রওশন হাসান
বৈশাখের আবির্ভাবে প্রকৃতি যেন সাড়াময় রুদ্ররূপে। পুরাতন জীর্ণতাকে ত্যাগ করে নতুনের বারতায় প্রতিধ্বনি তুলে প্রকৃতি ও মানুষ নববর্ষকে প্রতিবছর বরণ করে নেয়। সেই প্রেরণায়
কবি রবীন্দ্রনাথ বৈশাখকে আহবান করে উদাত্ত কন্ঠে বলেন :
“এসো হে বৈশাখ
তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
মুছে যাক গ্লানি ঘুচে যাক জ্বরা
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।”
যেকোন সংস্কৃতি একটি জাতির ঐতিহ্যের দর্পণ, যে দর্পণে প্রতিফলিত হয় সামগ্রিকভাবে গণমানুষের চিন্তা-চেতনা, জীবন ও মূল্যবোধ। একটি জাতির আচার-আচরণ, পোশাক-আশাক, খাবার, সম্প্রীতির আদানপ্রদান থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনের সঙ্গে পরিপূরক যে চেতনা তার ভিন্ন নামই সংস্কৃতি। একটি জাতি, তার নিজস্ব পরিচয়ে অন্য দেশ, জাতির কাছে বিকশিত হয়। এই বিকাশের সঙ্গে জাতির উত্থানজনিত সম্পর্ক। পৃথিবীর কোনো জাতিই তার নিজের সংস্কৃতি ব্যতীত নিজস্ব ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করতে পারেনি। সংস্কৃতি জাতির জন্য একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
বৈশাখের সঙ্গে মুখর হয় বাঙালি সংস্কৃতির নিদর্শন বৈশাখি মেলা । বাঙালি খুঁজে পায় তাদের জাতি সত্ত্বার উৎস । পহেলা বৈশাখে বৈশাখী মেলায় বাঙালিয়ানা পূর্ণতা পায়। দল-মত-বর্ণ নির্বিশেষে দেশে ও বিদেশে পহেলা বৈশাখ উদযাপনে সার্বজনীন উৎসবের যে রূপ আমরা দেখতে পাই, বৈশাখী মেলা সেই রূপকে ব্যাপ্ত ও পরিপূর্ণভাবে প্রকাশ করে। গ্রামীণ সমাজে বৈশাখী মেলা গ্রামের বিভিন্ন পেশার মানুষদের জীবিকা নির্বাহকে কেন্দ্র করে অন্যতম মাধ্যম এবং গ্রাম্যজীবনের আনুষঙ্গিক দ্রব্য-সামগ্রির ক্রয়বিক্রয়ের মহা উৎসবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যুগে যুগে জনপ্রিয়তা ও ব্যাপ্তি লাভ করেছে। মাটির গহনা, আলতা, চুড়ি, শাড়ি, বায়োস্কোপ, নাগরদোলা, পুতুলনাচ, বাউলগান, পুঁথিপাঠের আয়োজনে গ্রামবাসীদের আনন্দ উদযাপনের ক্ষেত্র এই নতুন বছরের মেলা। পরবর্তীতে এই মেলা নাগরিক জীবনে প্রবেশের মাধ্যমে মেলার উপকরণ ও উদযাপনে ভিন্নতা এসেছে। শহুরে জীবন পহেলা বৈশাখে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। বতর্মানে ঢাকার রমনার বটমূলের বৈশাখী মেলার অনুরূপ আয়োজন সমগ্র দেশে উদযাপিত হয়ে থাকে। ইদানিং বৈশাখী মেলা ইলিশ পান্তায় সীমাবদ্ধ না থেকে নানাবিধ পিঠা ও ঝাল-মিষ্টি খাবারের আয়োজনে মেলা প্রাঙ্গন মুখরিত থাকে। নানারকম পোশাক, ফেস্টুন, মুখোশ, অলংকার, ফেস পেইন্টিং, গান, নৃত্য মেলার আকর্ষণ হিসেবে অন্তর্ভূক্ত থাকে।
নববর্ষের ইতিবৃত্ত হিজরি সন থেকে ধরা হয়। তুর্কী বিজয়ের পর বঙ্গদেশে হিজরী সনের প্রারম্ভে চান্দ্রবর্ষের দিন ও মাস প্রতি ৩৩ বছরে একবার করে আবর্তিত হয়। যেমন রমজান মাসের রোজা, শীত, গ্রীষ্ম, বর্ষা সকল ঋতুতেই ঘুরে আসে। চান্দ্রমাস বা হিজরী সনের দিন ও মাস নির্দিষ্ট ঋতু বা ফসল তোলার মৌসুমে স্থির না থাকায় খাজনা তোলার নির্দিষ্ট তারিখের সঙ্গে ফসল তোলার সময়ের হেরফের হয়ে যায়। তাই ৯৬৩ হিজরী সনে (১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দ) ভারতবর্ষে সম্রাট আকবরের শাসনামলে খাজনা আদায়ের লক্ষ্যে প্রজাদের ফসল তোলার সময়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে ফসলী সন হিসাবে বাংলা বর্ষপঞ্জী সৃষ্টি করা হয়। সম্রাট আকবরের উপদেষ্টা আমীর ফতেউল্লাহ সিরাজীর হিজরী সনের চান্দ্র বছরের হিসেবের পরিবর্তে সৌরবর্ষের হিসাব সংযোজন করে বাংলা সনের উদ্ভাবন করেছিলেন।
