বিশ্বচরাচর ডেস্ক : আধুনিক মালয়েশিয়ার রূপকার তিনি। দুই দশকের প্রধানমন্ত্রিত্বের সময়ে মাহাথির মোহাম্মদ তার দেশকে নিয়ে গিয়েছিলেন অনন্য উচ্চতায়। ১৯৫৭ সালে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর থেকে বরাবরই বারিসান ন্যাশনাল জোট মালয়েশিয়ার শাসন ক্ষমতায় থেকেছে। দেশটির গত ছয় দশকের ইতিহাসে কোনো বিরোধী জোট বা দল সে দেশে সরকার গঠন করতে পারেনি। মাহাথিরও ওই জোটের হয়েই দুই দশক প্রধানমন্ত্রিত্ব করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি স্বেচ্ছায় ক্ষমতা থেকে সরে দাঁড়ান। ২০১৮ সালে এসে আবারও ক্ষমতায় ফিরলেন মাহাথির। এবার বিরোধী জোটের হয়ে। বলা হচ্ছে, তার হাত ধরেই মালয়েশিয়া আবার প্রবেশ করবে নতুন যুগে। যে যুগের সামনে চ্যালেঞ্জ অনেক।
২০০৩ থেকে ২০০৯ সাল পর্যন্ত মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন আবদুল্লাহ আহমাদ বাদাউই। তার পরই মালয়েশিয়ার ক্ষমতায় বসেন সদ্য সাবেক হওয়া প্রধানমন্ত্রী নাজিব রাজাক। রাজাককে নিজের উত্তরাধিকার হিসেবে তৈরি করেছিলেন মাহাথির। কিন্তু গত প্রায় এক দশকে তার বিরুদ্ধে নানা দুর্নীতির অভিযোগ ওঠে। বিদেশি বিনিয়োগ অকৃষ্ট করতে একটি বিশেষ তহবিল গঠন করেন নাজিব। কিন্তু এই তহবিলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সেই তহবিল তছরুপের অভিযোগ ওঠে। ওই তহবিল থেকে নিজের পকেটে ৭০ কোটি ডলার পুরার গুরুতর অভিযোগ ওঠে নাজিবের বিরুদ্ধে। সে অভিযোগ অস্বীকার করেন তিনি। নিজের দেশে কোনো রকম অনিয়মের অভিযোগ থেকে আইন করে তাকে অব্যাহতিও দেওয়া হয়। এতে বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে মালয়েশিয়ার সাধারণ মানুষ। নিজের শিষ্যের এমন কর্মকা-ে ক্ষুব্ধ হন মাহাথিরও।
২০১৬ সালে সবাইকে অবাক করে দিয়ে বারিসান ন্যাশনাল জোট ছেড়ে বেরিয়ে আসেন মাহাথির। তখন তিনি বলেছিলেন, সাবেক শিষ্য নাজিবের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে তিনি এতটাই বিব্রত যে তার পুরনো দল ছেড়ে দিচ্ছেন। এ সময় তিনি তৈরি করেন নিজের দল মালয়েশিয়ান ইউনাইটেড ইন্ডিজিনিয়াস পার্টি। যেটি বেরসাতু নামেই বেশি পরিচিত। দলটি পরে যোগ দেয় বিরোধী জোট পাকাতান হারাপানে। এবারের নির্বাচনে মাহাথিরের দল এককভাবে পেয়েছে ২২২ আসনের মধ্যে ১২ আসন। তার জোট পেয়েছে ১২২ আসন যা সরকার গঠনের জন্য প্রয়োজনীয় ১১২ আসনের চেয়ে ১০ আসন বেশি।
চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে নাটকীয়ভাবে ৯২ বছর বয়সে হারাপান পাকাতান জোটের হয়ে প্রধানমন্ত্রিত্ব পদে লড়ার ঘোষণা দেন মাহাথির। সে সময় তিনি বলেছিলেন, জয়ের ব্যাপারে তিনি আস্থাবান, যদি না নাজিব কারচুপি করেন। এরপর ভুয়া খবর নিয়ে নাজিবের সরকার নতুন আইন করে তাকে আটকানোর চেষ্টাও করেছে। তাতেও অবশ্য নাজিবের শেষ রক্ষা হয়নি।
