএটাই স্বাভাবিক। কিন্তু ড. নিরুপমা রহমানের বেলায় তার কিছুটা ব্যতিক্রম দেখতে পাই। তিনি যেহেতু শাস্ত্রীয় সংগীতের ওপর বিশেষভাবে তালিম নিয়েছেন, সেহেতু জনপ্রিয়তাকে অন্য দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখতে চান। তিনি বিশ্বাস করেন, ক্ল্যাসিকাল গানের মধ্যেই সংগীতের চিরায়ত রূপ। তাই ওইসব গানের মাঝে নিজেকে খুঁজে পান। তিনি প্রায়ই বলে থাকেন, ‘আমরা শিল্পীরা গাইলে তবেই না গানের সাথে শ্রোতার পরিচয় ঘটে। অপ্রচলিত গান না গাইলে শ্রোতার কাছে তা পৌঁছাবে কী করে?’ শিল্পী তাঁর বাবার দেওয়া ছোটবেলার একটি উপদেশ সব সময় মনে রাখার চেষ্টা করে থাকেন। তা হচ্ছে, ‘তোমাকে মনে রাখতে হবে, শ্রোতার মন জয় করা শিল্পীর লক্ষ্য, কিন্তু একমাত্র উদ্দেশ্য নয়। শ্রোতাদের মধ্যে নতুন অনুভব, নতুন সৃষ্টির আনন্দ ছড়িয়ে দেওয়া শিল্পীর দায়িত্ব।’ তাই সংগীতজ্ঞ নিরুপমা চেষ্টা করেন তাঁর সুরের সাধনাকে চিরায়ত গানের ভেতর দিয়ে এগিয়ে নিতে।
ড. নিরুপমা রহমানের সংগীতচর্চা তিন বছর বয়স থেকে। প্রথম হাতেখড়ি তিন বছর বয়সে শ্রীমতী স্বপ্না রায়ের কাছে। যখন তাঁর বয়স ছয়, তখন থেকে পণ্ডিত বারীন মজুমদারের কাছে তালিম নিতে শুরু করেন। টানা ১১ বছর তিনি পণ্ডিত বারীন মজুমদারের কাছে সংগীতের শিক্ষা নেন। প্রথম আড়াই বছর তাঁকে কেবল ইমন রাগের ওপর তালিম নিতে হয়েছে। এরপর তালিম নেন বিদূষী দিপালী নাগের কাছে। অনেক বছর তিনি এই বিদূষীর সংস্পর্শে সংগীতের শিক্ষা নেন।
নজরুলসংগীতের বিশিষ্ট শিল্পী ড. নিরুপমা রহমান শাস্ত্রীয় সংগীতজ্ঞ হওয়া সত্ত্বেও নজরুলের গান বেছে নিয়েছেন। কেন নিয়েছেন তার জবাব তিনি নিজেই দিয়েছেন, ‘নজরুলের গান আমাকে সুযোগ দেয় শাস্ত্রীয় সংগীতের অভূতপূর্ব সৌন্দর্যের সাথে বাণীপ্রধান বাংলা গানের জাদুকরি অনুভূতির মেলবন্ধন ঘটানোর। এ এক ভীষণ আনন্দময় প্রাণের খেলা আমার।’
নিউইয়র্কের ৩১তম বইমেলায় সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে আগত ড. নিরুপমা রহমানকে অতিথি শিল্পী হিসেবে আমাদের মেলবন্ধনে
পেয়েছিলাম, তা যেমন আনন্দের তেমনি তাঁকে নতুন করে আবিষ্কার করাটাও আশ্চর্যের। তাঁর সুরেলা কণ্ঠে পরিবেশিত দুই দিনের নজরুলসংগীত বইমেলার সব শ্রোতাকে মুগ্ধতায় বিমোহিত করে রেখেছিল, যা তাঁকে নতুন করে পাওয়ার আলাদা স্বাদ দিয়েছিল। এই নতুন করে পাওয়ার মাঝে তিনি বারবার আমাদের মাঝে আসবেন সুরের মূর্ছনা নিয়ে। বইমেলার উৎসবমুখর আনন্দ আপাতত শেষ হলেও তার রেশ আমাদের মননে রয়ে গেছে। কর্ণকুহরে এখনো অনুরণিত হচ্ছে পণ্ডিত বারীন মজুমদার ও বিদূষী দিপালী নাগের সুযোগ্য শিষ্য ড. নিরুপমা রহমানে গানের কলিগুলো। হয়তো আবার দেখা হবে কোনো বইমেলায় অথবা অন্য কোনো অনুষ্ঠানে। আমরা অপেক্ষায় থাকব।
লেখক : কবি ও কলামিস্ট
নিউইয়র্ক, ৪ আগস্ট ২০২২