নিজস্ব প্রতিনিধি : সংঘাত-সংঘর্ষ, রক্তপাত ও অসংখ্য হতাহতের ঘটনার মধ্য দিয়ে চলতি বছর ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা পরিষদ নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে। আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর সম্ভাব্য প্রভাব-প্রতিক্রিয়া নিয়ে চিন্তিত সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
পাঁচ হাজার ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রায় ২০ হাজারের বেশি প্রার্থী ছিলেন আওয়ামী লীগের। তারা প্রত্যেকেই ইউনিয়ন ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সহসভাপতি, সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা আওয়ামী লীগের অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, সাংগঠনিক সম্পাদক। অর্থাৎ আওয়ামী লীগের ইউনিয়ন, উপজেলা পর্যায়ের নেতৃস্থানীয় প্রভাবশালী পাঁচ হাজার স্থানীয় নেতা দলীয় মনোনয়ন পান। মনোনয়নবঞ্চিত হন অবশিষ্ট প্রায় ১৫ হাজার স্থানীয় নেতা, সংগঠক। নির্বাচনে প্রায় প্রতিটি ইউনিয়নে হিংসাত্মক ঘটনা ঘটেছে। মিছিল-সমাবেশে গোলযোগ, হামলা, হানাহানি, প্রাণহানি ও অসংখ্য মানুষ আহত হয়েছে। নজিরবিহীন সংঘাত-সংঘর্ষ, রক্তপাতের নির্বাচন ব্রিটিশ আমলে স্থানীয় সরকারব্যবস্থা চালু হওয়ার পর আর কোনো সময়েই হয়নি। দলীয় মনোনয়ন-ব্যবস্থা প্রবর্তনের পরিপ্রেক্ষিতে তৃণমূল পর্যায়ে রাজনীতির বিষাক্ত বীজ বপিত হলো। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক ও স্থানীয় সরকার নির্বাচন পর্যবেক্ষক ও বিশ্লেষকদের মতে, সমাজজীবন ও রাজনৈতিক জীবনে আগামী কয়েক দশক এর অশুভ প্রভাব হয়তো থেকেই যাবে।
এ কারণেই প্রধানত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সরকার চিন্তিত। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন সাধারণত ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনাময় পরিবেশে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে। গত নির্বাচনেই এর লক্ষণীয় ব্যতিক্রম দেখা যায়। গ্রামের ভোটারদের অধিকাংশই ভোটকেন্দ্রের ধারেকাছে আসেননি। যদিও প্রয়োজনীয় ও তার অধিকসংখ্যক ভোটারের উপস্থিতি, সক্রিয় অংশগ্রহণ দেখানো হয়েছে। সরকারের নীতিনির্ধারকদের সংশয়-শঙ্কা, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বৈরী প্রভাব জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পড়তে পারে।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সব দলের ব্যাপক অংশগ্রহণ, প্রতিনিধিত্বমূলক, বিপুলসংখ্যক ভোটারের সক্রিয় ও স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে দেখতে চায় জাতিসংঘসহ প্রভাবশালী রাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো। ইউনিয়ন পরিষদসহ স্থানীয় সরকার সংস্থাসমূহের গত নির্বাচনে ব্যাপক রক্তপাত ও হিংসাত্মক ঘটনা ঘটায় সরকারের আশঙ্কা, জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অনেক ভোটার ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত না-ও থাকতে পারেন। ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ এবং তার অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের বিপুলসংখ্যক যোগ্য, জনপ্রিয় নেতা মনোনয়ন পাননি। স্থানীয় এমপির একান্ত ঘনিষ্ঠ অনেক নেতা দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। স্থানীয় এমপি ইউনিয়ন, উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের বাধ্য করেছেন তার সুপারিশের ভিত্তিতে মনোনয়নের জন্য নাম স্থির করতে। মনোনয়নবঞ্চিতরা স্থানীয় এমপির বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছেন। নির্বাচন বেশ কিছুদিন আগে হয়ে গেলেও এখনো অনেকে প্রকাশ্যেই এমপির বিরোধিতা করছেন। সরকারের জন্য উদ্বেগজনক হলো অনেক নির্বাচনী এলাকার ইউনিয়ন পরিষদসমূহের চেয়ারম্যান পদে মনোনয়নবঞ্চিত এবং তাদের একান্ত ঘনিষ্ঠ মেম্বার, প্রভাবশালী ব্যক্তিরা দলীয়ভাবে বর্তমান এমপি দলীয় মনোনয়ন পেলে তার পক্ষে কাজ করার সম্ভাবনা কম। বরং তারা প্রকাশ্যে না হলেও গোপনে বিপক্ষে কাজ করবেন। তাদের মধ্যে হতাশা, ক্ষোভ এতটাই প্রবলভাবে জমে আছে যে নিজস্ব মোটা অঙ্কের অর্থ ব্যয় করে হলেও ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে তাদের বিপক্ষে অবস্থানকারী দলীয় এমপি পদে মনোনয়ন লাভকারীর বিরুদ্ধে জোরালোভাবে কাজ করবেন। অনেকে সে ধরনের প্রচার-প্রচারণা এরই মধ্যে শুরু করেছেন। জেলার সভাপতি, সাধারণ সম্পাদকসহ অন্য অনেক প্রভাবশালী নেতা চেষ্টা করেও তাদের দমিত করতে পারছেন না। খোদ দলীয় প্রধান শেখ হাসিনা হস্তক্ষেপ করলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে পারে। তবে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বিদ্রোহীদের ক্ষোভ এতই তীব্র যে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানের পরও দলীয় বৃহত্তর স্বার্থ বিবেচনায় তাদের সক্রিয় ভূমিকা নেওয়ার সম্ভাবনা কম। যার সুফল বিরোধী পক্ষ নেবে।