জর্জেস মোহাম্মদ :
আজ রাত, সেই ভয়ংকর রাত। ভাদ্রের নরপিচাশে খাওয়া চাঁদ, পূর্ণ অমাবস্যার রাত। নষ্ট চন্দ্র রাত। এক আঁধার রাতের উৎসব। গাঁয়ের ডানপিটে ছেলেদের উৎসব। হতে হবে ভরা অমাবস্যার রাত। গাঢ় অন্ধকার। পিচাশের দল নেমে আসে ঝাঁকে ঝাঁকে ভূমিতে। খুঁজে বেড়ায় যত প্রকার খারাপ, পচা, দুর্গন্ধ। এই পিচাশের ভয় মিলিয়ে একটা বীভৎস মধ্যরাত। আর এই রাতেই যদি হয় ঘন বৃষ্টি। বৃষ্টি শেষে গাছ, পাতা, বুড়ো গাছের রক্তমাখা চাহনি যেন আরও বীভৎস। নষ্ট চন্দ্র উৎসবের মূল উদ্দেশ্যই হলো চুরি করা এবং আনন্দ উপভোগ করা। যত সাহসীই হোক, যৌবনের রক্ত যত গরমই হোক, চুরির ভয় কমবেশি সবাই পায়। ভগবান শ্রীকৃষ্ণও ননি চুরির সময় ভয় পেয়েছেন। না হয় গোপনে করেছেন কেন? ভয়কে জয় করা কঠিন কাজ। দাগী চোরের বেলায়ও তা-ই। নষ্ট চন্দ্রের চোরেরা শৌখিন চোর, আর শৌখিন চোরের ব্যাপার-স্যাপার বোঝা কঠিন। প্রতিটি উৎসবের মজা ভিন্ন। হিন্দু সমাজব্যবস্থায় বারো মাসে তেরো পার্বণ, আর নষ্ট চন্দ্র তার মধ্যে নয়। মুসলমানদের দুই উৎসব বড়ই ধুমধাম। খ্রিষ্টানদের বড়দিন, ইস্টার, বাকিগুলো গণ্য নয়। অতি নগণ্য। অনেকগুলোই সামাজিক প্রথা মাত্র। আর ব্যবসায়িক কারণ। হেলুয়িন ধর্মীয়ভাবে কতটুকু প্রযোজ্য, তা প্রশ্নবিদ্ধ। ধর্ম বা ধর্মীয় উৎসব নিয়ে যত কথা বলা হবে, ততই ভ্রান্তির দিকে নিজেকে ঠেলে দেওয়া হবে। এপ্রিল ফুলও নাকি ধর্মীয় উৎসব। তবে মাটির জন্মদিনকে কীভাবে পালন করা হবে?
সকল উৎসবের আয়োজন একটু আগেই করা হয়। সুন্দরভাবে সম্পন্ন করাই উদ্দেশ্য। নষ্ট চন্দ্র রাতের চুরির পরিকল্পনা সাধারণত হয়ে থাকে গ্রামের প্রতিবেশীদের আচার-ব্যবহার যাচাই করে। বিশেষত কৃপণ লোকদের ওপর নষ্ট চন্দ্র ভার বেশি পড়ে। যে বাড়ির ঝুনা নারিকেল চুরি করা হবে, সেই বাড়ির মানুষ অযথা প্রতিবেশীর সঙ্গে ঝগড়া করে, নষ্ট চন্দ্র চোরদের সঙ্গে নয়। বাদল শেষে আঁধার রাতে ওই বাড়ির অলস কুকুরগুলোর প্রতিও খেয়াল রাখতে হয়। অলস হলেও কেঁউ-কেঁউ ঘেউ-ঘেউ করবে না, এমন কোনো কথা নেই। ভেজা জঙ্গলে মা মনোষার দলবল বেশি আনাগোনা করে। মূলত খাদ্যের সন্ধানে। কে জানে কোথায় লুকিয়ে ঝোপঝাড়ে।
সাব্যস্ত হলো নীরব বাবুর গাছের নারিকেল চুরি করা হবে। দিনেই অতি গোপনে যাচাই করা হলো, কত লম্বা দড়ি লাগবে। কত লম্বা গাছ। কাঁটাতারের বেড়া, খেজুর কাঁটা পাতা আছে কি না? গাছে ব্লেড বসানো আছে কি না? গাছে আবার ব্লেড কী? গাছে শেভিং ব্লেড ভেঙে দুই ভাগ করে পুঁতে দেওয়া হয়। সহজে কেউ দেখতে পায় না। গজাইল, পেরেক লাগালে সহজে দেখা যায়। আর খেজুর কাঁটা বসানো অনেক পুরোনো পদ্ধতি। চোরেরা সাধারণত লুঙ্গি কাছা দিয়ে গাছে ওঠে। পায়ে পাখি ব্যবহার করে না। মুখে একটা আর হাতে দুইটা নারিকেল নিয়ে নামতে হয়। তাই হাতের বাজুর ওপর ভর দিয়ে আর পায়ের রানের ওপর চাপ দিয়ে নামতে হয়। যদি গাছের গায়ে ধারালো ব্লেড পোঁতা থাকে, রান আর হাতের অবস্থা শেষ। কাটা ঘা না শুকানো পর্যন্ত কাজকর্ম বন্ধ। বন্ধুরা দেখলেই বলবে নানা কথা। ধুপ করে মাটিতে ফেলা যাবে না, দড়ি-কাঁচি নিয়েই নামতে হয়। কাকপক্ষীও জানবে না।
