নিউইয়র্কের থোকা থোকা সুন্দরগুলো

প্রণবকান্তি দেব : গত সপ্তাহে এক রাতে জ্যাকসন হাইটসে আড্ডা দিয়ে বাসায় ফিরে পুণ্য’র সাথে কথা বলছি। কথা প্রসঙ্গে বললাম, নিউইয়র্কে এখন অনেক রাত। এখনো জেগে আছি শুনে ছেলের প্রশ্ন, ‘বাবা, আমি শুনেছি নিউইয়র্ক সিটি নেভার স্লিপস, তুমিও কি তাহলে ঘুমাও না।’ এরা আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম!
একইভাবে নিউইয়র্কে এসে খুঁজে চলছি আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি নিয়ে তাদের আগ্রহ ইত্যাদি নানা বিষয়। যেখানে যাই, যেখানে পাই বাংলাদেশ থেকে খুব ছোট বেলায় মা বাবার সাথে আসা কিংবা আমেরিকায় জন্মগ্রহণকারী ছেলেমেয়েদের সাথে কথা বলি। তাদের ভাবনা-চিন্তাগুলো জানার চেষ্টা করি। তাদের মনোজগতে খেলা করা বহু রঙের সন্ধান করি। স্কুল, হোমওয়ার্ক, ফাস্ট ফুড, টিভি, ট্যাবলেট এ-ই তাদের নিত্যদিনের ছক। পরিবার, মা-বাবা, আত্নীয়-স্বজন এসব নিয়ে তাদের খুব একটা আবেগ নেই। নিজের মতো করে, নিজের একটা ভুবন তৈরি করে সেই ভুবনেই তাদের বিচরণ। স্কুল থেকে ফিরেই ট্যাবলেট কিংবা স্মার্ট ফোন নিয়ে বসে পড়া। বাসায় রান্না করা খাবারেও তেমন আগ্রহ নেই। তাদের প্রিয় ম্যাকডোনাল্ডস, পিজা হাট, ডানকিন ডোনাটস ইত্যাদি। ভাঙা ভাঙা সিলেটি উচ্চারণ আর ইংরেজিতে দারুণ দক্ষতা নিয়ে বেড়ে উঠছে এরা। তবে অনেকেই স্কুলে ভালো ফলাফল করছে। বিভিন্ন ভাষাভাষী ছেলেমেয়েদের সাথে প্রতিযোগিতা করে বাঙালি ছেলেমেয়েরা এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু মা-বাবা কিংবা পিতৃপুরুষের জন্মভূমি বাংলাদেশ নিয়ে খুব একটা আগ্রহ, আবেগ নেই অনেকেরই। বাঙালির চিরায়ত জীবনধারা কিংবা বাংলা সংস্কৃতি নিয়ে নেই মাথাব্যথা। এই প্রজন্মের কাছে আমেরিকার জীবন বৈচিত্র্যই মুখ্য। এভাবেই তারা এগিয়ে চলছে। তবে কিছু কিছু পরিবারে সন্তানদের বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতি-চর্চার আপ্রাণ চেষ্টাও চলে। ব্যস্ত জীবনের ফাঁকেও মা-বাবা চেষ্টা করে যাচ্ছেন শেকড়ের সাথে সংযোগ রক্ষা করতে। বাংলা গান, নৃত্য চর্চার সুযোগ করে দিচ্ছেন কেউ কেউ। আবার ধর্মীয় শিক্ষার ওপরও গুরুত্ব দিচ্ছেন। তবুও ঘরে ঘরে মা বাবার টেনশন, ছেলেমেয়ে সঠিকভাবে বড় করে তোলা। যে আশা, স্বপ্ন নিয়ে এসেছেন তা পূর্ণ করা, বহুভাষা ও সংস্কৃতির জোয়ারের মধ্যে নিজেদের ঐতিহ্যিক ধারায় সন্তানদের বড় করে তোলা। এভাবে সারাক্ষণই একটা টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে দিনকাল। তখন মান্না দের গান মনে পড়ে, ‘কেউ সুখী হয়, কেউ হয় না’।


নিউইয়র্কের দিনগুলো এভাবেই ফুরিয়ে আসছে। গত সপ্তাহে ঘুরে আসি নিউ হাইড পার্কের ‘গ্র‍্যাট নেক লাইব্রেরি’ এবং জ্যাকসন হাইটসের ‘কুইন্স লাইব্রেরি’। বইয়ের ভুবনে হারিয়ে যাই কিছুক্ষণ। দুটো লাইব্রেরি চিত্রই প্রায় একই রকম। ছিমছাম গুছানো সবকিছু। সারি সারি বুকসেলফ। বিষয়ভিত্তিক আলাদা করা বইয়ের তাক। দেখা পাই, শেকসপিয়ার, এডগার এলান পো, হোমার, সফোক্লেস প্রমুখের মতো জগত বিখ্যাত সাহিত্যিকের রচনার। ভিন দেশে ছুঁয়ে দেখি পরিচিত টেক্সটগুলো। অদ্ভুত এক ভালোলাগা কাজ করে। সুনসান নীরবতায় নানাবয়সী মানুষজন বসে বই পড়ছে। ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের নিয়ে এসেছেন মা-বাবা। কর্মকর্তারা ঘুরে ঘুরে দেখছেন, কারও কোনো সাহায্য প্রয়োজন কি-না, আগ বাড়িয়ে হাসিমুখে কথা বলছেন। বড় ভালো লাগে দৃশ্যগুলো। দেখি লাইব্রেরিতে বসে বইপড়ার পাশাপাশি কম্পিউটারসহ বিভিন্ন বিষয়ে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। ট্যাক্সসহ বিভিন্ন জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ওপর কর্মশালা, সংক্ষিপ্ত কোর্সের ব্যবস্থাও আছে, আছে টুকটাক প্রিন্ট, অফিস স্টেশনারিজ সুবিধাও। এ ব্যাপারগুলো ভালো লাগল। মনে রেখে দেই থোকা থোকা সুন্দরগুলো। সিলেটে এমন একটা লাইব্রেরি করব- এ আশা আবারও নড়েচড়ে উঠে মগজে। হাঁটতে থাকি জ্যাকসন হাইটসের পথ ধরে… মনে মনে আওড়াই শেকসপিয়ারকে, ‘লাভ লুকস নট উইথ দ্যা আইজ বাট উইথ দ্যা মাইন্ড’।