নিজস্ব প্রতিনিধি : দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক শক্তির প্রতিনিধিত্বকারী বিএনপি শেষ পর্যন্ত আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কি অংশ নিচ্ছে! নির্বাচনে অংশ নেবে নাকি বর্জন করে বড় ধরনের রাজনৈতিক ক্ষতির পথ প্রশস্ত করবেÑকঠিন এ বাস্তবতার মুখোমুখি দলটি। সার্বিক বিবেচনায় দলটির শীর্ষ নেতৃত্ব দ্রুত প্রস্তুতি নেওয়ার নির্দেশনা দিতে যাচ্ছেন বলে লন্ডনে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রক্ষকারী বিএনপির শীর্ষস্থানীয় একজন নেতা জানিয়েছেন।
বিএনপির শীর্ষস্থানীয় কয়েকজন নেতা শীর্ষ নেতৃত্বের ইতিবাচক মনোভাবের কথা জানিয়ে নেতাদের সুচিন্তিত সিদ্ধান্ত নেওয়ার জন্য বলেছেন বলে জানা যায়। ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা প্রধান নেতাসহ স্থায়ী কমিটির সব সদস্যের সঙ্গে এরই মধ্যে মোবাইলে কথা বলেছেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা-সংক্রান্ত নীতি ঘোষণার পর তিনি তার মনোভাবের কথা জানানোর পাশাপাশি নেতাদের সার্বিক দিক বিচার-বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেন।
বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নিলেও সরকার নির্বাচন করিয়ে নেবে। নির্বাচন প্রতিহত করতে গিয়ে হিংসাত্মক ঘটনার দায় সরকার বিএনপির নেতাকর্মীদের ওপর চাপাবে। হামলা-মামলায় নেতাকর্মীদের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। মার্কিন ভিসানীতির দায় বিএনপিও এড়াতে পারবে না বলেই সরকারি মহল মনে করে।
বিএনপি অংশ না নিলে সরকার তার সমমনাদের সঙ্গে আসন বণ্টন করে নির্বিঘ্নে নির্বাচন করিয়ে নেওয়ার অবারিত সুযোগ পাবে। বিএনপির উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নেতা, সাবেক এমপির নির্বাচনে শরিক হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। জামায়াতসহ ধর্মীয় বেশ কয়েকটি সংগঠনকে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ সরকারিভাবে করে দেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডসহ সব রকম সুযোগ-সুবিধা সব রাজনৈতিক দলকে দেওয়া হবে। সরকারের নির্বাচনী তৎপরতাকে বাধাগ্রস্ত করলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির আওতায় পড়ার পাশাপাশি রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে বিএনপি। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্র অবাধ, নিরপেক্ষ, সুষ্ঠু নির্বাচন চায়। বিএনপি বা কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলে সে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না, সে কথা তারা বলেনি। তারা প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথাও বলেনি।
অন্যদিকে সরকার মার্কিন ভিসানীতিতে চিন্তিত নয়। ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে আওয়ামী লীগ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনে তারা সব দলের অংশগ্রহণ চান। সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থেই তা প্রয়োজন বলে বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের বহুমাত্রিক নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। গার্মেন্টসামগ্রীসহ রফতানি বাণিজ্যের সবচেয়ে বড় একক অংশীদার তারা। সরকার ও বিরোধী দলকে এক কাতারে দেখে যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষিত ভিসানীতিতে বিএনপিরও দায়িত্ব রয়েছে। সরকারি দলের নেতাদের মতে, ভিসানীতির ফলে বিএনপির উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। সরকার চিন্তিত নয়। কারণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও তার সরকার সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে অঙ্গীকারবদ্ধ। প্রধানমন্ত্রীর এই প্রকাশ্য অঙ্গীকারে আস্থা রেখে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন-প্রক্রিয়াকে শক্তিশালী করতেই যুক্তরাষ্ট্র ভিসানীতি ঘোষণা করেছে। আওয়ামী লীগ নেতারা মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে জানিয়েছেন, জ্বালাও-পোড়াও রাজনীতি কঠোরভাবে দমন করা হবে। নির্বাচনী প্রক্রিয়া ব্যাহতকারী যেকোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সরকারও আইনগত ব্যবস্থা নিতে কুণ্ঠিত হবে না।
