নতুন ম্যাজিকে আ’লীগই থাকছে ক্ষমতায়

বিশেষ প্রতিনিধি : দ্বাদশ জাতীয় নির্বাচনের যাবতীয় হোমওয়ার্ক শেষ সরকারের। কেউ না এলেও নির্বাচনটি হয়ে যাবে। বিএনপির এ নির্বাচন বয়কটের কোনো সুযোগ থাকছে না। হয় অংশ নিয়ে বিরোধী দলে বসা, নয় প্রতিহত করে সক্ষমতার প্রমাণ দেওয়া ছাড়া কোনো বিকল্প নেই দলটির। এরই মধ্যে পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে ছলেবলে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন- ইভিএম কেনার প্রকল্প অনুমোদন ও এর বাজেট চূড়ান্ত করে নিয়েছে নির্বাচন কমিশন। বিরোধী মত ও নাগরিক সমাজের তুমুল বিরোধিতা উপেক্ষা করে সরকারের নির্দেশনামতো কাজটি সেরে ফেলেছে ইসি। যার মধ্যে রয়েছে সরকারের ফের ক্ষমতায় থাকার যাবতীয় নিশ্চয়তা।
আগামীতে সরকার আর ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো একতরফা কিছু করতে পারবে না মর্মে নানান তথ্য, ধারণা-বিশ্লেষণ থাকলেও বাস্তবতা ভিন্ন। বিশ্বজুড়ে কমবেশি স্নায়ুযুদ্ধের এই যুগসন্ধিক্ষণ থেকে বাংলাদেশও মুক্ত নয়। এতে আন্তর্জাতিক খেলা সামনের নির্বাচনে আরো বেশি হবে। ভোট বা জনগণ সেখানে হবে সেকেন্ডারি বিষয়। নির্বাচন কমিশনও এগোচ্ছে সেই রেখাদৃষ্টে। সংলাপে অংশ নেওয়া রাজনৈতিক দলগুলোর ইভিএম বিষয়ে দেওয়া মতামতই নিমেষে বদলে দিয়েছে ইসি।
ইভিএমের সরাসরি বিপক্ষে অবস্থান জানানো দলগুলোকে সরাসরি ইভিএমের পক্ষে দেখানো হয়েছে। ৩৯টি নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে নির্বাচন কমিশন আয়োজিত সংলাপে যোগ দিয়েছিল ২৯টি। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে হাতে গোনা চার দল ইভিএম চাইলেও রোডম্যাপে নির্বাচন কমিশন দিয়েছে আজগুবি তথ্য। বলেছে, সংখ্যাগরিষ্ঠ (২৯টির মধ্যে ১৭টি) রাজনৈতিক দলই কোনো না কোনোভাবে ইভিএমের পক্ষে মত দিয়েছে। বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জাকের পার্টির মতো কিছু দল সংলাপে সরাসরি ইভিএমের বিরুদ্ধে মতামত জানিয়েছিল। অথচ রোডম্যাপে নির্বাচন কমিশন এই দলগুলোকেও ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে। ১৪ দলের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি ইভিএম ব্যবহারের ক্ষেত্রে ‘ভেরিফায়েবল পেপার অডিট ট্রেল’ (ভিভিপিএটি) সংযুক্তির শর্ত দিয়েছিল। এই শর্ত পূরণ না করেই ওয়ার্কার্স পার্টিকে ইভিএমের পক্ষে দেখিয়েছে ইসি।
এর মধ্য দিয়ে সামনের নির্বাচন নিয়ে সরকার এবং কমিশনের বার্তা স্পষ্ট। যেখানে দলের অবস্থানই বদলে দেওয়া হয়েছে, সেখানে ভোট বা নির্বাচনের অবস্থা কী হবে? বিষয়টি পানির মতো পরিষ্কার। রাজনৈতিক দল, জনগণসহ গণতন্ত্রের সঙ্গে নির্বাচন কমিশনের এই ভূমিকাকে প্রতারণা বলা হলেও ক্ষমতাসীনরা একে দেখছে বিশ্বায়ন উপযোগী স্মার্টনেস হিসেবে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা নির্বাচনকে ‘গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা’ বললেও বিশ্বের দেশে দেশে নির্বাচনী ধরন বদলে গেছে। একনায়কেরাও নির্বাচন করে যাচ্ছেন সময়ে সময়ে। বিরোধী মত বা জনগণের এতে আপত্তি থাকলেও কিছু যায়-আসে না। তথাকথিত ওইসব নির্বাচন যথারীতি মেনে নিচ্ছে আন্তর্জাতিক বিশ্ব। উপরন্তু তারা একনায়ক শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতাকে পাকাপোক্ত করতে ভূমিকাও রাখে। মাঝেমধ্যে মানবাধিকার, বিচারবহির্ভূত হত্যা, অরাজনীতি-বিরাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে চাপ দেয়, যা একধরনের আইওয়াশ মাত্র।
