রেভারেন্ড ফাদার স্ট্যানলী গমেজ :
৮ মার্চ আন্তর্জাতিক নারী দিবস। এই দিনে আমাদের সকল মা, আত্মীয়া, শিক্ষিকাসহ সকল নারীকে অভিনন্দন, শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা জানাই। এই দিবসের উদ্দেশ্য, তাৎপর্য ও গুরুত্বকে স্মরণে রেখে আমাদের করণীয় দায়িত্ব পালনে আমরা সংকল্পবদ্ধ।
সকল খ্রিষ্টানের কাছে নারীর স্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যে নারী, যে মা সেই কৃতিত্বের পুরোধা-অধিকারিণী, তিনি হলেন যিশুখ্রিষ্টের মা মারিয়া। পবিত্র বাইবেলের নবসন্ধির (New Testament) সাধু মথি (১:১৮-২৪) ও লুক (১:২৬-৩৮) রচিত মঙ্গল সমাচার (Gospel) এবং পবিত্র কোরআন শরিফের ১৯তম সুরা ‘মরিয়ম’-এ হজরত ঈসা (আ.) নবীর জন্ম সম্বন্ধে উল্লেখ আছে, মহাদূত গাব্রিয়েল কুমারী মারিয়াকে দর্শন দিয়ে বলেন, ‘প্রণাম তোমায়। পরম আশিষধন্যা তুমি। প্রভু তোমার সঙ্গেই আছেন। … ভয় পেয়ো না, মারিয়া। তুমি পরমেশ্বরের অনুগ্রহ লাভ করেছ। শোনো, গর্ভধারণ করে তুমি একটি পুত্রের জন্ম দেবে। তাঁর নাম রাখবে যিশু। তিনি মহান হয়ে উঠবেন, পরাৎপরের পুত্র বলে পরিচিত হবেন। প্রভু পরমেশ্বর তাঁকে দান করবেন তাঁর পিতৃপুরুষ দাউদের সিংহাসন। যাকোব বংশের ওপর তিনি চিরকাল রাজত্ব করবেন; অশেষ হবে তাঁর রাজত্ব।’ মারিয়া তখন দূতকে বললেন, ‘তা কী করে হবে? আমি যে কুমারী।’ উত্তরে দূত বললেন, ‘পবিত্র আত্মা এসে তোমার ওপর অধিষ্ঠান করবেন, পরাৎপরের শক্তিতে আচ্ছাদিত হবে তুমি। তাই এই যাঁর জন্ম হবে, সেই পবিত্রজন ঈশ্বরের পুত্র বলেই পরিচিত হবেন। … কারণ পরমেশ্বরের অসাধ্য কিছুই নেই।’ মারিয়া তখন বললেন, ‘আমি প্রভুর দাসী! আপনি যা বলেছেন, আমার তা-ই হোক!’ স্বর্গদূত তখন তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিলেন। মারিয়া, বিশ্বাসপূর্ণা এই নারীর সম্মতির (fiat) জন্যই যিশুখ্রিষ্টের জন্ম সম্ভব হয়েছে। তাই খ্রিষ্টধর্মের শুরু থেকেই নারীর গুরুত্ব অপরিসীম। এই বিষয়টি নিয়ে ধর্মতাত্ত্বিক অনুধ্যান করলে, অর্থাৎ ধর্মবিশ্বাস ও তার অনুশীলন, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও তথ্য এবং ধর্মীয় দর্শন ও যুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে আমরা যা অনুধাবন করতে পারি, তা হলো প্রথম মানব-মানবী আদম ও হবা (first man and woman Adam and Eve) এদেন উদ্যানে (Garden of Eden) থাকাকালে সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বরের অবাধ্য হয়ে নিষিদ্ধ গাছের ফল খেয়ে পাপ করে এদেন উদ্যান থেকে বহিষ্কৃত হন (Paradise lost)। এই অবাধ্যতাই মানবজাতির প্রথম পাপ (original sin), যা এসেছিল প্রথম নারী হবার কারণে। পরম