নর্থ আমেরিকা টু নর্থবেঙ্গল : ওপারে গুডবাই সেলিম ভাই…

সালেম সুলেরী :

মৃত্যুর ঠিক দেড় মাস আগের কাকতালীয় ঘটনা। ঢাকা থেকে ফোনে কথা বলছিলাম নিউইয়র্কে। খ্যাতিমান সংগঠক নার্গিস আহমেদ এবার নর্থবেঙ্গল সফর করবেন। হঠাৎই প্রশ্ন করে বসলেন-
সেলিম ভাই কেমন আছেন? অনেক অনেক দিন কোনো যোগাযোগ নেই। অথচ নব্বইয়ের দশকে ম্যানহাটনে পাশাপাশি অফিসে বসতাম। লাঞ্চব্রেক বা অন্য সময়ে অনেক আড্ডা দিয়েছি। সেই মানুষটি হঠাৎ বাংলাদেশের নর্থবেঙ্গলে চলে গেছেন। সেখানে নাকি একাধিক প্রতিষ্ঠান করেছেন। ওনার কোনো খবর কি জানেন, সুলেরী ভাই?

বললাম, কিছুটা তো অবশ্যই জানি। প্রথমত উনি আমার মামাতো বোনের স্বামী। বড় মামার বড় মেয়ে মালিহা সুলতানা। অনিন্দ্যসুন্দরী সেই বোনটির ডাকনাম ‘বিথী’। ঢাকার পশ্চিম রামপুরায় আমার মামার বাড়ি, অ্যাপার্টমেন্ট। ভাড়াটে হিসেবে থাকতে থাকতে সেলিম-বীথি প্রেম। অতঃপর বাড়িওয়ালার সুন্দরী মেয়ের সঙ্গে বিয়ে-সংসার।

নার্গিস আপা প্রশ্ন করেন, তাহলে উনি আপনার ভগ্নিপতি। জানতাম না তো বিষয়টি, কেউ বলেনি। ম্যানহাটনে ট্রাভেল এজেন্সিতে বসতেন, আমিও তা-ই। ঢাকায় বিয়ে করেছেন শুনেছি, বউ এনেছেন কিছুটা বিলম্বে।

বললাম, ওনার আরেকটি না-জানা পরিচয় আছে। নিউইয়র্কে ‘নর্থবেঙ্গল ফাউন্ডেশনে’র প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি হাসানুজ্জামান হাসান। ঢাকায় আমাদের ‘সন্দ্বীপ ভবনে’ স্পোর্টস সাংবাদিক ছিল। প্রবাসী আবার দেশের একাধিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালক। সাংগঠনিক কাজকর্মে আপনারা অতীব ঘনিষ্ঠ। সেলিম ভাই হচ্ছেন এই হাসানের জ্যেষ্ঠ ভ্রাতা।

সমাজকন্যা নার্গিস আপা বিস্ময় প্রকাশ করলেন। বললেন, আসলে সেলিম ভাই নিভৃতচারী মানুষ। নিজেকে প্রকাশই করতে চান না, ফলে কিছুই জানি না। প্রবাস থেকে গিয়ে দেশে কী কী করেছেন তিনি?

বললাম, তিনটি বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানের উদ্যোক্তা। নীলফামারীতে ‘অংকুর সিড অ্যান্ড হিমাগার লি.’। এরপর রংপুরের মিঠাপুকুরে আরেকটি বিশাল হিমাগার। নাম : ‘অংকুর স্পেশালাইজড কোল্ড স্টোরেজ লি.’। তৃতীয়টি ‘ব্রিং লেদার প্রোডাক্টস লি.’। উত্তরবঙ্গে বাংলাদেশের বৃহত্তর জুতা প্রস্তুত-রপ্তানিকারক প্রতিষ্ঠান। ৩০ জন কর্মকর্তা-কর্মচারী, কর্মী প্রায় ১৫০০ জন। রংপুরের তারাগঞ্জ উপজেলার গনিরামপুরে চলছে কর্মযজ্ঞ।

