ঠিকানা রিপোর্ট : কনজারভেটিভ পার্টির নেতা ঋষি সুনাক যুক্তরাজ্যের ৫৭তম প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। গত ২০০ বছরের ইতিহাসে ব্রিটেনের সর্বকনিষ্ঠ প্রধানমন্ত্রী হলেন ৪২ বছর বয়সী ভারতীয় বংশোদ্ভুত ব্রিটিশ এই রাজনীতিক। সাত সপ্তাহের মধ্যে তৃতীয় প্রধানমন্ত্রীর দেখা পেল ব্রিটেন। এক সময়ে যেই ব্রিটেন ভারত শাসন করেছে, এখন সেই ভারতীয় বংশোদ্ভুত একজন দেশটির হাল ধরেছেন। ইতিহাস যেমন তার বৃত্ত পূরণ করে।
‘সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া গ্রেট ব্রিটেনের বারাক ওবামার মুহূর্ত’। ডেমোক্র্যাটিক পার্টির সদস্য ওবামা ছিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রথম আফ্রো-আমেরিকান বংশোদ্ভুত অশে^তাঙ্গ প্রেসিডেন্ট। ২০০৯ থেকে ২০১৭ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্রের ৪৪ তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে দায়িত্ব পালন করেছেন তিনি। তার ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বের সাফল্য শুধু মার্কিনী নয়, তাবৎ দুনিয়ার মানুষের কাছে স্মরণীয় ও অনুকরণীয় হয়ে আছে।
তেমনি ব্রেক্সিট ও করোনা মহামারি পরবর্তী রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের অস্থির সময়ে যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব গ্রহণ করলেন ভারতীয় বংশোদ্ভুত অশে^তাঙ্গ ঋষি সুনাক। ব্রিটিশ অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা আনার অঙ্গীকারের মধ্য দিয়েই দায়িত্ব কাধে নিয়েছেন তিনি। কঠিন এই সময়ে তিনি দেশ পরিচালনায় কতটা সফল হবেন- অদূর ভবিষ্যতই তা বলে দেবে। তবে ব্রিটিশদের ধারণা, বারাক ওবামার মতো ক্যারিশম্যাটিক নেতৃত্বগুণে হয়ত সুনাকও উৎরে যাবেন এই কঠিন সময় এবং ব্রিটেনকে এনে দেবেন এক অভূতপূর্ব সাফল্য।

এর আগে, ব্রিটেনের রাজা তৃতীয় চার্লসের আমন্ত্রণে গত ২৫ অক্টোবর স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ১১টার দিকে বাকিংহাম প্যালেসে যান ঋষি সুনাক। সেখানে রাজা চার্লস কনজারভেটিভ এই নেতাকে দেশের ৫৭তম নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দেন। প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগ পাওয়ার পরপরই রাজা তৃতীয় চার্লসের কাছ থেকে সরকার গঠনের প্রস্তাব পান সুনাক। বাকিংহাম প্যালেসের ১৮৪৪ কক্ষে রাজা তৃতীয় চার্লসের সাথে ঋষি সুনাকের এই বৈঠক হয়।
শুল্ক হ্রাসের পরিকল্পনা ঘিরে তৈরি হওয়া অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়ার দুই মাসের কম সময়ের মধ্যে পদত্যাগে বাধ্য হওয়া লিজ ট্রাসের স্থলাভিষিক্ত হলেন সুনাক।

ব্রিটেনের রাজনীতির ইতিহাসে সবচেয়ে ক্ষণস্থায়ী প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্বে ছিলেন ট্রাস। গত ২৫ অক্টোবর স্থানীয় সময় সকাল ১১টা ৩৫ মিনিটে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন ১০ নং ডাউনিং স্ট্রিট থেকে বিদায়ী ভাষণ দেন লিজ ট্রাস। তার আগে মন্ত্রিসভার সদস্যদের সাথে বিদায়ী বৈঠক করেন তিনি।
১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রথম ভাষণে যা বললেন সুনাক : প্রধানমন্ত্রী হয়েই ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবির জন্য পোজ দেন ঋষি সুনাক। দায়িত্ব নিয়েই তিনি বলেছেন, ‘সবাই মিলে আমরা অবিশ্বাস্য কিছু অর্জন করবো।’
সুনাক দেশ পরিচালানোর জন্য তৈরি জানিয়ে বলেন, রাজনীতির বাইরে গিয়েও তিনি মানুষের ভবিষ্যত ও প্রয়োজন মেটাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবেন।
অর্থনৈতিক সঙ্কটে থাকা ব্রিটেনকে তিনি পথ দেখাবেন বলেও ঘোষণা দেন। সুনাক বলেন, ‘আমি অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা আনবো এবং এটাই হবে আমার সরকারের এজেন্ডার হৃদপিণ্ড। তার মানে হচ্ছে কঠিন সিদ্ধান্ত আসতে যাচ্ছে।’
