নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষা : পুলিশের ব্যাপক প্রস্তুতি

রাজনৈতিক ডেস্ক : জাতীয় সংসদ নির্বাচনকালে আইনশৃঙ্খলা রক্ষায় ব্যাপক প্রস্তুতি নিয়েছে পুলিশ। নির্বাচনে বিএনপি অংশ নিলে পুলিশের ভূমিকা কী হবে, আর না নিলে কী ভূমিকা হবে, সে বিষয়েও করণীয় নির্ধারণ করা হয়েছে। পুলিশ সদর দফতর থেকে সব ইউনিট প্রধান, ডিআইজি, মেট্রোপলিটন পুলিশ কমিশনার ও জেলার এসপিদের এরই মধ্যে এ সংক্রান্ত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। পুলিশ সদর দফতরের বেশ কয়েকটি সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। বেশ কয়েকটি গোয়েন্দা প্রতিবেদনের মাধ্যমে পুলিশ সদর দফতর অবগত হয়েছে যে, রাজনৈতিক কারণ ছাড়াও অরাজনৈতিক কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি হতে পারে। আর এর সুযোগ নিতে পারে সরকারবিরোধীরা।

রাজনৈতিক অনুষঙ্গের বাইরে যেসব কারণে রাজপথ উত্তপ্ত হতে পারে বলে গোয়েন্দারা আশঙ্কা করছেন সেসবের মধ্যে আছেÑ সরকারি চাকরিতে কোটা সংস্কার আন্দোলন, নিরাপদ সড়ক আন্দোলন, সরকারি কর্মচারীদের বিভিন্ন দাবি, শিক্ষক আন্দোলন, জঙ্গি তৎপরতা, পুলিশে সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি ইত্যাদি।
পুলিশ সদর দফতরের সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপিসহ কোনো পক্ষকেই আন্দোলনে নামার সুযোগ দেবে না পুলিশ। বিভিন্ন নির্বাচনী এলাকায় যারা বিএনপির প্রার্থী হতে পারেন বা মনোনয়ন প্রত্যাশা করছেন তাদের বিষয়ে এরই মধ্যে নজরদারি শুরু করেছেন গোয়েন্দারা।

গোয়েন্দা প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার কারামুক্তি, নির্বাচনকালীন সরকার বা অন্য কোনো ইস্যুতে যদি বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট নির্বাচন বর্জন করে তবে তারা নির্বাচন প্রতিহতের চেষ্টা করবে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা হবে খুবই আগ্রাসী। অন্য দিকে বিএনপি ও তার শরিকরা যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তখন পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকার যখন যে দিকনির্দেশনা দেবে সে অনুযায়ী পুলিশ কাজ করবে।
পুলিশের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশনায় বলা হয়েছে, নেগোসিয়েশনের মাধ্যমে বিএনপি বা কোনো পক্ষ যদি সরকারের কাছ থেকে কোনো ধরনের সুবিধা নিতে চায় সে ক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা ইতিবাচক থাকবে। আপাতত কোনো ধরনের গণগ্রেফতার না করার পরামর্শ দিয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে বিভিন্ন ইউনিট প্রধান ও জেলার এসপিদের বলা হয়েছে, পুরনো মামলায় যাদের বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট আছে তাদের গ্রেফতার করুন। তা ছাড়া কেউ রাস্তায় নেমে অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টির চেষ্টা চালালে কোনো ধরনের ছাড় দেয়া যাবে না।
গোয়েন্দা প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে পুলিশ সূত্র জানায়, ১২ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য গার্মেন্ট সেক্টরে শ্রমিকদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। যেকোনো সময় এ ক্ষোভের বিস্ফোরণ ঘটতে পারে। শ্রমিকরা তাদের দাবি আদায়ে রাজপথে নামলে সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা চালাবে।

