নিজস্ব প্রতিনিধি : সিটি করপোরেশন নির্বাচন সরকার ও সরকারি দলকে নতুন শিক্ষা দিয়েছে। গাজীপুর ও খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনের ফলাফল এবং গাজীপুরে দলীয় মনোনয়ন থেকে নিয়ে নির্বাচনকালে দলের নেতা-কর্মীদের বিভিন্নমুখী তৎপরতা কেন্দ্রীয় নেতৃত্বকে ভাবিয়ে তুলেছে। সমমনা, বিশেষ করে ধর্মীয় সংগঠনগুলোর কাছ থেকে প্রতিশ্রুত সহযোগিতা না পাওয়া এই ভাবনাকে দুর্ভাবনার পর্যায়ে নিয়ে গেছে। আগামী জাতীয় নির্বাচনে এর প্রভাব প্রতিক্রিয়ার দিকটি গুরুত্বের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, এ পরিপ্রেক্ষিতে জাতীয় নির্বাচনী পরিকল্পনায় কিছু পরিবর্তন আনা হচ্ছে। আওয়ামী লীগের একাধিক নেতৃস্থানীয় সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
সমুদ্র জয়, পদ্মা সেতু, দক্ষিণ-দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলে রেল সংযোগ, পায়রা সমুদ্রবন্দর, মেট্রো রেল, রূপপুর আণবিক শক্তি প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল এবং সর্বশেষ মহাকাশ জয় প্রভৃতি মেগা প্রকল্পসহ সরকারের উন্নয়ন কার্যক্রম ভোটের রাজনীতিতে কতটা প্রভাব ফেলবে সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের কাছেই তা প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। দুই সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ফলাফল যা-ই হোক, বিএনপির পক্ষে যে জনজোয়ার দেখা গেছে এবং এর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মীদের বিভক্তি ও নিষ্ক্রিয়তা ও ইসলামী দলগুলোর কাছ থেকে প্রত্যাশিত সহযোগিতা না পাওয়ার ঘটনা সরকারের আগামী সংসদ নির্বাচনের হিসাব-নিকাশ অনেকটাই পাল্টে দিয়েছে। প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতারা মনে করেন, সংসদ নির্বাচনের আগে সময় থাকতেই বিষয়গুলো খোলাসা হওয়ার শীর্ষ নেতৃত্বের জন্য সিদ্ধান্ত গ্রহণে তা সহায়ক হবে।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে। খুলনায় মেয়র পদের জন্য সাবেক মন্ত্রী তালুকদার খালেদাপ্রত্যাশী ছিলেন না, প্রবীণ নেতা হিসেবে দলের কয়েকজন আগ্রহী থাকলেও কেউই তালুকদার খালেককে চ্যালেঞ্জ করার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তবে হেফাজতসহ ধর্মীয় সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীরা প্রকাশ্যে, অপ্রকাশ্যে বিএনপির পক্ষেই কাজ করেন। এতে করে ধর্মপ্রাণ ভোটারদের প্রভাবিত করতে আওয়ামী লীগ প্রার্থীকে বেশ বেগ পেতে হয়েছে। খুলনার ফলাফল সম্পর্কে সরকারি দল গোড়া থেকেই বেশ আশাবাদী ছিল। কিন্তু গাজীপুরের অবস্থা তেমন নয়। এখানে তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতার সম্ভাবনার কথা শুরু থেকেই ভাবনায় ছিল। কিন্তু অভ্যন্তরীণ তীব্র বিরোধের প্রকাশ্য বহিঃপ্রকাশের বিষয়টি বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। জেলা সভাপতি অ্যাডভোকেট আজমতউল্লাহ জেলার প্রবীণ, ত্যাগী নেতা হিসেবে শুধু দলের মধ্যে নয়, সাধারণভাবেও গ্রহণযোগ্যতা রয়েছে। তিনি মেয়র পদের জন্য গভীরভাবে প্রত্যাশী ছিলেন। জেলার মন্ত্রী, আ ক ম মোজাম্মেল হক, এমপি সাবেক মন্ত্রী রহমত আলী ও জাহিদ আহসান রাসেল আজমতের পক্ষে অপ্রকাশ্যে শক্ত অবস্থান নেন। দলের মনোনীত মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর আলম অঢেল অর্থবিত্ত গুনে দলের তরুণ কর্মীদের একটি বড় অংশ হাত করে নেন। মসজিদ, মাদ্রাসায় প্রচুর অর্থ দিয়েছেন। কিন্তু টাকায় যে ভোট আসে না, আওয়ামী লীগের বয়স্ক নেতা-কর্মী ও ভোটার সাধারণের নির্লিপ্ততাই তার প্রমাণ দেয়। জাহাঙ্গীরের মনোনয়ন পাওয়ার ব্যাপারে মুখ্য ভূমিকা রাখেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের। তিনি ড. আবদুর রাজ্জাকের নেতৃত্বে কেন্দ্রীয় কমিটি ছাড়াও বিপুলসংখ্যক কেন্দ্রীয় নেতাকে গাজীপুর পাঠাচ্ছেন। কিন্তু স্থানীয় প্রবীণদের সক্রিয় করতে পারছেন না। অবস্থাটা এতটাই ভয়াবহ আকার নেয় যে শিমুলিয়া ইউনিয়ন আওয়ামী লীগ নেতাকে দিয়ে হাইকোর্টে রিট পর্যন্ত করানো হয়। বিস্ময়করভাবে এই রিটকারীর পক্ষে শুনানিতে অংশ নেন বিএনপির নেতা ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ। আইনজীবী হিসেবে একি নিতান্তই অর্থের জন্য?
সরকারদলীয় মেয়র প্রার্থী জাহাঙ্গীর রিটের জন্য আওয়ামী লীগেরই একটি প্রভাবশালী চক্রকে দায়ী করেন। রিট আবেদনকারী আজমতউল্লাহর ভায়রা ভাই। নাম প্রকাশ না করলেও জাহাঙ্গীর কি আজমতকেই দায়ী করছেন? নেপথ্যে সরকারের কোন কোন মন্ত্রী, এমপি, কেন্দ্রীয় নেতা যে রয়েছেন, তা অস্পষ্ট নয়। এই ঘটনা দলীয় প্রধান শেখ হাসিনাকে ক্ষুব্ধ করবে এবং তিনি নেপথ্যের সহযোগীদের খুঁজে বের করবেন, সাধারণ এই বিষয়টি জেনেও তারা জাহাঙ্গীরের বিপক্ষে গিয়ে ঝুঁকি নিলেন কেন? বিপুল অর্থবিত্তের মালিক এবং দলের ওপর মহলে ব্যাপক প্রভাব থাকায় জাহাঙ্গীর আগামীতে এমপি, মন্ত্রীও হয়ে যেতে পারেন, বিশেষ করে জেলার রাজনীতিতে একচ্ছত্র আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করে নেবেন-এমনি সব তাড়া থেকেই জেলার সব নেতা জোটবদ্ধ হয়ে জাহাঙ্গীরবিরোধী অবস্থান নিয়েছেন।
গাজীপুর সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি বিপুল ভোটের ব্যবধানে হেরেও যায়, তা সরকারের জন্য বড় ধরনের রাজনৈতিক ক্ষতি ডেকে আনবে না বলেই দলের অনেক নেতা মনে করেন। আগামী নির্বাচনে স্থানীয়ভাবে কিছু প্রভাব পড়লেও জাতীয়ভাবে তেমন ক্ষতি হবে না বলেই তাদের ধারণা। কিন্তু সবচেয়ে উদ্বেগজনক ও ক্ষতিকর দিকটি হলো অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব-বিরোধের অত্যন্ত ন্যক্কারজনক বহিঃপ্রকাশের ঘটনা।
আওয়ামী লীগ থেকে কেন্দ্রীয়ভাবে কমিটি করে প্রতিটি নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান এমপি ও সম্ভাব্য প্রার্থীদের সম্পর্কে খোঁজখবর নেওয়া হয়েছে। ইউনিয়ন, উপজেলা, জেলা থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে। শীর্ষ পর্যায় থেকে একাধিক বেসরকারি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার মাধ্যমে জরিপ চালানো হয়েছে। এই সংস্থাগুলোর মধ্যে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের একজন উপদেষ্টার মালিকানাধীন একটি সংস্থা উদ্বেগজনক তথ্য দিয়েছে। তারা প্রায় ১১৭-১২০টি নির্বাচনী এলাকায় ভয়াবহ অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের চিত্র তুলে ধরেছে। এসব আসনে সরকারি দলকে তাদেরই বিদ্রোহী প্রার্থীদের মোকাবিলা করতে হবে বলে সতর্ক করা হয়েছে। দ্বন্দ্ব-বিরোধ এতটাই প্রকট যে শীর্ষ পর্যায় থেকে নির্দেশ এলেও তা প্রতিপালিত না-ও হতে পারে। এর সুযোগ নেবে প্রতিপক্ষ দলীয় প্রার্থীরা।