সদ্য সাবেক প্রধানমন্ত্রী লিজ ট্রাসের ভুল থেকে শিক্ষা নেওয়ার কথাও বলেছেন সুনাক। তার মতে, ‘ট্রাস আসলে ভুল করেননি, তিনিও দেশকে এগিয়ে নিতে চেয়েছিলেন। এটা ছিল মহৎ উদ্দেশ্য। আমি তার অক্লান্ত পরিবর্তন ইচ্ছাকে সম্মান করি।’
সুনাক আরো বলেন, ‘তবে কিছু ভুল হয়েছিল। কিন্তু সেটা অনিচ্ছাকৃত, এখানে কোনো খারাপ উদ্দেশ্য ছিল না।’
ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য কাজ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন সুনাক।

কিভাবে হলেন প্রধানমন্ত্রী : প্রতিদ্বন্দ্বীরা কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের দৌড় থেকে নাম প্রত্যাহার করে নেওয়ায় ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন ঋষি সুনাক। সাবেক প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের পর কনজারভেটিভ পার্টির নেতৃত্বের প্রতিযোগিতা থেকে শেষ প্রার্থী হিসেবে পেনি মর্ডান্টও নাম প্রত্যাহার করে নেন। ফলে ব্রিটেনের ১৯২২ কমিটির চেয়ারম্যান স্যার গ্রাহাম ব্র্যাডি পার্টির পরবর্তী নেতা এবং নতুন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে ঋষি সুনাককে নিশ্চিত করেন।
কে এই ঋষি সুনাক : ব্রিটেনের রাজনীতিতে গত কয়েক বছর ধরেই আলোচনায় আছেন ঋষি সুনাক। ভারতীয় বহুজাতিক তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানি ইনফোসিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা নারায়ণ মূর্তির জামাতা সুনাককে ঘিরে বিতর্কও হয়েছে বিস্তর।
পূর্ব আফ্রিকা থেকে ব্রিটেনে পাড়ি জমানো ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের এক অভিবাসী পরিবারের সন্তান কনজারভেটিভ এই নেতা। ১৯৮০ সালে ব্রিটেনের সাউদাম্পটনে জন্মগ্রহণ করেন সুনাক। সুনাকের বাবা যশবীর ও মা ঊষা দু’জনই ভারতের পাঞ্জাবের বাসিন্দা ছিলেন। পড়াশোনা আর ভালো কাজের আশায় তারা বিদেশে পাড়ি দিয়েছিলেন। যশবীর ব্রিটেনে একজন জেনারেল প্র্যাকটিশনার এবং ঊষা ফার্মাসিস্ট হিসেবে কাজ করেছিলেন।
ঋষি সুনাক উইনচেস্টারের প্রাইভেট স্কুল ও উইনচেস্টার কলেজে পড়াশোনা করেছেন। শিক্ষাজীবনে গ্রীষ্মের ছুটিতে সাউদাম্পটনে ফিরে এক কারি হাউসে ওয়েটার হিসেবেও কাজ করেছেন তিনি। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে দর্শন, রাজনীতি এবং অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করেন।
যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে এমবিএ পড়ার সময় অক্ষতা মূর্তির সাথে পরিচয় হয় তার। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হন তারা। তাদের দুই মেয়ে কৃষ্ণা এবং আনুশকা। এই দম্পতির এক মেয়ে ভারতীয় বিলিয়নিয়ার এবং আইটি পরিষেবা জায়ান্ট কোম্পানি ইনফোসিসের সহপ্রতিষ্ঠাতা।
২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত মার্কিন গোল্ডম্যান স্যাচের বিশ্লেষক হিসেবে চাকরি করেছেন সুনাক।
২০১৫ সাল থেকে ইয়র্কশায়ারের রিচমন্ডের কনজারভেটিভ দলীয় এমপি তিনি। পূর্বসূরি বরিস জনসনের মেয়াদে অর্থমন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের আগে সাবেক প্রধানমন্ত্রী থেরেসা মের সরকারের একজন জুনিয়র মন্ত্রী হয়েছিলেন সুনাক।
ইউরোপ থেকে ব্রিটেনের বহুল আলোচিত বিচ্ছেদ ব্রেক্সিটের সমর্থক ছিলেন তিনি। তিনি বিশ্বাস করেন ব্রেক্সিট যুক্তরাজ্যকে ‘মুক্ত, সুন্দর এবং আরো সমৃদ্ধ’ করে তুলবে।
ব্রেক্সিট ভোটের আরেকটি মূল কারণ অভিবাসন বিধিতে পরিবর্তন আনার কথাও জানিয়েছিলেন তিনি। সুনাক বলেছিলেন, ‘আমি বিশ্বাস করি উপযুক্ত অভিবাসন করা হলে তা আমাদের দেশের জন্য উপকার বয়ে আনতে পারে। কিন্তু আমাদের অবশ্যই সীমান্ত নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।’
