হুসনে আরা : আমেরিকার প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২০২০ আগামী ৩ নভেম্বর, মঙ্গলবার। ঐতিহ্য মেনে প্রেসিডেন্ট প্রার্থীদের শেষ বিতর্কও হয়ে গেল অক্টোবর ২২, বৃহস্পতিবার রাত ৯টায় টেনিসির ন্যাশভেলে। বিতর্কের জরিপসহ সব জরিপের ফলাফলই ডেমোক্র্যাট প্রার্থী সাবেক প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার ভাইস প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের পক্ষে। জরিপের ফলাফল যতই অনুকূলে থাক, আত্মতৃপ্তি লাভের সুযোগ নেই। ২০১৬ সালের নির্বাচনে হিলারি ক্লিনটনও সব জরিপে ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে এগিয়ে ছিলেন, কিন্তু কাজ হয়নি।
২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের এমন ফলাফলের পেছনে বড় কারণ হিসেবে একটি কথা জানা যায়। আমেরিকা সভ্যতার সূচকে যতই এগিয়ে থাক, নারীরা তাদের মেধা দিয়ে, অর্জন দিয়ে বিজ্ঞান, রাষ্ট্র পরিচালনা, চিকিৎসাশাস্ত্র, মহাকাশ বিজ্ঞান, রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও মেধার যতই পুরুষের সমক্ষমতা অর্জন করুন, আর পাশাপাশি হাত ধরাধরি করে চলুন- আমেরিকা মেয়েদেরকে এ দেশের প্রেসিডেন্ট, এমন কি ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবেও মেনে নিতে এখনও প্রস্তুত হয়ে উঠেনি।
বিষয়টি আমেরিকার মতো দেশে এই একবিংশ শতকে এসে বিস্ময়কর মনে হলেও কঠিন সত্য। ১৭৮৮ সালের ১৫ ডিসেম্বর, সোমবার, থেকে ১৭৮৯ সালের ১০ জানুয়ারি, শনিবার- আমেরিকার প্রথম প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৭৮৮ সালে গৃহীত নতুন সংবিধানের অধীনে। আমরা সবাই জানি, আমেরিকায় প্রথম প্রেসিডেন্ট জর্জ ওয়াশিংটন নির্বাচিত হন নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। তার সঙ্গে প্রথম ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন জন এ্যাডামস। এরপর নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে অনেক পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। ১৮৪৫ সালে এসে মার্কিন কংগ্রেসের ২৮তম অধিবেশনে ৪ বছর অন্তর নভেম্বর মাসের প্রথম সোমবারের পরিবর্তে মঙ্গলবার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দিন ধার্য হয়।
একটা কথা সাধারণ বোধ বুদ্ধিসম্পন্ন আমরা সবাই জানি যে, নারী-পুরুষ উভয়ের পরিপূরক, আর এই দুইয়ে মিলেই হয় মানুষ। কিন্তু আমেরিকার নারীরা ভোটাধিকার অর্জন করেন ১৭৮৮-৮৯ সালে, অর্থাৎ প্রথম নির্বাচন অনুষ্ঠানের ১৩২ বছর পর, ১৯২০ সালে! আর নারীরা প্রথম ভোটাধিকার প্রয়োগ করে ১৯২১ সালে।
সে সময় আমেরিকার চেয়ে অনেক পিছিয়ে থাকা, এমন কি অনেক পরাধীন দেশেও প্রাপ্তবয়স্ক নারীরা ভোটাধিকার অর্জনতো করেছেনই, অনেক নারী রাজনীতির অঙ্গনেও নেতৃত্বের উজ্জ্বল স্বাক্ষর রেখেছেন। আমেরিকা যেসব দেশকে এখনও অনগ্রসর, পশ্চাৎপদ, রক্ষণশীল, শিক্ষা-দীক্ষায় পিছিয়ে পড়া এবং মৌলবাদী দেশ বলে মনে করে, সেরকম অনেক দেশও নারীদের ভোটাধিকারই শুধু মেনে নেয়নি, তাদের নেতৃত্বকেও স্বাগত জানিয়েছে। বাংলাদেশ, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, ইসরাইলে একাধিক নারী সরকারপ্রধান নির্বাচিত হয়েছেন। অথচ শিক্ষা-দীক্ষা, জ্ঞানে-গুণে, সভ্যতার শীর্ষে অবস্থানকারী দেশ এই আমেরিকার নারীরা ভোটাধিকার লাভ করেন এ দেশের পুরুষের ভোটাধিকার লাভ করার প্রায় দেড়শত বছর পর! অথচ স্বাধীনতার ২৪৪ বছর পরও দেশটি কোন নারী প্রেসিডেন্ট মেনে নিতে প্রস্তুত হয়নি। এ যেন প্রদীপের নিচেই ঘন কালো অন্ধকার!
