নতজানু না হয়ে আত্মমর্যাদার সঙ্গে সংকট মোকাবিলা করাই উত্তম

হরেক রকম খবর। বাহারি বাহারি সব খবর। সব খবরেই চোখ আটকে যাবে। এমন সব খবর যে, যা নিয়ে কিছু লিখতে গেলে মনে হবেÑকোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি। গত ১৮ জানুয়ারি সংখ্যা ঠিকানা। একটি মাত্র সংখ্যা। তার প্রথম পৃষ্ঠায় খবর আছে মোট ১৭টি। সব কটি খবরই আকর্ষণীয় এবং গুরুত্বপূর্ণ। প্রায় সব কটি সংবাদের মধ্যেই গভীর তাৎপর্যও লক্ষ করা যায়। সেই সঙ্গে সরকারি দল বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কৌশল ও ভারসাম্যের রাজনীতির পরিচয়ও মেলে।

বাংলাদেশের কী পরিমাণ অর্থ যে বিদেশে পাচার হয়ে যাচ্ছে, তা লক্ষ করা যায় ‘নিউইয়র্কের অলিগলিতে মন্ত্রী-এমপির বাড়ি’, ‘বিদেশে পাচার হচ্ছে সম্পদ বিক্রির টাকা’, ‘লন্ডনে প্রপার্টির শীর্ষ বিদেশি ক্রেতা বাংলাদেশিরা’ শিরোনামের নিউজগুলোতে। বাংলাদেশের ভেতরে ও বাইরে বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে গভীর তাৎপর্য বহন করে এমন সব খবরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য খবরগুলো হলো, ‘রোগ বুঝে ওষুধ দিচ্ছে আওয়ামী লীগ’, ‘নির্বাচন সামনে রেখে সংঘবদ্ধ হচ্ছে জঙ্গিরা’, ‘সৌদি চাপে সবুজ পাসপোর্ট পাচ্ছে ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা’, ‘লু রোমান্টিসিজমে অন্য খেলা/দিল্লি টু ঢাকা > মূল টার্গেট চীন দমন’, ‘কূটনীতিকদের আনাগোনায় অস্বস্তিতে সরকার’।
এ ছাড়া আরো আছে, সেগুলোকেও গুরুত্বের বাইরে রাখা যাবে না। যেমন ‘অস্থিরতা সৃষ্টিতে অর্থের জোগানদাতা দেশের আমদানি-রফতানিকারকরা’, ‘বিশ্বে বাড়ছে ধনী বাড়ছে দারিদ্র্য’ এবং ‘২০২৩ হবে মন্দার বছর’।

সব পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে এ কথা বলা যায়, শুধু বাংলাদেশ নয়, সমগ্র বিশ্বটাই একটা টানাপোড়েন, অব্যবস্থাপনার মধ্য দিয়ে অতিক্রম করছে। সব দেশের মধ্যেই রাজনীতি ও অর্থনীতির টালমাটাল অবস্থা পরিলক্ষিত হচ্ছে। অনেক কিছুর অভিঘাত নিয়েই এই অবস্থা সৃষ্টি হয়েছে বিশ্বময়। আমেরিকা-চীনসহ আরো কয়েকটি বড় দেশের আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্ব, সেই সঙ্গে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ এবং কোভিড ১৯-এর প্রভাব দেশীয় এবং আন্তর্জাতিক ঘটনা-অঘটনাÑএসব টানাপোড়েনের অন্যতম কারণ। এসব সংবাদের ভেতর দিয়ে এ কথাও স্পষ্ট হয়ে ওঠে, অনেক সরকার নিজেদের স্বাধীনভাবে চলার দাবি করলেও বিদেশিদের অনেক চাপই এড়িয়ে যাওয়া সম্ভব হয়ে ওঠে না। যেমন একটি সংবাদ : ‘সবুজ পাসপোর্ট পাচ্ছে ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা’। এই শিরোনাম থেকে যে কেউ ধরে নিতে পারেন, বাংলাদেশ সরকার স্বেচ্ছায় যেমন তাদের বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছে, তেমনি স্বেচ্ছায় বুঝি তাদের পাসপোর্টও দিয়ে দিচ্ছে! সবই তাদের উদারতা! মানবিক পদক্ষেপ! কিন্তু না, মূল শিরোনামের মাথার ওপরই রয়েছে ‘সৌদির চাপে সরকারের অসহায় আত্মসমর্পণ’।

রাজনীতি এমনই। অনেক সময় মুখে হাসি নিয়ে এমন কথা বলতে হয়, যখন বুকের মধ্যে চলে রক্তক্ষরণ। এই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গা অবস্থান করছে সৌদি আরবে। সৌদির চাপে বাংলাদেশকে এখন ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে সবুজ পাসপোর্ট দিতে হবে। বাংলাদেশ পাসপোর্ট দিতে রাজিও হয়ে গেছে। এ বিষয়ে অভিজ্ঞ ব্যক্তিরা বলছেন, যেভাবেই বলা হোক, রোহিঙ্গাদের এ পাসপোর্ট দেওয়া হলে বিশ্বব্যাপী একটি ভুল বার্তা যাবে, যা আসলে বাংলাদেশি হিসেবেই ওই রোহিঙ্গাদের চাপ নিতে হবে বাংলাদেশকে। স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, সৌদি আরবের রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দেওয়ার বিষয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন অতিরিক্ত সচিবের নেতৃত্বে একটি আন্তমন্ত্রণালয় কমিটি কাজ করছে। কমিটির সদস্যরা একাধিক বৈঠকও করে ফেলেছেন।