বাঙালি সংস্কৃতিতে বাংলা কবিতায় বৈশাখ এক গুরুত্বপূর্ণ ঐতিহ্য সংযোজন। যুগে যুগে বাঙালি কবিকুল বৈশাখকে ঘিরে রচনা করেছেন সাহিত্য। জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে গদ্য-পদ্য, ছড়া, গান, গল্পে বৈশাখের প্রতি ভালোবাসা নিবেদন করেছেন। ধ্বংস-সৃষ্টি, বিরহ-মিলন, সুখ-দুঃখ, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি স্থান পেয়েছে সাহিত্যে। ঋতু ভিত্তিক বৈশিষ্ট্যগুলো সহজেই সাহিত্যিকদের আলোড়িত করে, বিভিন্ন বিষয়ে লিখতে কবিদের অনুপ্রেরণা যোগায়। সম্রাট আকবরের সময় থেকে খাজনা আদায়ের মাস বৈশাখ থেকে নববর্ষ গণনা শুরু হলেও বর্তমানে তা বাঙালির প্রাণের উৎসবে পরিণত হয়েছে। বৈশাখী অনুভূতি কবি মুকুন্দরাম চক্রবর্তীর কলমে প্রকাশ পেয়েছে এভাবে:
‘‘বৈশাখে অনলসম বসন্তের খরা।
তরুতল নাহি মোর করিতে পসরা
পায় পোড়ে খরতর রবির কিরণ।’’
একদিকে বৈশাখের ধ্বংসরূপ, পাশাপাশি নতুন বছরের আগমন সৃষ্টিকে নতুনরূপে উৎসাহিত করে। বৈশাখের মতোই রুদ্র, অশান্ত, বিপ্লবী, বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। বৈশাখের আগমনে মুক্তির উল্লাসে তিনি বৈশাখ বন্দনা করেছেন। কাব্যিক ব্যঞ্জনায় দৃপ্তকণ্ঠে তিনি উচ্চারণ করেন
“ঐ নতুনের কেতন ওড়ে কাল বৈশাখীর ঝড়
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
তোরা সব জয়ধ্বনি কর
ধ্বংস দেখে ভয় কেন তোর
প্রলয় নতুন সৃজন বেদন
আসছে নবীন জীবন ধারা অসুন্দরে করতে ছেদন।’’
জীবনান্দ দাশ একজন প্রকৃতি-নিমগ্ন কবি। তাঁর কবিতার অনুভূতি ব্যাপক ও আবেগময় । তিনি লিখেছেন-
‘‘ঘুমিয়ে পড়ব আমি একদিন
তোমাদের নক্ষত্রের রাতে
শিয়রে বৈশাখ মেঘ সাদা
যেন কড়ি শঙ্খের পাহাড়।’’
পল্লীকবি জসীম উদ্দীন বৈশাখী নতুন শস্যের আগমনী গান গেয়েছেন এভাবে:
‘‘বোশেখ শেষে বালুচরের বোরো ধানের ধান
সোনায় সোনা মিলিয়ে দিয়ে নিয়েছে কেড়ে প্রাণ’’
আবহমান কাল থেকে এক মহা উৎসবে বাঙালি উদযাপন করে বাংলা নববর্ষ। পূর্বে বছরান্তে বর্ষবিদায় এবং নববর্ষকে বরণ করার উৎসব শুরু হতো বছরের শেষ দিন বা তার আগের দিন থেকে। যেমন, চৈত্রসংক্রান্তি, বিজু, প্রভৃতি। নতুন জীবনের প্রত্যাশা, খাজনা আদায়, ব্যবসার নতুন খাতা খোলা এবং প্রজাদের মনোরঞ্জন ও ব্যবসার খদ্দের-লক্ষ্মীদের আপ্যায়ন সৃংস্কৃতির উল্লেখযোগ্য উৎসব ছিলো। এর জন্য বিশেষভাবে বছরের প্রথম দিনটিকে বেছে নেয়া হতো। এভাবেই বাংলা নববর্ষ বাঙালির ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ বিশেষ দিন হিসেবে পালিত হয়ে আসছে । জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে বাংলার সকল অধিবাসী এই উৎসবের সমান অংশীদার। এ উৎসবের বৈশিষ্ট্য হলো মানুষে মানুষে সৌহার্দের বন্ধন সৃষ্টি করা ও সংস্কৃতির প্রতি অনুরক্তি প্রকাশ করা । প্রাচীন ঐতিহ্য ও নানা উত্থান-পতনের মাত্রিকতায় নববর্ষে একটি মৌলিক ঐক্য পরিলক্ষিত হয়। তা হলো নবজন্ম, পুনরুজ্জীবনের ধারণা, পুরনো জীর্ণ এক অস্তিত্বকে বিদায় জানিয়ে নবীন এক জীবনের মধ্যে প্রবেশ করার আনন্দানুভূতি। ইংরেজ কবি লর্ড টেনিসন নতুন বছরকে স্বাগত জানিয়ে বলেছেন:
“Ring out the old, ring in the new,
Ring, happy bells, across the snow:
The year is going, let him go;
Ring out the false, ring in the true”.
-কবি, লেখক, নিউইয়র্ক।