না ঘরকা না ঘাটকা

লাবলু কাজী

হে আলো তুমি আমাকে সামনের কাতারে নিয়ে এসো। ঐ যে জনতার মিছিল এগিয়ে চলেছে অজানার উদ্দেশ্যে তার কান্ডারী বানিয়ে দাও আমাকে। তাদের প্রতি অবিচার, অনাচার, জোর জুলুমের প্রতিবাদে আমাকে তাদের কাতারে নিয়ে এসো । দেশের অগণিত মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য যে দীক্ষা দরকার তা তাদের তুমি দাও। তাদেরকে অভয় দাও, বলো প্রতিদিন মরে যাওয়ার চেয়ে ভালোর ভালোয় একদিন মরে যাওয়া অনেক সম্মানের। হে লাইট হাউস দিকভ্রষ্ট এই জাহাজের যাত্রীদের আলোর জ্যোতিতে ভাসিয়ে গন্তব্যে পৌঁছে দাও তুমি । সময় এখন বড়ই খারাপ সর্বত্র, পৃথিবীর যে দিকেই তাকাই , যেখানেই যাই। মানুষের চোখ অন্ধ। নির্বাক দৃষ্টিতে শুধু দেখে যাও , কিছু বলবে না, কোন আওয়াজ নেই। জবান খুললেই হাওয়া হয়ে যাবে। হচ্ছেও তাই । স্বাধীনতা কি, এর মানে কি, জানা থাকলেও সংজ্ঞাটা নতুন করে বের করতে হবে অথবা লিখতে হবে। বাক-স্বাধীনতা যখন রুদ্ধ হয়ে যায়, প্রকাশে যখন ভয় হয়, তখন কোথায় কে, কিভাবে স্বাধীন আমার বুঝে আসেনা । প্রকাশের ধারা আছে, মার্জিত হওয়া বাঞ্চনীয়, কিন্তু অপ্রকাশিত তো থাকতে পারে না।
ইদানিং দেশীয় সমাজে দুটি শ্রেণী স্পষ্টভাবে নজরে আসছে। কিছু লোক জীবনের প্রতিটি এভিনিউ উপভোগ করছে জনগণের পয়সায়। সভা-সমিতি হোক, বিয়ের পার্টি হোক অথবা স্যোসাল গ্যাদারিং হোক ক্ষমতাবানরা পুরো ফয়দা নিচ্ছেন। প্রচার প্রসারে রাষ্ট্রযন্ত্র দখল করে নিজেদের এজেন্ডা বাস্তবায়িত করছে । ভাল ফসল সব নিজেদের ঘরে তুলছে , ছিটে-ফোঁটা অন্যের ঘরে ঠেলে দিচ্ছে । বিদেশে কিন্তু এমনটি দেখা যায়না । ভোট প্রচারণায় বেসরকারী প্রচার মাধ্যম পার্টি ব্যবহার করে এবং ডোনেশন থেকে প্রচার মাধ্যমের প্রাপ্য পরিশোধ করা হয় । কে ক্ষমতায় বা কে বিরোধী দলে তা বিবেচ্য নয় । যাদের ডোনেশন সংগ্রহ যত বেশি হয় , জিতের পাল্লাও ভারী হয় তাদের দিকে । দ্বিতীয় গ্রুপ বিরোধী দল; ক্ষমতাবানদের বিরিয়ানী খেতে দেখে তাদের জিবে পানি আসছে কিন্তু খাওয়ার ভাগ্য নেই । অপেক্ষায় আছে কবে পালা বদল হয় যাতে তারাও ওরকম খেতে পারবে। অবাক হলেও কথাটা সত্য- জনগণের কথা কেউ ভাবে না । ভোটের সময় জনগণের জন্য ভালোবাসার ঢেউ উথলে উঠে। ভোট শেষ সব শেষ , ব্যন্ত নিজ পকেট ভরার তালে । তখন ভোটা কে দেখলেও না চেনার ভান করে । এই শ্রেণীতে দেশের গরীব অপামর জনগণও যুক্ত হয়ে পড়ে এবং তারা না ঘরকা না ঘাটকা। বড়ই দুঃখজনক ।
আরেকটা ব্যাপারে আজ অবতারণা করব যা অনেক জায়গায় হচ্ছে এবং ভুক্তভোগীরা ভয়ে মুখ বন্ধ করে আছে । উন্নয়ন ধারায় সরকারী পয়সায় কাজ বা খাদ্যের বিনিময়ে কাজ যেটাই হচ্ছে তা জনগণের কল্যাণ বয়ে আনছে না; উল্টা তাদের কষ্টের বোঝা বাড়ছে । ছিনিয়ে নিচ্ছে জীবিকার্জন । উদাহরণ স্বরূপ স্থানীয় সরকারের কার্ত্তিকপুর বাঁধ । এ বাঁধের ফলে ভাটি অঞ্চলের লোকদের জীবনে যেমন বিরাট পরিবর্তন এসেছে তেমনি ইছামতি নদীকে জীবন্ত কবর দেয়া হয়েছে । যে কোন পাইলট প্রোজেক্ট বাস্তবায়ন করতে স্থানীয় জনগণের মতামত নেয়া হয় । তাদের সুবিধা অসুবিধার কথা শুনা হয় । অনেকের