আজকাল নীরব বাবুর একটা পেখনা হয়েছে, সমাজসেবা করে। সমাজসেবা বললে ভুল হবে, প্রকৃতিসেবা। বায়ুদূষণমুক্তকরণ প্রকল্প। উত্তম কাজÑসবাই প্রশংসা করে। জেনে আর না জেনে। মূলত গাছ সবাই পছন্দ করে। নীরব বাবুর পেখনা হলো, যে গাছগুলো গাঁয়ের ছেলেমেয়েদের বয়সে বড়, ওই গাছগুলোকে সালাম-প্রণাম করতে হবে। যদি কেউ প্রশ্ন করে, গাছ তাদের বয়সে বড় কি না কী করে বুঝবে? একটাই উত্তরÑযাহা জন্মের পর থেকে দেখে বড় হয়েছ, তাহারাই তোমার বয়সে বড়। সালাম-প্রণাম করো। দিনে ও রাতে ফুল দেয়, ফল দেয়, বায়ু দূষণমুক্ত করে। গাঁয়ের বয়স্কদের যদি সালাম-প্রণাম করা যায়, তবে বয়োবৃদ্ধ গাছটিকে নয় কেন? সে তো মানুষের চেয়ে বেশি কাজ করে। বিনা অভিযোগে। নীরব বাবুর ভাবখানা এ রকম, যেন সমাজসেবার ঠিকাদারি নিয়েছেন। অসহায় মেয়েদের বিয়ে দিতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের বোঝাতে হবে শিক্ষাই জাতির মেরুদণ্ড। সবই যেন নীরব বাবুর দায়িত্ব। সব কাজই নীরবে করে যান, কখন কীভাবে করবেন কেউই জানে না, তবে হয়ে যায়। হঠাৎ এসব কাজের উদ্দেশ্য কী? মানে মানবসেবার উদ্দেশ্য। তবে কি তার এক পা শ্মশানঘাটে, আরেক পা পাকা কলার বাকলার ওপর? যেকোনো সময় পিছলে পড়ে সোজা স্বর্গবাস। রাম-নাম-সত্য-হোক। নিজেও সমাজসেবা করেন আর গ্রামের ছেলেমেয়েদেরও মাটির দেনামুক্ত করার উপদেশ দেন। এই বয়সে উপদেশ শুনতে সবারই অপছন্দ। চামে চামে বেটা হিন্দু-মুসলমান বাদ দিয়ে মানবধর্মের দীক্ষা দেয়। নীরব বাবুর সমাজসেবার পরীক্ষা নেওয়ার জন্যই সিদ্ধান্ত, এবার তারই গাছের নারিকেল চুরি হবে।
কানন বাবুর পাঁঠা। প্রতিবছর দুর্গাপূজার আগে কানন বাবু পাঁঠা কিনে থাকেন। চারটি পাঁঠা। এ-বাড়ির আম পাতা ও-বাড়ির কাঁঠাল পাতা খাওয়ানো হয়। বাঁকা শিংয়ে কটু তেল মালিশ করা হয়, পাঁঠার লম্বা দাড়িতে তেল দেওয়া হয়। পাঁঠা তো আর জানে না তাকে বলি দেওয়া হবে। বলি হবে ধর্মীয় উৎসাহ-উদ্দীপনার সঙ্গে। দূরদূরান্ত থেকে দুর্গা মায়ের দর্শন লাভে পুণ্যার্থীরা আসে। বাঘবশমানিনী মা। দশমী পর্যন্ত থাকে কেউ কেউ। বেশির ভাগ লোকেরই সাংসারিক পিছুটান নেই। কেউ আবার বিকেলে আসে, রাতে ফিরে যায়, নিজের কাজকর্ম শেষ করে। তবে দশমীর দিন অনেক লোক হয়। প্রতিমা বিসর্জনের কান্নাচোখে ঘরে ফিরে যায়। সবকিছুর আয়োজন