তবে কোন সমাজই নিজে নিজে প্রস্তুত হয় না। তাকে প্রস্তুত করে তুলতে হয় এবং সে দায়িত্ব সমাজের অগ্রবর্তী মানুষ, আলোকিত সম্প্রদায়কে কাঁধে তুলে নিতে হয়। এক্ষেত্রে নারীদের সোচ্চার হওয়ার পাশাপাশি মানবাধিকারে বিশ্বাসী প্রগতিশীল পুরুষদেরও নারীদের পাশে এসে দাঁড়াতে হবে। সত্যতার দাবিদার, নারী অধিকারে সোচ্চার এই আমেরিকায় প্রতি ১২ সেকেন্ডে একজন নারী তার স্বামী, বন্ধু বা সহকর্মী দ্বারা নির্যাতনের শিকার হয়। এর বিরুদ্ধে মানবাধিকার, নারী অধিকারে বিশ্বাসী বিশ্বাসী নারী-পুরুষ সবাইকে জোট বাঁধতে হবে।
সেই সময় এখন আমাদের সামনে। অতীতে হয়নি বলে বর্তমানেও হবে না, এ কথা ভেবে হাত গুটিয়ে বসে থাকলে আগামী প্রজন্ম আমাদের ক্ষমা করবে না। আমরা আমেরিকান সমাজের প্রাচীন রক্ষণশীল দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের একটি সুযোগ ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের হাতছাড়া করেছি। এবার ২০২০ সালের নির্বাচনে প্রেসিডেন্ট পদে সুযোগ না থাকলেও ভাইস প্রেসিডেন্ট পদে কামালা হ্যারিসকে ভোট দেয়ার সেই সুযোগ আমরা পেয়েছি। কামালা হ্যারিস শুধু একজন নারী বলেই নন, সব বিবেচনায় তিনি একজন দক্ষ, প্রাজ্ঞ, বর্ণবাদবিরোধী এক মানবিক রাজনীতিবিদ। যাকে ভোট দেয়ার মাধ্যমে আমরা শুধু এবারই একজন নারী ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করব না- আগামীতেও একজন দক্ষ নারী প্রেসিডেন্ট লাভের সুযোগও অবাবিত করব। এ দায়িত্ব কোন একক ব্যক্তি বা কোন একক জনগোষ্ঠীর নয়। এ দায়িত্ব আমার, আপনার সব ভোটাদের এবং সব কম্যুনিটি নেতৃবৃন্দের।
সুতরাং সব কম্যুনিটি নেতৃবৃন্দের প্রতি উদাত্ত আহ্বান- পুরুষ ভোটারদের সংগঠিত করার পাশাপাশি নারী ভোটারদেরও উদ্বুদ্ধ করে ভোটকেন্দ্রে নিয়ে তাদের ভোটদানের ব্যবস্থা করবেন। একজন মানুষ, বাঙালি হিসেবে, বাঙালি কম্যুনিটির নেতৃবৃন্দের প্রতি এই বিশেষ আহ্বান।
আমাদের মনে রাখা দরকার, সুযোগ বার বার আসে না, তাই সর্বশেষ প্রত্যাশা ব্যক্ত করতে চাই- আগামী ৩ নভেম্বরের নির্বাচনের পর আমরা যেন আমেরিকার ভোরের আকাশে একটি নতুন সূর্যোদয় দেখতে পাই।
লেখক : প্রাক্তন অধ্যাপক, নটরডেম কলেজ, ঢাকা।
অক্টোবর ২৪, ২০২০, নিউইয়র্ক।