সাথে আলাপে জেনেছি তারা এ বাঁধটি সম্পর্কে আদৌ কিছু জানে না । তাদের মতামতও নেয়া হয়নি । তাহলে কি এটা স্থানীয় প্রভাবশালীদের হাত শক্তিশালী করার নিমিত্তে বা খাস জমি দখল করার জন্য করা হয়েছে ? করা হয়েছে আমাদের বঞ্চিত, নদীর নাব্যতা কমিয়ে, প্রবাহ রুদ্ধ করে । ইছামতির দিকে তাকানো যায় না । কূল কূল রবে বহমান এই নদীর না শব্দ আছে না স্রোত । বড় অসহায় মনে হয় নিজেকে আল্লাহর নিয়ামতের এ ধ্বংসাবশেষ দেখে । জনগণের পয়সায় এ জাতীয় উন্নয়ন দেশের মানুষ চায়না । এর চেয়ে ভাল ,এ পয়সায় কল- কারখানা , গার্মেন্টস বানানো হোক যাতে বেকাররা কাজ করার এবং পরিবারের মান উন্নয়ন করে দেশকে প্রবৃদ্ধির দিকে নিয়ে যাওয়ার সুযোগ পায়।
গতকাল বন্ধু রাহেলের সাথে ফোনে ঢাকায় কথা হয়েছে। তার দুঃখ, ব্যথা ও মনের কথা জানালো । কি আর করা, কষ্ট হয় সমাজের এই অনাঙ্খিত পরিবর্তন দেখে। কিছু করার না থাকায় মনটা হাল্কা করার জন্য প্রসঙ্গটি উত্থাপন করছি । আপনি যত ভাল চরিত্রেরই অধিকারী কিংবা ভাল বংশের, সুন্দর,স্মার্ট, হাইলি এডুকেটেড হোন তা কোন কাজেই আসবে না । বর্তমান সমাজ ব্যবস্থায় উচ্চ বিত্তদের আসরে যেতে হলে ভাল কাপড়, দামী গাড়ি,ঢাকায় বহুতল বাড়ি ,কোটি টাকার ব্যাংক ব্যালেন্স, কলকারখানা ইত্যাদি আপনার থাকতেই হবে । অথচ একজন বড়লোক এবং ভাল লোকের সংজ্ঞা কিন্তু তা নয় । ইদানীং ফেসবুকে, যতগুলো বিয়ের ফটো দেখেছি সবগুলোতেই আমি সেই পরিচিত ধনী বন্ধুদের সমাগমে মুখরিত হতে দেখেছি, তাদের প্রফেশনাল ফটোগ্রাফারের ফটোর ঝলকানিতে ফেসবুক , খবরের কাগজ সরগরম দেখেছি। আমার ছোটকালের বন্ধুকে আমাদের আরেক বন্ধুর দাওয়াত না দেয়ার কারণ জিজ্ঞাস করলেম। তার সোজা উত্তর- আমি তাদের মতো ধনী নই, তার মেয়ের বিয়েতে আমায় দাওয়াত দিলে তার মান সম্মান যাবে না ? আমি আমার নিজেকে প্রশ্ন করেছি; আমার মেয়ের বিয়ে হলে তাকে কি দাওয়াত না দিয়ে পারতাম-কোথায় আমার মনেতো নেগেটিভ কিছু আসে নি।
এ প্রসঙ্গে ছোটকালে পড়া সেখ সাদীর একটা গল্প মনে পড়লো: ছেঁড়া কাপড় পড়ে সওদাগরের মেয়ের বিয়েতে উপস্থিত হওয়ায় লোকজনের ঠাট্টা বিদ্রূপে জর্জরিত হয়ে খাবার না খেয়ে পকেটে ভরে নিয়ে আসেন । পরের দিনের অনুষ্ঠানে দামী কাপড় পড়ে যান-সবাই সাদীর সাহিত্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তখন চাটুকারদের উদ্দেশ্যে শেখ সাদীর বক্তব্য ছিল- সেদিন আমার অমর্যাদার কারণ ছিল কাপড়-চোপড়। আর তাই খাবার কাপড়কে খাইয়েছিলাম । আজ ভাল কাপড়ের সুবাদে আপনাদের দেওয়া সম্মান আমি প্রত্যাখ্যান করলাম এবং আমি না খেয়ে প্রস্থান করছি, ধিক্কার তোমাদের । সমাজ দ্রুত বদলে যাচ্ছে। তাই হয়তোবা আমার বন্ধুটি সমাজ থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছে । তাকেই বা দোষ দেবো কিভাবে ? আমরা মনের দিক থেকে অনেকেই আহত এবং ভুগছি । তাই সকলের উদ্দেশ্যে আমার বক্তব্য: আত্মকেন্দ্রিক হয়ে পড়ুন , নিজস্ব ভূবন গড়ুন । দেখবেন শান্তি পাবেন , ভাল থাকবেন । পরিশেষে একটি উপদেশ ধনী বন্ধুদের – ধন সম্পদ আল্লাহ দিয়েছেন, আলহামদুলিল্লাহ ! মনটা বড় করুন।
নিউইয়র্ক।