এতে সৌদি আরবে থাকা রোহিঙ্গাদের দ্রুত বিশেষ চিহ্ন-সংবলিত পাসপোর্ট দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে সংশ্লিষ্টদের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছে। ইমিগ্রেশন ও পাসপোর্ট অধিদফতর এ সংক্রান্ত কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সৌদি সরকারের চাপ মোকাবিলায় বাংলাদেশের আরো কৌশলী পদক্ষেপ গ্রহণ আবশ্যক ছিল। সে পদক্ষেপ না নিয়ে দেশটিতে অবস্থানরত রোহিঙ্গাদের পাসপোর্ট দিলে তাদের বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে স্বীকার করে নেওয়া হবে। পাসপোর্ট দেওয়া হয়ে গেলে সময়মতো সেই পাসপোর্ট নবায়ন করার বাধ্যবাধকতাও বর্তাবে। বিষয়টির পেছনে রহস্য আরো ঘনীভূত হয়, যখন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে বিষয়টি গোপন রাখতে দেখা যায়।

জানা গেছে, ২০১৯ সাল থেকেই সৌদি আরবে অবস্থানরত ওই ৬৯ হাজার রোহিঙ্গাকে সৌদি আরব সবুজ পাসপোর্ট দেওয়ার জন্য বাংলাদেশের ওপর চাপ দিয়ে আসছে। সৌদি আরব থেকে ওই রোহিঙ্গাদের বাংলাদেশে নিয়ে আসা না হলে সৌদি আরব সে দেশে কর্মরত বাংলাদেশি সব নাগরিককে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়ার হুমকি দিয়ে বাংলাদেশকে কূটনৈতিক পত্রও (নোট ভারবাল) দিয়েছে বলে জানা গেছে। রোহিঙ্গারা যে বাংলাদেশের নাগরিক নয়, তার সব তথ্য-প্রমাণ সৌদি আরবকে দেওয়ার পরও সৌদি সরকারের একগুঁয়ে মনোভাবের কোনো পরিবর্তন দেখা যায় না। তারা চাপ দিয়েই যাচ্ছে।
এখানেই একটি বিষয়, দেশে হোক আর প্রবাসে হোক, সব বাঙালিরই খটকা লাগার কথা।

তাহলে কি যেকোনো দেশ কোনো সুবিধা প্রত্যাহার করে নেওয়ার চাপে রেখে বাংলাদেশকে দিয়ে অনেক সুবিধা আদায় করে নিতে পারে? যা দেশের স্বার্থবিরোধী হবে। এ ছাড়া দেশের কূটনীতিকদের দেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ গোপনে সেরে নেওয়ার প্রবণতা ও প্রয়াসও কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না। এ কথা দেশের মানুষ মনে করতেই পারে, তারা দেশের স্বার্থরক্ষায় যোগ্য এবং বিশ্বস্ত নন।

তাদের কাছে দেশের স্বার্থ কতটা নিরাপদ, তা ভেবে দেখা খুব জরুরি হয়ে পড়েছে।
বিজ্ঞ ও অভিজ্ঞজনেরা বিশ্বাস করেন, বর্তমান আধুনিক বিশ্বে কূটনীতি যুদ্ধের জন্য মারণাস্ত্রের চেয়েও শক্তিশালী। অনেকে এ কথা মনে করেন, বাংলাদেশের আধুনিক কূটনীতি যথার্থ মানসম্মত হলে রোহিঙ্গা সমস্যা ইতিমধ্যে অনেকটাই সমাধানের পথে এগিয়ে যেত। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক এবং বিশিষ্ট কূটনীতি বিশ্লেষক ইমতিয়াজ আহমেদ যথার্থই বলেছেন, ‘যারা রোহিঙ্গা পরিচয়ে সৌদি আরবে গিয়েছিল, তারা পরবর্তী সময়ে কীভাবে বাংলাদেশি পাসপোর্ট পেয়েছে, পাওয়ার প্রক্রিয়া কী ছিল এবং সেটি বৈধ ছিল কি নাÑসেটি দেখতে হবে। সৌদির চাপ মোকাবিলায় আরো কৌশলী পদক্ষেপ নিতে হবে। তাদের আপাতত বাংলাদেশি ট্রাভেল ও ওয়ার্ক পারমিট দিয়ে সৌদি আরবে রাখা যায় কি না, সে জন্য আরো সতর্কতা নিয়ে কূটনৈতিক তৎপতা চালানো যেতে পারে।’

এ কথা প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকেই বলে আসা হচ্ছে যে মাথা ব্যথা হলে মাথা কেটে ফেলে না দিয়ে তার চিকিৎসা করতে হবে। ঠিক সে রকম কোনো সমস্যা এবং সংকটে অসহায় আত্মসমর্পণ তার সমাধান নয়। বরং স্বাধীন দেশের উচ্চতায় উড্ডীন পতাকার মতো উঁচু শিরে দেশপ্রেমে সাহসী হয়ে মেধা ও প্রজ্ঞার সঙ্গে সমস্যার মোকাবিলা করে তা থেকে বের হয়ে আসার পথ খোঁজাই সময়ের দাবি। দেশপ্রেম এবং আত্মমর্যাদায় বলীয়ান হয়ে চলতে পারলে কোনো বাধাই আর বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারবে না।