সৈয়দ মামুনুর রশীদ
নিউইয়র্কের অভিবাসনে বর্তমানে বাংলাদেশিদের সংখ্যা কত হবে, তা কেউই সঠিক করে বলতে পারবে না। অবৈধভাবে বসবাসকারীর সংমিশ্রণের কারণে সঠিক তথ্যের যোগফল মেলানো কঠিন হলেও আনুমানিক হিসাবে হাফ মিলিয়ন তো হবেই। সমগ্র যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারীর হিসাব একত্র করলে হয়তো দেড় মিলিয়নে দাঁড়াবে। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে আমেরিকায় পাড়ি জমাই। আমার মেজো ভাই স্টুডেন্ট ভিসায় এসেছেন ১৯৬৮ খ্রিষ্টাব্দে। এর অনেক অনেক আগ থেকে আমাদের ভূখণ্ডের মানুষেরা জীবিকার প্রয়োজনে এসেছেন এই মার্কিন মুলুকে। প্রসঙ্গক্রমে উপরিউক্ত কথাগুলো লেখার কারণ আজকের অভিবাসনের মধ্যে তখনকার অভিবাসনের সাংস্কৃতিক জীবনের অনেক তারতম্য রয়েছে। বাংলাদেশিদের প্রবাসজীবন নিয়ে বড় করে লেখার উদ্দেশ্য না নিয়ে লেখার বিষয়টিকে বাঙালিপনায় এ সময় আর সে সময়ের প্রেক্ষাপটে সংবাদমাধ্যম হিসেবে ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র যুগান্তকারী ভূমিকার কথা তুলে ধরার চেষ্টা।
বর্তমানে নিউইয়র্ক থেকে অনেকগুলো সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হচ্ছে। আজ থেকে তিন যুগ পেছনের দিকে চোখ ফেরালে দেখতে পাওয়া যাবে বাংলা পত্রিকা ছিল শূন্যের কোঠায়। যদিও তখন সৈয়দ মোহাম্মদ উল্লাহ সম্পাদিত ‘প্রবাসী’ নামে একটি বাংলা পত্রিকা পাক্ষিক হিসেবে প্রকাশিত হতো। পত্রিকাটির নিয়মিত প্রচার ও প্রসারের গতি মন্থর ছিল বলে অধিকাংশ বাঙালির কাছে পৌঁছাত না। ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দ থেকে ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ৯ বছর জ্যাকসন হাইটসে বসবাস করে নিজেই এর সাক্ষী হয়ে আছি। বাংলা পত্রিকা পড়ার জন্য হন্যে হয়ে ঘুরতাম জ্যাকসন হাইটসের গ্রোসারিগুলোতে। গ্রোসারি স্টোর বলতে ‘পাটেল ব্রাদার্স’ ও ‘দানাবাজার’ নামে মাত্র দুটি স্টোর ছিল, যেখানে কদাচিৎ বাংলা পত্রিকা পাওয়া যেত। নব্বই দশকে কম্পিউটার প্রযুক্তির অবস্থান আজকের মতো সহজ ও গতিশীল না থাকার কারণে পত্রিকা ছাপার কাজ ছিল অত্যন্ত কষ্টের ব্যাপার। তখন দক্ষ বাংলা কম্পোজিটর পাওয়া অনেকটা দুঃসাধ্য ব্যাপার ছিল। কেননা আশির দশক থেকে নব্বই দশকে নিউইয়র্কে বসবাসরত বাংলাদেশির সংখ্যা নিতান্তই কম ছিল বলেই সব কাজের প্রফেশনাল লোকের সংকট ছিল।
১৯৯০ খ্রিষ্টাব্দের বছরটি ছিল নিউইয়র্কের প্রবাসী বাঙালিদের জন্য এক আশাব্যঞ্জক, আশাজাগানিয়ার বছর। বাঙালি কমিউনিটিতে মন্থর গতিসম্পন্ন চলমান সাংস্কৃতিক পরিবেশে ঝড়ের গতিতে আবির্ভূত হলো সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’। পত্রিকার স্বত্বাধিকারী এম এম শাহীন সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘ঠিকানা’ যখন অভিবাসনে বাঙালির জীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে দেখা দিল, তখন নিউইয়র্ক তথা সমগ্র উত্তর আমেরিকায় তা আলোড়ন সৃষ্টি করে। অচিরেই ‘ঠিকানা’ পিপাসু পাঠকের মন জয় করে নিতে লাগল। যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে বসবাসরত অভিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তাদের অনেকেই গ্রাহক হয়ে পত্রিকাটি সংগ্রহ করতে লাগলেন। আজ থেকে ৩০ বছরের আগে বিজ্ঞানের প্রযুক্তি অতি ধীরগতিসম্পন্ন সময়ের মধ্যে আজকের মতো সংবাদ ও সাহিত্যের লেখালেখি সংগ্রহ করা অনেক কষ্টের ব্যাপার ছিল। প্রবাসজীবনে বাঙালিয়ানার অনুভূতিময় স্বাদকে পাঠককুলে পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে ‘ঠিকানা’ কর্তৃপক্ষের প্রতিটি পদক্ষেপ ছিল সাহসী ও যুগোপযোগী। যার কারণে সব বাধা-বিপত্তিকে উপেক্ষা করে পত্রিকাটি প্রবাসী বাঙালিদের মনে বিশেষ স্থান অর্জন করতে সক্ষম