করেন কানন বাবু ও তার পরিবার। পরিবার বলতে আর কেউ ছিল না। শুধু কোমরে ব্যথাওয়ালা স্ত্রী। কোমরের ব্যথায় উঠোনও ঝাড়ু দিতে পারে না। ব্রাহ্মণের বউ, তাই ছোটখাট অনেক কাজ প্রতিবেশীরাই করে দেয়। কেউ অন্নের উদ্দেশ্যে, কেউ স্বর্গের পথ পরিষ্কার করে। যার দোষ আছে তার গুণও আছে। ধর্মের দিকে তার অনেক আগ্রহ, পালনও করেন। জমিজমার বিষয়ে দোষ একটু বেশি। পেশায় জমির দলিল লেখক, আইনে বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়ন না করেও জমির আইনে মহাপণ্ডিত। এই আইনের পিতামহ। গ্রামে কার কতটুকু জমি আছে, কোনটা খাস, কে ওয়ারিশÑসবই তার জানা। পৈতা বাঁধা নথি, অনেকের দীর্ঘশ্বাস। ওই নথিতেই কানন বাবুর খেলা। তার একটা বড় গুণ ছিল। সেই গুণ রাজা রামমোহন রায়কেও হার মানিয়েছে। ব্রাহ্মণ হয়েও নাপিতের মেয়েকে সন্তান হিসেবে লালন-পালন করতেন। এটাকে পালক কন্যা বলা চলে না। কারণ মালতি বেশির ভাগ সময় নিজের ঘরেই কাটাত, কানন বাবু নাপিত মহাশয়কে নিজের ভাটায় ঘর করে দিয়েছেন। একেবারে পাশাপাশি ঘর। পালক মেয়েকে যত আদর করে পালন করা হোক না কেন, নিজের মা-বাবা ছেড়ে থাকা কানন বাবুর পছন্দ নয়। খাওয়ার সময় পাশাপাশি বসে খায়। একই পাত্রে হাত ধোয়। একই গামছায় মুখ মোছে। নাপিতের মেয়ে, ব্রাহ্মণের মেয়ে সেজে যায়। মালতির অনেক দম্ভ। ধোপার ছেলেকে ছোট জাত মনে করে। নমঃ পাড়ায় যায় না। কোমল শিশুর মনে জাতভেদ শক্ত হয়ে উঠেছে। শুধু কানন বাবুর নামে। পৃথিবীর কেউ জানে না নিজের জাত কী। জন্মের পরে যা শেখানো হয়, তা-ই জাত আর ধর্ম। মালতির দাম্ভিক ব্যবহারের গুণেই এবার চোখ পড়েছে কানন বাবুর একটি পাঁঠার দিকে।
ছোট পাঁঠাটিই আজ বলি হবে। অতি সহজে ছোট পাঁঠা কোলে নিয়ে পালানো সম্ভব। দু-তিনবার ভ্যা করার আগেই দৌড়ে কালীখোলা যেতে হবে। কালীখোলা মা কালীর মন্দিরের পেছনেই। অং ধন মনস্তত্ত্ব, অং শিব শম্ভু, বাবা ভোলানাথÑপাঁঠা বলি। কারও গাছের পেঁপে, কারও গাছের কুমড়া, কারও গাছের নারিকেলÑএই মিলিয়ে পাঁঠার মাংস। আহা অতি সুস্বাদু। সাথে কচি কচি ছোট ছোট শসা যোগ দেয়। সব কাজ শেষ হতে হবে মসজিদে ফজরের আজানের আগেই। সবকিছু পরিষ্কার। পাঁঠার চামড়া, নাড়িভুঁড়ি লুকিয়ে রাখা হলো মালতিদের পুকুরঘাটের পাশেই কচুরিপানার নিচে, যে পুকুরে মালতিরা বাসনকোসন ধোয়। কয়েক দিন পরে পচে ফুলে উঠলেই দেখবে। ঘেন্না ঘেন্না করে ওই পুকুরের পানি ব্যবহার বন্ধ। পরের দিন কানন বাবু খোঁজ করেন প্রিয় ছোট পাঁঠাটি। হ্যারে, তোরা কি আমার ছোট পাঁঠাটি দেখেছিস? না, কাকা বাবু। মনে মনে বলে, দেখব কী করে, সে তো হজম হয়েছে প্রায়! বাকিটুকু মালতিদের ঘাটের জলে। নষ্ট চন্দ্র এক আনন্দ রাত। গ্রামের ছেলেদের সামাজিক বন্ধন।