আন্তর্জাতিক বিশ্ব এবং শক্তিমান একনায়কদের কাছে বিশেষায়িত এই ভোট সংস্কৃতিতে এগিয়ে যাওয়ার সক্ষমতা জানান দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীনরা একটা কদর তৈরি করেছে। নেতিবাচক হলেও ক্ষমতা-সক্ষমতা প্রশ্নে তা তাদের জন্য ইতিবাচক ফল দিচ্ছে। ভবিষ্যতেও এর সুফলের বিষয়ে আশাবাদী তারা। যার যাবতীয় ইনস অ্যান্ড আউট সম্পর্কে ব্রিফ করা হয়েছে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট সবাইকে। মোনাজাতে মুখ ফসকে যার কয়েক লাইন বলে ফেলেছেন চট্টগ্রামের জেলা প্রশাসক মমিনুর রহমান। জেলা পরিষদ নির্বাচনের এই রিটার্নিং কর্মকর্তা তার সম্মেলনকক্ষে দুর্গাপূজা সামনে রেখে সম্প্রীতি সভায় ‘প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যাতে আবারও ক্ষমতায় আসেন’, সে জন্য সবার কাছে দোয়া চেয়েছেন। মোনাজাতে আওয়ামী লীগ মনোনীত চেয়ারম্যান প্রার্থীর জয় চেয়ে বলেন, শেখ হাসিনাই যেন ক্ষমতায় থাকেন, এ জন্য বিএনপি-জামায়াতেরও দোয়া করা উচিত। কারণ শেখ হাসিনার হাতে ক্ষমতা থাকলে দেশে আওয়ামী লীগ, বিএনপি, জামায়াত সবাই নিরাপদ থাকবে।
মোনাজাতে ফাঁস করে দিলেও নির্বাচনে দায়িত্বপ্রাপ্তদের এ মন-মননেই তৈরি করা হয়েছে। বিশেষ অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে অন্তঃপ্রাণে এগোচ্ছেন তারা। বিনিময়ে ঘটছে সুযোগ-সুবিধাসহ বিশাল প্রাপ্তি, যা বর্তমানরা ক্ষমতায় না থাকলে কল্পনাও করা যেত না। বিশাল অঙ্কের টাকায় ইভিএম কেনাকাটাও তাদের জন্য একটি মেগা প্রণোদনা। যুক্তি হিসেবে বলা হয়েছে, বর্তমানে যে ইভিএম আছে, তা দিয়ে সর্বোচ্চ ৭০ থেকে ৮০টি সিটে ভোট করা সম্ভব। তাই ১৫০টি আসনে নির্বাচন করতে হলে নতুন করে ইভিএম কিনতে হবে বলে ইসির প্রস্তাব অনুমোদিত হ‌চ্ছে।
১৫০টি আসনেই কেন ইভিএম ব্যবহার‌ করতে হবে, তার বাধ্যবাধকতা সম্পর্কে ইসির কোনো গ্রহণযোগ্য জবাব নেই। নতুন করে দুই লাখ এই মেশিন কেনা ও রক্ষণাবেক্ষণ, প্রশিক্ষণ বাবদ ব্যয় ধরা হয়েছে ৮ হাজার ৭১১ কোটি টাকা। প্রতি পিসের দাম ৩ লাখ ৫ হাজার টাকা। সামনে রিভাইজ করে তা আরো বাড়ানোর পথও রাখা হয়েছে।
চলমান অর্থসংকটে সরকারের তরফে কৃচ্ছ্রসাধনের কথা বলা হলেও ইভিএম কেনাকে অতি গুরুত্বের সঙ্গে নেওয়ার রহস্য ওপেন সিক্রেট অনেকের কাছে। কিন্তু সরকার এতে ডেমকেয়ার। কে কী বলল-জানল তা পাত্তা দিতেই নারাজ। সরকারকে জয়ী দেখানোর যত ব্যবস্থা আছে, তার সবই তারা করবেন। অবস্থা এমন জায়গায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, নিরপেক্ষ থাকার নির্দেশ দিলেও মেগা প্রকল্পের মেগা প্রাপ্তিতে তাদের নিরপেক্ষ থাকার জায়গা নেই। ২০১৪ সালে মেজরিটি সংখ্যক সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণা করার আগেই সরকার গঠন করে ফেলেছিল আওয়ামী লীগ। ২০১৮ সালে দিনের ভোট আগের রাতে করে সরকার গঠনের নতুন স্টাইল তৈরি করে আওয়ামী লীগ। ইভিএমের কল্যাণে সামনে যোগ হবে আরেক ম্যাজিক।