হতে পেরেছিল। যুক্তরাষ্ট্রের অঙ্গরাজ্যগুলোতে বিচ্ছিন্নভাবে ছিটিয়ে থাকা অজ্ঞাত লেখকগোষ্ঠী ‘ঠিকানা’ পত্রিকার মাধ্যমে কালি ও কলমের আঁকড়ে বন্ধুত্বের মেলবন্ধন গড়ে তুলতে লাগল। সংবাদপত্রের মাধ্যমে অভিবাসীরা জানতে পারল কোথায় কী হচ্ছে বা কী হবে? পত্রিকার বিজ্ঞাপনগুলো ছিল বাংলাদেশি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানগুলোর প্রচার ও প্রসারের এক উল্লেখযোগ্য মাধ্যম। নব্বইয়ের দশকে ওপি-ওয়ান, ডিভি-ওয়ানপ্রাপ্ত ভিসাসহ বিভিন্ন পথে মাইগ্র্যান্ট হয়ে বাংলাদেশিদের উল্লেখযোগ্য হারে যুক্তরাষ্ট্রে আগমন প্রেস মিডিয়ার শক্তির সহায়ক হয়ে ওঠে। যার ফলে পরবাসে বাঙালি কমিউনিটি একদিকে যেমন বড় হতে লাগল, তেমনি বাংলা সংস্কৃতিচর্চার আঙিনাও ক্রমাগত সম্প্রসারিত হতে লাগল। বিশেষ করে, বাংলাদেশি মালিকানাধীন গ্রোসারিগুলো শহরের আনাচ-কানাচে ছড়িয়ে পড়লে ‘ঠিকানা’ পত্রিকাও ওইসব গ্রোসারি স্টোরে অনায়াসে স্থান পেতে লাগল। সেই নব্বইয়ের দশকে অনলাইনে বাংলা পত্রিকা পড়ার কোনো সুযোগ ছিল না। ছিল না আজকের মতো ফেসবুক, স্মার্টফোন; যা পৃথিবীকে হাতের মুঠোয় এনে দিয়েছে। তখনকার পাঠকসমাজের একমাত্র পত্রিকা পড়ার ভরসা ছিল ওইসব গ্রোসারি স্টোর। স্বচক্ষে দেখেছি ‘ঠিকানা’র স্বত্বাধিকারী ও সম্পাদক এম এম শাহীন তাঁর ভাইদের নিয়ে দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী জেগে পত্রিকা অফিসে কাজ করে, ছাপাখানা থেকে পত্রিকা নিয়ে ডেলিভারি দিতে সোজা চলে গিয়েছেন গ্রোসারি স্টোরগুলোতে। ঘূর্ণিঝড়, তুষারঝড়, গ্রীষ্মের তপ্ত দহন উপেক্ষা করে এম এম শাহীন তাঁর প্রাণের চেয়েও প্রিয় পত্রিকা পাঠককুলের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানোর আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে গিয়েছেন। তাঁর নিরলস পরিশ্রম বৃথা যায়নি। বুদ্ধিমত্তাকে কাজে লাগিয়ে উত্তর আমেরিকার ভূখণ্ডে অভিবাসীদের জন্য একটি পত্রিকা প্রতিষ্ঠার সাফল্য এনে আজ তার ৩৩তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর মাহেন্দ্রক্ষণের অনাবিল আনন্দকে পাঠকসমাজের সঙ্গে উপভোগ করতে পারছেন।
সময়ের সঙ্গে সবকিছু বদলে গিয়েছে এখন। বদলেও যাবে হয়তো অনেক কিছু। নিউইয়র্ক থেকে অনেকগুলো বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয় এখন। প্রবাসীদের সংখ্যাও এখন অনেক। তবে বিজ্ঞাপনদাতার সংখ্যা সীমিত। আর এই সীমিতকে নিয়েই কিছুটা কাড়াকাড়ি আছে বৈকি! বিজ্ঞাপন নিয়ে সংকট চরমে না গেলেই ভালো। ভালো বলছি এ জন্যই, বিজ্ঞাপনের জোরেই পত্রিকারগুলো বেঁচে রয়েছে বলেই বিনা মূল্যে পত্রিকাগুলো পাই এবং যারা লেখালেখি করি তারাও এ সুযোগের সদ্ব্যবহার করে থাকি। মসজিদে গেলে দেখতে পাই নামাজান্তে প্রায় সবার হাতে বাংলা সংবাদপত্র। দেখতে আরো ভালো লাগে, যখন বয়োজ্যেষ্ঠদের হাতে পত্রিকা দেখি। অনলাইনের বিশ্বায়নের যুগে আমাদের যুবসমাজ এ ক্ষেত্রে পড়ায় অনীহা দেখালেও বয়স্করা ঠিকই পড়েন। কর্মহীন অবসরজীবনে তারা অধিকাংশ সময় পড়ার মধ্যে অতিবাহিত করেন। তাই হার্ড পেপারে মুদ্রিত সংবাদপত্রগুলো অধিকাংশ হারে হয়তো অগ্রজরাই পড়ে থাকেন এবং থাকবেন। কেননা অনলাইনে পড়াকে তারা সহজ স্বভাবের মধ্যে মেনে নিতে পারেন না। বয়োজ্যেষ্ঠদের অনেকেই আছেন, যারা পত্রিকার প্রথম পৃষ্ঠা থেকে শেষাবধি পড়ার জন্য কোনো লাইনই বাদ রাখেন না। আজ ‘সাপ্তাহিক ঠিকানা’র ৩৪তম বর্ষে পদার্পণের লগ্নে দাঁড়িয়ে কেবলই মনে হয়, পত্রিকার এই সুদীর্ঘ অতিক্রান্ত পথ প্রবাসজীবনের প্রতিচ্ছবি হয়ে যে ভূমিকা রেখে চলেছে, তা যেন সুবর্ণজয়ন্তীর পথেও অব্যাহত থাকে।
-লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক। নিউইয়র্ক, ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