মাহাথিরের জোট নির্বাচনের আগে তাদের যে ইশতেহার ঘোষণা করেছিল, তাতে মানুষের মনে নতুন আশার সঞ্চার করে। আর হারাপান পাকাতান মানেই তো আশার জোট। মাহাথিরের জোট ইশতেহারে বলেছিল, মালয়েশিয়াকে আগামী এক দশকের মধ্যে সবচেয়ে কম দুর্নীতিগ্রস্ত ১০ দেশের তালিকায় যুক্ত করা হবে। এ ছাড়া দুর্নীতিবিষয়ক আরও দুটি গুরুত্বপূর্ণ দফা আছে তার ইশতেহারে। এর একটি হলো, বড় প্রকল্পগুলোর বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করা এবং দুর্নীতি বিষয়ে যারা তথ্য দেবেন, তাদের আইনি সুরক্ষা দেওয়া। মূলত নাজিবের বিরুদ্ধে এই দুর্নীতির অভিযোগ তুলেই নির্বাচনে বাজিমাত করেছেন মাহাথির। এই দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে আনা মাহাথিরের জোটের জন্য এখন অন্যতম চ্যালেঞ্জ।
মাহাথিরের জোট নির্বাচনী ইশতেহারে আরও উল্লেখ আছে- দরিদ্রদের চিকিৎসাসেবায় ভর্তুকি দেওয়া হবে, ন্যূনতম মজুরি ৫০ শতাংশ বাড়ানো হবে, ১০ লাখ নতুন হাউজিংয়ের ব্যবস্থা করা, উন্নয়ন বাজেটের অর্ধেক আগামী তিন বছর ধরে দরিদ্র ৫ অঞ্চলে ব্যয় করা এবং পণ্য ও সেবার ওপর থেকে বিভিন্ন ট্যাক্স বা শুল্ক উঠিয়ে দেওয়া ইত্যাদি। এ জনবান্ধব ইশতেহারই গত ছয় দশক রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা ধরে রাখা বারিসান ন্যাশনালকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেয়।
মাহাথিরের সামনে আরেক চ্যালেঞ্জ হলো তার সময়কার উপপ্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিমকে প্রধানমন্ত্রিত্বের পদে বসানো। সামাজিক-অর্থনৈতিক সংস্কারের ডাক দেওয়ায় দুর্নীতি ও সমকামিতার অভিযোগে আনোয়ারকে ১৯৯৯ সালে জেলে পুরেছিল মাহাথিরের সরকার। পাঁচ বছর তিনি জেলে আটকে ছিলেন সমকামিতার ভিত্তিহীন অভিযোগে। এরপর থেকে আনোয়ারই মালয়েশিয়ার রাজনীতিতে প্রধান বিরোধী রাজনীতিকের ভূমিকা পালন করতে থাকেন। এই আনোয়ারকেই নিজের জোটের জন্য হুমকি হিসেবে দেখতেন মাহাথির।
২০১৩ সালে শক্ত নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বী আনোয়ারকে আবারও নাজিব সরকার গ্রেফতার করে। কিন্তু মাহাথির যখন বিরোধী জোটে যোগ দিলেন, তখন এই আনোয়ারকে জেলে পোরার প্রায়শ্চিত্ত করার কথা বলেছিলেন। আগামী দুই বছর পর আনোয়ারের হাতে প্রধানমন্ত্রিত্ব ছেড়ে দিয়ে সেই প্রায়শ্চিত্ত করতে চান তিনি। এটিও মাহাথিরের জন্য অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ।
এরই মধ্যে মালয়েশিয়ার রাজা আনোয়ার ইব্রাহিমকে মুক্তি দেওয়ার ব্যাপারে রাজি হয়েছেন। ফলে মালয়েশিয়া আগামী দিনে আরও একজন নতুন নেতাকে দেখবে। যাকে গত প্রায় দেড় দশক ধরে মনে করা হচ্ছে মালয়েশিয়ার ভবিষ্যৎ নেতা। সূত্র : বিবিসি ও দ্য স্টার।