ব্রিটেনের প্রয়াত রানির চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক ঋষির স্ত্রী অক্ষতা : ব্রিটেনের নতুন এই প্রধানমন্ত্রীর সম্পদের দিকে তাকালে অনেকেই অবাক হবেন। ২০০১ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত গোল্ডম্যান স্যাচের বিশ্লেষক ছিলেন তিনি। তাকে ব্রিটেনের সবচেয়ে ধনী সংসদ সদস্যদের একজন মনে করা হলেও নিজের সম্পদের ব্যাপারে কখনই প্রকাশ্যে মন্তব্য করেননি সুনাক।
তার স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি ব্রিটেনের প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক। অক্ষতা মূর্তি ভারতের আইটি বাণিজ্যের ধ্রুবতারা নারায়ণ মূর্তির মেয়ে।
সানডে টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কেবল ইনফোসিসেই অক্ষতা-সুনাক দম্পতির অংশীদারত্ব রয়েছে প্রায় সাড়ে ছয় হাজার কোটি টাকার। পেশায় ফ্যাশন ডিজাইনার অক্ষতার অন্যান্য খাতেও বিনিয়োগ রয়েছে।
চলতি বছরের শুরুর দিকে সানডে টাইমস ব্রিটেনের শীর্ষ ধনী ব্যক্তিদের তালিকা প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, ঋষি সুনাকের স্ত্রী অক্ষতা মূর্তি ব্রিটেনের প্রয়াত রানি দ্বিতীয় এলিজাবেথের চেয়েও বেশি সম্পদের মালিক। অক্ষতার সম্পদের তুলনায় অর্ধেকেরও কম সম্পদের মালিক ছিলেন রানি। দ্বিতীয় এলিজাবেথের সম্পদের পরিমাণ ছিল সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকার মতো।
আনন্দে উদ্বেল ভারতীয়রা : প্রথম ভারতীয় বংশোদ্ভূত ঋষি সুনাক ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার খবরে ভারতীয়রা ব্যাপক উচ্ছ্বসিত এবং গর্বিত।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুনাককে টুইটারে অভিনন্দন জানিয়ে লিখেছেন, ‘আমি বৈশ্বিক ইস্যুতে একসঙ্গে কাজ করার এবং রোডম্যাপ ২০৩০ বাস্তবায়নের জন্য উন্মুখ হয়ে আছি। আমরা ঐতিহাসিক সম্পর্ককে আধুনিক অংশীদারিত্বে রূপান্তরিত করার কারণে যুক্তরাজ্যের ভারতীয়দের ‘লিভিং ব্রিজ’-এর জন্য বিশেষ দীপাবলির শুভেচ্ছা।’
ঋষির শ্বশুর ইনফোসিসের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এনআর নারায়ণ মূর্তি প্রথম প্রতিক্রিয়ায় বলেছেন, ‘অভিনন্দন ঋষি! আমরা তোমার জন্য গর্বিত। জীবনে সব রকম সাফল্য পাও, এই কামনা করি। আমরা নিশ্চিত, ব্রিটেনের সব অধিবাসীর জন্য ঋষি সর্বোচ্চ চেষ্টা করবে।’
ভারতের সংসদ সদস্য রাঘব চাড্ডা টুইট করেছেন: ‘আজ, যখন ভারত একটি স্বাধীন দেশ হিসেবে ৭৫তম বছরে দীপাবলি উদ্যাপন করছে, যুক্তরাজ্য একজন ভারতীয় বংশোদ্ভূত প্রধানমন্ত্রী পেয়েছে। ইতিহাস পূর্ণ বৃত্ত আসে।’
নতুন দিল্লির ব্যবসায়ী মনোজ গর্গ বলেন, ‘বহু বছর ধরে যে দেশটি আমাদের শাসন করেছে সেদেশে এখন ভারতীয় ঐতিহ্যের একজন প্রধানমন্ত্রী রয়েছে, এটি ভারতের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত।’
লন্ডনের একটি বিনিয়োগ ব্যাংকের কর্মী চন্দরানা (৪১) বলেন, ‘আমাদের এখন আরো আতশবাজি দরকার। ঋষি সুনাকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া গ্রেট ব্রিটেনের বারাক ওবামার মুহূর্ত। এটি হিন্দু সকলের জন্য একটি গর্বের মুহূর্ত হবে। আমরা আর শুধু একটি সম্প্রদায় নই, আমরা মূলধারার অংশ।’
যা বললেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট : হোয়াইট হাউসে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের দীপাবলি উৎসব উপলক্ষে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ব্রিটেনের নতুন প্রধানমন্ত্রী ঋষির ব্যাপারে বলেছেন, ‘এটা গুরুত্বপূর্ণ’ এবং ‘বেশ চমকপ্রদ’।
মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিসও ভারতীয় বংশোদ্ভূত।
কমলাকে সঙ্গে নিয়ে নির্বাচনী প্রচার চালানোর সময় তার (কমলার) ভারতীয় বংশোদ্ভূত হওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে তুলে ধরেছিলেন বাইডেন। সেই কমলা হ্যারিসও দীপাবলিতে বেশ আনন্দ করেছেন।