করুণাময় ও ক্ষমাশীল সৃষ্টিকর্তা ঈশ্বর মানবকুলকে পাপের অন্ধকার থেকে উদ্ধার করতে পুত্র যিশুকে মর্ত্যে প্রেরণ করলেন একজন নারীর মধ্য দিয়ে-নবসৃষ্টির (Anno Domini) নতুন হবা (New Eve) মানব মুক্তির ঐশ্ব পরিকল্পনায় পুরোপুরি বাধ্য হয়ে (আমি প্রভুর দাসী! আপনি যা বলেছেন, আমার তা-ই হোক!) নিজ গর্ভে ত্রাণকর্তা যিশুকে ধারণ করলেন। সে জন্যই মারিয়া নারীকুলে ধন্যা এবং সকল নারীর জন্য অনুসরণীয়া এক মহান মানবী। তাঁর জন্যই মানবকুল যিশুখ্রিষ্টের মাধ্যমে পাপরাশি থেকে ধৌত হয়ে আবার সেই এদেন উদ্যানে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজে পেল (Paradise regained)।
পবিত্র বাইবেলের প্রাক্তন সন্ধিতে (Old Testament) উল্লেখিত মহীয়সী নারীদের মধ্যে প্রথম মানবী হবা, এরপর আব্রাহামের স্ত্রী সারাহ ও হাগার, যাকবের স্ত্রী রেবেকা, যোসেফের স্ত্রী রাখেল ও লিয়া, মোশির বোন মিরিয়াম, বিচারকর্ত্রী দেবোরাহ, রানি এস্থার, রুথ ও তাঁর পুত্রবধূ নাওমি প্রমুখ তাঁদের স্বীয় ধর্মীয় বিশ্বাস, পারিবারিক ভালোবাসা, সমাজের প্রতি দায়িত্ববোধের কারণে আজ অবধি সবার কাছে সম্মানিতা ও অনুকরণীয় ব্যক্তিত্ব হয়ে আছেন। তেমনিভাবে পবিত্র বাইবেলের নব সন্ধিতে (New Testament) উল্লেখিত সম্মানীয়া নারীদের মধ্যে যিশুখ্রিষ্টের মা মারিয়া সর্বপ্রথম ও প্রধান স্থানে থাকবেন চিরকাল। এর পরে যারা চিরসম্মানীয়া ও অনুপ্রেরণাদাত্রী হিসেবে আছেন, তাঁরা হলেন মাগ্দালেনার মারিয়া, মৃত্যু থেকে জীবন পাওয়া লাজারুসের দুই বোন মার্থা ও মারিয়া, প্রধান শিষ্য পিতরের শাশুড়ি, নাম না-জানা সামারীয় জলকূপের আলোকিত হৃদয়ের সেই মহিলা, যিশুর কাপড়ের এক প্রান্ত স্পর্শ করে রক্তস্রাবের অসুস্থতা থেকে আরোগ্য হওয়া নারী, মৃত্যু থেকে জীবন ফিরে পাওয়া শাস্ত্রী জায়রাসের কিশোরী কন্যা, ক্লোপাসের স্ত্রী মারিয়া, যিশু ও প্রেরিত শিষ্যদের সাহায্যকারিনী লিডিয়া ও প্রিসিলা প্রমুখ নারীগণ। এই মহীয়সী নারীরা তাঁদের বিশ্বাস, আশা ও ভালোবাসা দিয়ে খ্রিষ্টধর্ম প্রচারে ও পালনে খ্রিষ্টবিশ্বাসী পুরুষ-নারী সবার কাছেই অনন্যা দৃষ্টান্ত হয়ে আছেন বিগত দুই হাজার বছর ধরে।
যিশুখ্রিষ্টের ঐশ্ববাণীতে দীক্ষিত হয়ে এবং মানবকল্যাণে ব্রতী হয়ে যুগে যুগে বহু পুরুষ-নারী তাঁদের জীবন উৎসর্গ করেছেন পরের তরে। তাঁদের কর্ম-কীর্তির নিদর্শন আমাদের আশপাশেই রয়েছে প্রচুর-গির্জায়, স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, দাতব্য চিকিৎসালয় ও হাসপাতাল, অনাথ আশ্রম ও বিভিন্ন প্রকার কারিগরি শিক্ষালয়, সাময়িকী ও পুস্তক প্রকাশনী, গৃহহীনদের জন্য খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের ব্যবস্থাপনায়। এ রকম মানব মঙ্গল কাজে সংযুক্ত ছিলেন এবং আছেন বহু খ্রিষ্টবিশ্বাসী নারী। তাঁদের মধ্যে অনেককেই রোমান ক্যাথলিকমণ্ডলী (Roman Catholic Church) সাধ্বী হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন তাঁদের ব্যক্তিগত পবিত্রতা ও মানব উন্নয়নে ভালো কাজের জন্য। হাজারো অনুশীলনীয়া নারীদের মধ্যে আমাদের সমসাময়িক কয়েকজনের কথা উল্লেখ করা যেতে পারেÑসাক্ষ্যমর সাধ্বীবৃন্দা আগাথা, লুসি ও পেরপেতুয়া, ইতালির সাধ্বী ক্যাথেরিন অফ সিয়েনা, ফ্রান্সের সাধ্বী যোয়ান অফ আর্ক, বার্নাডেট অফ লুর্দ ও ক্ষুদ্র পুষ্প সাধ্বী তেরেজা অফ লিসিউ, পর্তুগালের সাধ্বী রানি ইসাবেল, স্পেনের সাধ্বী তেরেজা অফ আভিলা, কলকাতার সাধ্বী মাদার তেরেসা, পোল্যান্ডের সাধ্বী ফাওস্টিনা, হাঙ্গেরীর সাধ্বী এলিজাবেথ, জার্মানির সাধ্বী ইডিথ স্টেইন, পেরুর সাধ্বী রোজ অফ লিমা, ন্যাটিভ আমেরিকান মৌহক সম্প্রদায়ের সাধ্বী কাটেরিটেকাকউইথা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ফিলাডেলফিয়ার সাধ্বী ক্যাথেরিন ড্রেক্সেল, বালটিমোর মেরিল্যান্ডের সাধ্বী এলিজাবেথ অ্যানসিটন প্রমুখ। সাধ্বী হিসেবে এখনো ভূষিতা না হলেও বহুজনের মাঝে কয়েকজন অনুশীলনীয়া ব্যক্তিত্ব হলেন গৃহহীনদের মাঝে সমাজকর্মী নিউইয়র্কের ডরোথি ডে, শিশুদের জন্য মঙ্গলকর্মী যুক্তরাজ্যের ফিলিস বাওম্যান, ক্যাথলিক টেলিভিশন চ্যানেল EWTN প্রতিষ্ঠাত্রী ওহাইওর মাদার অ্যাঞ্জেলিকা, বিভিন্ন সংগঠন-প্রতিষ্ঠানে সাহায্যদাত্রী নিউইয়র্ক ও ক্যালিফোর্নিয়ার ডলোরেসহোপ, স্যাভানা জর্জিয়ার সাহিত্যিক ফ্ল্যানারি ও’কনোর হেমসহ আরো অনেকে।
তাঁদের মতোই আরো বহু গুণী, ধার্মিকা, জ্ঞানী, নেতৃত্বদানকারিনী, সমাজকর্মী, রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, অধ্যাপিকা, শিক্ষিকা, বিজ্ঞানী, সন্ন্যাসব্রতিনী, মা, বোন, স্ত্রী, প্রেমিকা, কন্যা হিসেবে নারী নিজেকেসহ পরিবার, সমাজ, দেশ ও পৃথিবীকে নিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে, উন্নয়নের ধাপে, মঙ্গলের পানে পুরুষের সাথে সাথে সহকর্মী, সহযাত্রী, সহসাথি হিসেবে। বছরের প্রতিটি দিনেই তাঁদের প্রতি আমাদের সালাম, নমস্কার, অভিনন্দন, প্রণাম, শুভেচ্ছা, ভালোবাসা এবং সমর্থন থাকা উচিত। বৈষম্য, ধর্মান্ধতা ও অন্য কোনো কারণেই যেন কোনো নারী অবহেলিতা কিংবা নির্যাতিতা না হন, সে জন্য আমাদের সকলকেই সাধ্যমতো কাজ করে যেতে হবে, নারীর অধিকার রক্ষায় সচেষ্ট থাকতে হবে। আন্তর্জাতিক নারী দিবসে এটাই হোক সবার প্রার্থনা, মোনাজাত ও মনোবাসনা।
লেখক : একজন রোমান ক্যাথলিক যাজক, নিউজার্সিবাসী এবং ধর্মবিষয়ক কলামিস্ট।