নার্গিস আহমেদ নিউইয়র্কস্থ ‘বাংলাদেশ সোসাইটি’র সাবেক সভাপতি। ২০০৭-এ সাড়ে ১২ হাজার ভোটে বিজয়ী প্রথম নারী সভাপতি। ২০১৯-এর নিউইয়র্ক ফোবানা সম্মেলনের সফল আহ্বায়কও। সুবিশাল ‘নাসাউ কলিশিয়ামে’ সম্মেলনÑবাঙালি কমিউনিটির না-ভাঙা রেকর্ড। প্রবাসে বাঙালি সংস্কৃতির বিকাশে আজীবন ভূমিকা রেখে চলেছেন। ‘তিন বাংলা’ বিশ্বসংগঠনের তিনি ইউএসএ সভাপতি। ফেব্রুয়ারি-মার্চে ঢাকা-রংপুর-পশ্চিমবঙ্গ সফর করবেন। জানতে চাচ্ছিলেন নর্থবেঙ্গলে কি সেলিম ভাইয়ের সাক্ষাৎ মিলবে?

ভারী কণ্ঠে বললাম, সেটি অনিশ্চিত, আপু। জানলে অবাক হবেন, উনি এখন নিউইয়র্কেই। সস্ত্রীক অবস্থান করছেন লং আইল্যান্ড এলাকায়। শারীরিকভাবে ভীষণ অসুস্থ বলে জানি। প্রোস্টেট ক্যানসারের রোগী, চিকিৎসা নিচ্ছেন আমেরিকায়। দীর্ঘ প্রবাসজীবন ছিল বিশ্বের রাজধানী নিউইয়র্কে। মাঝে শিল্পোদ্যোক্তা হিসেবে বাংলাদেশে কাটালেন। অবহেলিত উত্তরবঙ্গে শস্যভান্ডার গড়ার কান্ডারি ছিলেন। ব্যাপক সংখ্যক কর্মসংস্থানের প্রামাণ্য নিবেদক। ঢাকার শুলশানে প্রশান্তিযাপনের অ্যাপার্টমেন্ট। নিউইয়র্কে জ্যাকসন হাইটসের অ্যাপার্টমেন্টটিও মানবশূন্য। সামাজিকভাবে কারও সঙ্গেই আর সংযোগ রাখেন না। আমরা নিকটাত্মীয়রাও ওনার শতভাগ খবর জানি না।
নার্গিস আপার আকস্মিক প্রশ্ন, উনি কি জাতীয় পার্টি করতেন?

প্রথম জীবনে কিছুটা করেছেন, শেষ জীবনে নয়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ছিলেন জাহাঙ্গীর মহিউদ্দিন। সাবেক রাষ্ট্রপতি জে. এইচ এম এরশাদের শ্যালক। সেই জাহাঙ্গীর ভাইয়ের ঘনিষ্ঠ ছিলেন সেলিম ভাই। কিছু পেশাগত কাজও করেছিলেন ওনার অধীনে। যুক্তরাষ্ট্র জাতীয় পার্টির দীর্ঘমেয়াদি সভাপতি ছিলেন মাহবুব আলী বুলু। উনিও সেলিম ভাইয়ের ন্যাংটোকালের বাল্যবন্ধু। উভয়েরই পৈতৃক বাস নীলফামারী জেলাসদরে। সাক্ষাৎ হলেই ‘তুই-মুই’ আঞ্চলিক সম্বোধনে কথা বলতেন। এমন সম্প্রীতির কারণে সেলিম ভাইকে অনেকে ‘জাপা’ ভাবতেন।