জানা যায়, মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে বৈঠকে বিএনপির প্রতিনিধিরা সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, জালিয়াতি ও কারচুপিমুক্ত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারপ্রধান ও সরকারের মন্ত্রীদের অঙ্গীকারে আশ্বস্ত নন। এ প্রসঙ্গে ২০১৪ ও ২০১৮ এর নির্বাচন-পূর্ববর্তী সরকারের অঙ্গীকারের কথা উল্লেখ করে বলেন, সরকার সেসব অঙ্গীকার মোটেই রক্ষা করেনি। রাষ্ট্রদূত বিএনপির নেতাদের আশ্বস্ত করলেও তারা অভিজ্ঞতার আলোকে তাতে আশ্বস্ত হতে পারছেন না বলেও জানান। অধিকতর কার্যকর নিষেধাজ্ঞা আরোপের ওপর জোর দেন বিএনপির নেতারা। আলোচনায় অংশগ্রহণকারী একজন নেতা নাম গোপন রাখার শর্তে আরও জানান, রাষ্ট্রদূত বিএনপির নেতাদের সুস্পষ্টভাবে বলেছেন, বিগত নির্বাচনে যা হয়েছে এবার সে রকম হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। সে ক্ষেত্রে সরকারকে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হবে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে বিএনপির নেতারা মার্কিন জোরালো অবস্থান নেওয়ার জরুরি তাগিদ নিয়ে এ ব্যাপারে মার্কিন বক্তব্য ও অবস্থান দাবি করেন। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার কথা উল্লেখ করে মার্কিন সীমাবদ্ধতার কথা জানানো হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র জানায়, ঢাকাস্থ মার্কিন রাষ্ট্রদূত বিএনপি নেতাদের সুষ্ঠু, শান্তিপূর্ণ নির্বাচনে প্রতিবন্ধক না হয়ে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার বিষয় বিবেচনার জন্য বলেন। তিনি বলেন, সব রাজনৈতিক দলের সদিচ্ছা অংশগ্রহণ না থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন সম্ভব নয়। মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে সাংবাদিকদের কাছে বিএনপির নেতা আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী এই বলে প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন, ভোট কারচুপি নিয়ে সরকারকে সুস্পষ্ট বার্তা দেওয়া হয়েছে। সরকারকে তা বিবেচনায় নিতে হবে।
জানা যায়, নতুন মার্কিন ভিসানীতি ঘোষণার প্রেক্ষাপটে বিরোধী দল বিএনপি অনেকটা ফাঁদে আটকা পড়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদত্যাগ এবং তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবি তাদেরকে অঘোষিতভাবে পরিহার করতে হবে। সরকার বরাবরই এর প্রবল বিরোধী। এ ব্যাপারে বিএনপির প্রতি মার্কিন সমর্থন, সহযোগিতার আভাস নেই। ভবিষ্যতে সমর্থনের আশ্বাসও নেই। নির্বাচন করতে হলে বিএনপিকে দীর্ঘদিনের মূল এ দাবি থেকে সরে আসতে হবে। এতে রাজনৈতিকভাবে বিএনপি দেশবাসীর কাছে হেয় হবে, আবার নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন-পরবর্তী পরিস্থিতি সামাল দেওয়া বিএনপির পক্ষে সম্ভব হবে কি না সে প্রশ্নও রয়েছে। দলগতভাবে অংশ না নিলেও বিএনপির অনেক নেতাকর্মীকে নির্বাচন থেকে দূরে রাখাও সহজ হবে না। এমনই অবস্থায় দারুণ দোটানায় পড়েছেন দলের নীতিনির্ধারক ও শীর্ষস্থানীয় নেতারা। শীর্ষ নেতা তারেক রহমান নির্বাচনে অংশগ্রহণ প্রশ্নে অপেক্ষাকৃত নমনীয় মনোভাব নিলেও সিদ্ধান্ত নেননি। দলের সিনিয়র নেতাদের, স্থায়ী কমিটির সদস্যদের মতামত ও সম্মিলিত সিদ্ধান্ত চেয়েছেন। পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে দলের বিশেষ কাউন্সিলও আহ্বান করা হতে পারে। এককভাবে সিদ্ধান্ত নেওয়ার দৃঢ়তাও তারেক রহমান দেখাতে পারছেন না।