আওয়ামী লীগের একজন প্রেসিডিয়াম সদস্য নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ৬০-৭০টি নির্বাচনী এলাকায় বর্তমান দলীয় এমপির বিরুদ্ধে একাধিক প্রার্থী রয়েছেন। বর্তমান এমপিকে মনোনয়ন দেওয়া হলে তারা তাকে মেনে নেবেন না। আরো কম করেও ২৭ থেকে ৩০টি আসনে দলের অপেক্ষাকৃত যোগ্য, জনপ্রিয় প্রার্থী রয়েছেন। বর্তমান এমপিরা ব্যক্তিগত ও গোষ্ঠীগত স্বার্থ নিয়ে অধিকতর ব্যস্ত থাকায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের কর্মী ও সাধারণ মানুষ থেকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েন। অতি সাম্প্রতিক সময়ে এলাকায় যাতায়াত ও গণযোগাযোগ বাড়ালেও তারা অনেক পিছিয়ে আছেন। সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছে ভোট কাছাকাছি থাকায় সবই ভোটের স্বার্থে। ১৪ দলের শরিকদের অধিকাংশ আসনেই আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়, যোগ্য প্রার্থী রয়েছে। এ রকম প্রায় ২৫টি নির্বাচনী এলাকা রয়েছে, যেখানে আওয়ামী লীগের সম্ভাব্য প্রার্থীরা ছাড় দিতে নারাজ। তারা পুরোদস্তুর নির্বাচনী কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছেন। অধিকাংশ এলাকায়ই বর্তমান এমপিরা কোণঠাসা হয়ে পড়েছেন। ৫ জানুয়ারির ভোটারবিহীন নির্বাচনে পরিস্থিতি সামাল দিতে এদের মনোনয়ন দেওয়া হয় এবং আওয়ামী লীগের নেতারা তা মেনে নিতে বাধ্য হন। এবার তাদের বিরত রাখা শীর্ষ নেতৃত্বের পক্ষে কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। দল থেকে মনোনয়ন না পেলেও তারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হয়েই মাঠে নেমেছেন। স্থানীয় কর্মীদের বড় অংশই এদের সঙ্গে। শতাধিক আসনে নিজেদের মধ্যকার বিরোধ দলের জন্য শুভ ইঙ্গিতবাহী নয়। বিএনপি আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বের সুযোগ নেবে পুরো মাত্রায়। বিদ্যমান সংকটের চেয়ে অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব দলের শীর্ষ নেতাদের দুশ্চিন্তায় রেখেছে। সেই সঙ্গে রয়েছে ১৪ দলের শরিকদের ছাড় দেওয়ার বিষয়। দলীয় প্রার্থীর বাইরে শরিক দলের প্রার্থী চাপিয়ে দিলে আওয়ামী লীগের তৃণমূলের নেতা-কর্মীদের উল্লেখযোগ্য অংশই তাকে মেনে নেবে না। নির্বাচনে সক্রিয় ভূমিকায় তাদের না-ও দেখা যেতে পারে। গাজীপুরের অভিজ্ঞতা শীর্ষ নেতৃত্বকে এ বিষয়ে ভাবিয়ে রেখেছে। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য গত এক বছর যাবৎ চেষ্টা করা হচ্ছে। কিন্তু ফল হয়নি। এমনকি এই বিরোধ সামনে রক্তক্ষয়ী রূপও নিতে পারে। জটিল, স্পর্শকাতর বিষয়টির গ্রহণযোগ্য সুরাহা না হলে নির্বাচনে ফল ঘরে না আসার সম্ভাবনাকেও হালকা করে দেখা হচ্ছে না।