না, জাপার পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গেও সংযোগ নেই সেলিম ভাইয়ের। হৃদয়ে রোদন নিয়েই রণে ক্ষান্তি দিলেন নার্গিস আপা। বললেন, আপনি ঢাকা থেকে নিউইয়র্ক আসুন। যেভাবেই হোক সাক্ষাতের একটা ব্যবস্থা করবেন। যেহেতু উনি নিজেই নিভৃতে থাকছেন, তাতে অন্য চেষ্টা বৃথা।

জি, অবশেষে সব চেষ্টাই বৃথা হলো। ঢাকায় আমি নিজেও অসুখকাল পার করছিলাম। ঠান্ডায় ‘সাইনাস ইনফেকশন, সর্দি-কাশিতে কাবু। তার পরও আরেক মামাতো ভাই খালিদ মাহমুদকে ধরলাম। ওর বরাতেই সর্বশেষ খবর নিলাম। একদা সেলিম ভাইয়ের প্রতিষ্ঠানসমূহে সে সম্পৃক্ত ছিল। জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহে জানালÑপরিস্থিতি ভয়াবহ। ক্যানসারের আক্রমণে ‘লং আইল্যান্ডে’র হাসপাতালে কাতরাচ্ছেন সেলিম ভাই।

২৩ জানুয়ারি ’২৩, সোমবার সন্ধে রাত। অসুস্থ আমাকে দেখতে এসেছিল সহোদর প্রকৌশলী দিলু-দম্পতি। নৈশভোজের সময়ে হঠাৎ নিউইয়র্কের ফোন। লোকসংগীত উৎসব-খ্যাত নূর ইসলাম বর্ষন-এর ভারী কণ্ঠ। শুরুতেই বলল, একটা দুঃসংবাদ আছে। মুখ ফসকে বললাম, সেলিম ভাই কি চলেই গেল। আমার আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করল না?

বললেন, না, কারও জন্যই আর অপেক্ষা করল না! আমাদের সঙ্গেও অনেক দিন দেখা-সাক্ষাৎ হলো না।

ফোন রাখা মনে তখন স্মৃতিকাঁপনের ছায়াচিত্র। চার-পাঁচ বছরের সিনিয়র ছিলেন সেলিম ভাই। আমি ওনাকে নীলফামারীর বাড়িটিতে খুব কমই পেয়েছি। ভীষণ ভালো সম্পর্ক ছিল পুরো পরিবারের সঙ্গে। নীলফামারীর বাবুপাড়ার বাড়িতে অনেক গিয়েছি। অনেক স্নেহ দিয়েছেন প্রয়াত পিতা মোসলেমউদ্দিন প্রামাণিক। খালাম্মা হাসিনা বেগম না খেয়ে উঠতে দিতেন না। ছোট মেয়ে মিনি ছিল আমার স্ত্রীর শ্রেণিবন্ধু। অপরপক্ষের সন্তান মশিয়ূরও ছিল আমার শ্রেণিবন্ধু। আর সুপরিচিত হাসানুজ্জামান হাসান নানাভাবে ঘনিষ্ঠ। আশির দশকে আমি সন্দ্বীপ ভবনে নির্বাহী সম্পাদক। হাসান সক্রিয় স্পোর্টস রিপোর্টার। এরপর অন্যান্য মিডিয়ায় সাংবাদিকতা করেছে। পরে আমেরিকায় গিয়ে সেলিম ভাইসহ যৌথ ব্যবসা জমিয়েছে। ‘বিশাল’ নামে প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে করেছে কনস্ট্রাকশন, রিকনস্ট্রাকশনের কাজ।