পুলিশ সদর দফতরের একজন ডিআইজি বলেন, সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতি সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থী বা চাকরিপ্রত্যাশীরা ফের রাস্তায় নামতে পারে। কোটা সংস্কার না করে সম্প্রতি ৪০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের কারণে এ আশঙ্কা বেড়ে গেছে।
গত ১২ সেপ্টেম্বরও কোটা সংস্কার আন্দোলনকারীরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভ মিছিল করেছে। আন্দোলনকারীরা যাতে বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার বাইরে আসতে না পারে সে জন্য সংশ্লিষ্ট পুলিশ সদস্যদের কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে। কারণ আন্দোলনকারী রাজপথ দখল করে নিলে তাদের সরাতে পুলিশকে বেশ বেগ পতে হবে। এ আন্দোলন যেকোনো সময় রাজনৈতিক আন্দোলনে রূপ নেয়ার আশঙ্কা আছে। চলতি মাসের শুরুতে দেয়া গোয়েন্দা প্রতিবেদনে আশঙ্কা করা হয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে নিরাপদ সড়কের দাবিতে ফের আন্দোলন শুরু হতে পারে। এই দাবিতে আন্দোলন হলে তা মোকাবেলা করা পুলিশের পক্ষে কঠিন হয়ে পড়বে।

পুলিশ সদর দফতরের একাধিক ডিআইজি ও অতিরিক্ত ডিআইজি বলেন, বেতনবৈষম্য দূর কারার দাবিতে শিক্ষক মহাজোটের ব্যানারে আন্দোলনের আশঙ্কা আছে। বিভিন্ন দাবি-দাওয়া নিয়ে সরকারি কর্মচারীরা আন্দোলনে নামতে পারেন। সুপারনিউমারারি পদ সৃষ্টি নিয়ে পুলিশের মধ্যেও অসন্তোষ আছে। এসব বিষয়ের মধ্যে যেন রাজনীতি প্রবেশ করতে না পারে সে বিষয়ে সতর্ক থাকতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কঠোর বার্তা দেয়া হয়েছে।
একজন ডিআইজি বলেন, নির্বাচন সামনে রেখে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদেরও পূর্ণাঙ্গ প্রোফাইল করতে বলা হয়েছে। তাদের পরিবারের সদস্যরা কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত কি না, আর থাকলেও কোন দলের সঙ্গে জড়িত তা-ও খতিয়ে দেখা হচ্ছে।

তিনি বলেন, নির্বাচনকালীন সরকার গঠনের পরপরই বিএনপি-জামায়াতসহ সরকারবিরোধী রাজনৈতিক দলগুলো রাজপথে আন্দোলনে নামতে পারে বলে তথ্য রয়েছে। হরতাল, অবরোধ, ঘেরাওসহ নানা কর্মসূচি আসতে পারে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর দেশে কী ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে তার একটি ধারণা পুলিশের রয়েছে। সে অনুযায়ী নিরাপত্তা ছক আঁকা হয়েছে।

পুলিশ সদর দফতরের আশঙ্কা নির্বাচনকে ঘিরে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়িয়ে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ তৈরির চক্রান্ত হতে পারে। এ কারণে ফেসবুকসহ সব সামজিক যোগাযোগমাধ্যম কঠোরভাবে মনিটরিংয়ের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সারা দেশে দেয়া পুলিশ সদর দফতরের নির্দেশনায় বলা হয়, নির্বাচন ঘনিয়ে আসার সঙ্গে সঙ্গে সামাজিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, রাজনৈতিক নেতা এবং বিদেশি নাগরিকরা জঙ্গিগোষ্ঠীর টার্গেটে পড়তে পারেন। এ ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিস্থিতি ঘোলাটে হতে পারে। তাই জঙ্গি তৎপরতার বিরুদ্ধে পুলিশের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।

পুলিশ সদর দফতরের এআইজি (মিডিয়া) সোহেল রানা বলেন, নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জননিরাপত্তা ও জনশৃঙ্খলা নিশ্চিত করতে পুলিশের পক্ষ থেকে ব্যাপক প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। জনবলের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে পুলিশ সদর দফতর থেকে মাঠপর্যায়ে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। প্রতিদিনই আইজিপি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিভিন্ন ইউনিট প্রধানের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। তা ছাড়া মাঠপর্যায়ে পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বেশকিছু লিখিত নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।