নিউইয়র্ক : কত স্বপ্ন উড়ে, কত বেদনাও

প্রণবকান্তি দেব : আপাতত বিদায় নিউইয়র্ক! বিদায় প্রিয়জনের স্মৃতি লেপ্টে থাকা শহর। বিস্ময়ভরা চোখে দু সপ্তাহ ভ্রমণের নানা রঙা অভিজ্ঞতা নিয়ে যাচ্ছি এ শহর ছেড়ে।
সাথে নিয়ে যাচ্ছি কত স্বজনের সাথে দেখা না হওয়ার বেদনা। চলে যাচ্ছি কত কিছু দেখার, কত কিছু জানার বাসনা অপূর্ণ রেখেই! সাথে আছে কত মায়া! কত হৃদয়ের উষ্ণতা! আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-পরিজনের সাথে খানিক দেখা হওয়া আকুলি বিকুলি মন নিয়ে এবারের মতো ছেড়ে যেতে হচ্ছে!
লাল লাল দালানের পাশে সদ্য ফোঁটা চেরীর কাতর দৃষ্টি চৌচির করে দিচ্ছে আমায়। ম্যাগনোলিয়া যেন বলছে, ‘আবার এসো’। একটু থামি। শুনি পেছনে ডাকছে হাডসন পাড়ের বেঞ্চগুলো, ম্যানহাটনের আকাশমুখী দালান, টাইম স্কোয়ারের কোলাহল, স্বামী নারায়ণ মন্দিরের প্রার্থনার গীত, আটলান্টিকের মাতাল ঢেউ। আমাকে যেন পেছন পেছন উঁকি দিয়ে ডাকছে দ্রুতগতির এক্সপ্রেস ট্রেন, থেমে থেমে চলা বাস, ট্রাফিক বাতি। তবুও বিদায় নিউইয়র্ক। জীবন এমনই এক সারোদ, তারে তারে যার কেবলই মায়া জড়ানো।
নিউইয়র্কের দিনগুলো কেটেছে নানাবিধ ভাবে। বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতার খোঁজে ছুটেছি। এ খোঁজা ছিল কখনো পেশাগত, কখনো জীবনমুখী, কখনো স্রেফ ‘এক্সপ্লোর’ এর নেশায়। স্বজন-পরিজনের সাথে মিশেছি, দেখেছি তাদের বদলে যাওয়া দৃষ্টিভঙ্গি। দেখলাম বাংলাদেশি পরিবারগুলোর নানা সংকট। সন্তানদের নিয়ে উদ্বেগ তো আছেই। দেশে থাকা স্বজন নিয়ে, দেশের জমিজমা, সহায় সম্পত্তি নিয়েও উদ্বেগ আছে। ভীতি আছে দেশের আইন শৃঙ্খলা নিয়ে। দেশের যেকোনো খবরে তাদের ভেতরও তোলপাড় হয়। বঙ্গবাজারের আগুন নিয়ে তাদের উৎকণ্ঠা দেখেছি। দেখেছি সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়েও আগ্রহ-আলোচনা। পয়লা বৈশাখের আয়োজন যেমন চলছে, তেমনি আছে ঈদের আগে ডলারের দাম কমে যাওয়া নিয়ে হাহুতাশও।
স্টুডেন্ট ভিসায় যারা আসছেন তাদের কেউ কেউ পড়াশোনা ছেড়ে দিয়ে লেগে যাচ্ছেন কাজে আর কেউ কেউ বদল করেছেন কোর্স। নিয়মিত পড়াশোনা চালিয়ে যাওয়াদের সংখ্যা খুবই কম। টিউশন ফি ম্যানেজ করতে হিমশিম খাচ্ছেন অনেকেই। আবার জানলাম প্রতিদিন বাড়ছে ভিজিট ভিসায় এসে অ্যাসাইলাম প্রত্যাশীদের সংখ্যা। অনেক বাংলাদেশির বাসায় এরকমই আছেন এক, দুইজন আত্নীয়-স্বজন। কাজ পেতে চ্যালেঞ্জ বাড়ছে। অনেকেরই ভরসা নানারকমের ‘বেনিফিট’।
দেখলাম, এখানে সংগ্রামের নানা রকমফের। একেকজনের গল্প একেকরকম। কেউ ছকেবাধা জীবন উপভোগ করছেন, কেউ উপভোগ না করলেও উপায়ান্তর না পেয়ে মেনে নিচ্ছেন। কেউ ভাবছেন দেশের মাটিতে মা-বাবা, পরিবার নিয়ে একসাথে থাকাই আনন্দের, কেউ পদে পদে খোঁজেন নিজের দেশের দোষ-ত্রুটি। কেউ সুখী এখানকার মুক্ত-স্বাধীন জীবনাচরণে, কেউ খোঁজেন স্নেহ-প্রীতিডোরে বাধা জীবন। কারও বুকের ভেতর আগুন, কারও ভেতরে জল। কেউ থাকতে চান বাংলাদেশি অধ্যুষিত এলাকায়, কেউবা আবার বাংলাদেশিদের থেকে দূরে। কেউ দেশীয় মাছ-মাংস, সবজির জন্য মুখিয়ে থাকেন, কারও কাছে ভিন দেশিটা সুস্বাদু। কারও স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে তো কারও স্বপ্ন পুড়ছে। বাংলাদেশ-নিউইয়র্ক, দূরত্ব এমন যে, অনুভব করা যায় কিন্তু ছোঁয়া যায় না। এভাবেই নিউইয়র্কে কত স্বপ্ন উড়তে দেখলাম, দেখলাম কত বেদনাও। পথ চলতে চলতে দেখেছি ট্রেনের জন্য ভোদৌড় দেয়া কারও কারও আনন্দ স্বপ্নের পেছনে দৌড়ানোও।
এখানকার স্কুলগুলোর ‘গাইড/কাউন্সিলর’ ব্যবস্থা ভালো লেগেছে। বাংলাদেশেও তা অনুসরণ করা যেতে পারে। বুঝলাম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের লাইব্রেরি ব্যবহার এবং প্রব্লেম বেইজড এডুকেশন নিয়ে আমাদেরও ভাববার সময় এসেছে। বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে গবেষণা এবং নিত্যনতুন বিষয়-ভাবনা মুগ্ধ করেছে। তবে উচ্চ শিক্ষায় বাংলাদেশি ছেলেমেয়েদের অন্তর্ভুক্তি খুব আশাব্যাঞ্জক নয়।
কিন্তু আশার কথা, বাংলা সংস্কৃতি চর্চায় নিউইয়র্ক পিছিয়ে নেই। সংস্কৃতির প্রায় সকল শাখাই চর্চা হচ্ছে এখানে। সংগীত, নৃত্যকলায় এ প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের আগ্রহ আছে। তাছাড়া প্রতিদিন নানা অনুষ্ঠান লেগেই আছে। নতুন প্রজন্মের ছেলেমেয়েদের মধ্যে বাংলাদেশের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি চেতনা গড়ে তুলতে কাজ করছেন অগ্রজেরা। নানা টানাপোড়েনের ভেতরও শিকড়কে জিইয়ে রাখার প্রাণান্ত প্রচেষ্টা চলছে।
এসব টুকরো টুকরো অভিজ্ঞতা নিয়েই এবারের মতো নিউইয়র্ক ভ্রমণের ইতি টানা হলো। এ ভ্রমণের আনন্দসুধা ছড়িয়ে দিতে চাই আমার ভাবনা বিশ্বে।
ভালো থেকো নিউইয়র্ক। ভালো থেকো প্রিয়জনেরা। আবার দেখা হবে।