দুটি বিষয়ে সেলিম ভাই আমাকে ধন্যবাদ জানিয়েছিলেন। ২০০৬-এ ‘ঠিকানা’র কর্ণধার এম এম শাহীনকে ওনাদের বাড়িতে নেওয়ায়। সেবার ‘আব্বাসউদ্দিন সম্মাননা’ পেয়েছিলেন শাহীন ভাই। বৃহত্তর রংপুরের নীলফামারীর ডোমারে অনুষ্ঠানাবলি। সুরসম্রাট আব্বাসউদ্দিনের শ্বশুরালয় ডোমারে গিয়েছেন, থেকেছেন। শিল্পীপুত্র মুস্তাফা জামান আব্বাসী, আসমা আব্বাসী পদক তুলে দেন। সেবার শাহীন ভাই একটি বিশেষ ঘটনা ঘটালেন। নীলফামারী সদরের নিউইয়র্ক প্রবাসীদের বাড়িতে গেলেন। রাজনীতিক মাহবুব আলী বুলু, প্রকৌশলী সানু খান। চাকরিজীবী নাজমুল হাবুল, ‘অবকাশ’-খ্যাত হোসেইন রানা। গিয়েছিলেন ‘বিশাল কনস্ট্রাকশন’-খ্যাত এম সেলিম, হাসানদের বাড়িতেও।
মূলত শাহীন ভাইয়ের আগ্রহে আমি সবার বাড়িতে নিয়ে যাই। প্রবাসীরা কেউ তখন দেশে বা বাড়িতে ছিলেন না। তবে বাবা-মা, অগ্রজ, অনুজ, গৃহবধূরা শতভাগ আনন্দ পেয়েছিলেন। নিউইয়র্কে বসেই জানতে পারেন ‘ঠিকানা-প্রধান’ তাদের পৈতৃকবাসে। আমি একটি হৃদছোঁয়া প্রামাণ্য প্রতিবেদন লিখেছিলাম। সেবার অন্যদের পাশে সেলিম ভাই জানিয়েছিলেন সবিশেষ ধন্যবাদ।

২০০৯-এ বাংলাদেশে ফিরে কোল্ড স্টোরেজ গড়েন তিনি। উত্তরবঙ্গের এক সম্মানিত এমপিসহ সেটি সফর করি ২০১১-তে। সেলিম ভাই তখন প্রজেক্ট এলাকা নীলফামারীতে নেই। ব্যাংকের কাজে ঢাকায় অবস্থান করছিলেন। আমার সফর সংবাদ শুনে ফোনে বিশেষ ধন্যবাদ দেন। বলেন, তোমার এই উদ্যোগ আমাদের অনুপ্রাণিত করবে। বিশেষ করে, সম্মানিত এমপি সাহেবও প্রকল্পটি দেখলেন। মনে হলো আমাদের সকল প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

অনেক কিছু করার ছিল শিল্পোদ্যোক্তা সেলিম ভাইয়ের। নর্থ আমেরিকা থেকে ফিরে নর্থবেঙ্গলে থিতু হয়েছিলেন। কিন্তু অসুখের ছায়াপথে পাড়ি দিলেন মৃত্যুর মায়াপথ। নার্গিস আপাকে সাক্ষাৎকরণের কথা দিয়ে রাখতে পারলাম না। অবহেলিত নর্থবেঙ্গলকেও সেলিম ভাই কথা দিয়েছিলেন। শিল্পোন্নয়ন, কর্মসংস্থান বৃদ্ধির কথা। আশা করি বীথি’পা, হাসানুজ্জামান হাসানরা তা প্রতিপালন করবে।
প্রিয় শহর নিউইয়র্কেই জানাজা ও সমাধিস্থ হলেন। ‘ওয়াশিংটন মেমোরিয়াল’ বৃষ্টিস্নাত দুপুরে কমিউনিটির নিকটজনদের সমাবেশ। অনেকের অভিযোগ, বেশ তাড়াহুড়োর মধ্যে শেষকৃত্য কেন? নিভৃতে থাকা অনেকে শেষ শ্রদ্ধার সুযোগ পাননি। যদিও অধিকাংশজন একান্তে শুভকামনা জানিয়েছেন। সেলিম ভাইয়ের বিদেহী আত্মা স্বর্গশান্তি পাক, একান্ত প্রত্যাশা।

ঢাকা, জানুয়ারি ২০২৩।