নির্বাচন আয়োজন নিয়ে মহাদুশ্চিন্তায় ইসি

নূরুল ইসলাম : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের বাকি আর মাত্র ৯ মাস। দিন যতই ঘনাচ্ছে ততই রহস্যের সৃষ্টি হচ্ছে। দেশের প্রথম সারির নাগরিক ও সংশ্লিষ্ট কেউ বুঝতেই পারছেন না এবার দ্বাদশ নির্বাচনে কী ঘটতে পারে। গোয়েন্দা সংস্থার কাছেও আগাম কোনো তথ্য নেই। বিশেষজ্ঞদের মতে, চব্বিশের ভোট ইতিহাসের বড় একটি অধ্যায় হতে যাচ্ছে-এমন ইঙ্গিত বহন করছে। তবে এবার নির্বাচনের ফরম্যাট অতীতের চেয়ে ভিন্ন কিছু ঘটতে পারে-রাজনীতিপাড়ায় এটিই বেশি শোনা যাচ্ছে। কারণ সরকার ও নির্বাচন কমিশনে এবার অতীতের চাইতে ভিন্ন রকম কূটনৈতিক মহলের চাপ রয়েছে। জনগণ যে নির্বাচনকে স্বচ্ছ, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক বলে রায় দেবে, সেই নির্বাচনই তারা দেখতে চেয়েছেন। জনগণের ভোটের অধিকার ও মানবাধিকার বিষয়গুলো সমুন্নত রাখতে সরকারকে কড়া বার্তা দিয়েছেন কূটনীতিকেরা।
১৭ বছর ক্ষমতার বাইরে থাকা বিএনপি শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে যাবে না বলে এখন পর্যন্ত অটল। ক্ষমতার হ্যাটট্রিক সময় পার করা আওয়ামী লীগও স্পষ্ট জানিয়েছে, সংবিধানের বাইরে যাওয়ার সুযোগ নেই। ভোট সামনে রেখে দুই দলের বিপরীতমুখী রাজনৈতিক অবস্থানের বার্তায় মহাদুশ্চিন্তায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। সব রাজনৈতিক দল ভোটে না এলে নির্বাচন গ্রহণযোগ্য হবে না-এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটি। এ জন্য সবাইকে নিয়ে নির্বাচন আয়োজনে বিএনপিকে বারবার আলোচনার জন্য আহ্বান করে যাচ্ছে ইসি। কিন্তু তাদের সাড়া পাচ্ছে না। অন্যদিকে ভোট সুষ্ঠু করার জন্য বিদেশিদের অব্যাহত চাপেও চিন্তিত ইসি। কারণ গ্রহণযোগ্য নির্বাচন উপহার দিতে না পারলে এবার দেশি-বিদেশি কোনো মহলই তা মেনে নেবে না।
সংলাপ কিংবা আলোচনা যে ইস্যুতেই হোক না কেন, নির্বাচন কমিশনের তৎপরতা বেড়েছে। বিএনপিসহ সব দলকে ভোটে আনতে তাদের চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নতুন নতুন সিদ্ধান্তও নেওয়া হচ্ছে। এর সর্বশেষ সংযোজন ইভিএম একেবারে বাতিল করে দেওয়া। হঠাৎ নির্বাচন কমিশনের এই তৎপরতা নজরে এসেছে নির্বাচন বিশ্লেষকদের। এ নিয়ে প্রশ্নও জেগেছে তাদের মনে-হঠাৎ কেন এত তৎপর ইসি? তবে এ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে মিশ্র অবস্থান দেখা গেলেও তা ইতিবাচকভাবেই দেখছেন কোনো কোনো নির্বাচন বিশ্লেষক। তাদের মতে, ভোটের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক সংকট। তাই সবার আগে দরকার রাজনৈতিক বোঝাপড়া। এটা সরকার ও বিরোধী দলকে করতে হবে। তা না হলে নির্বাচন কমিশন সর্বোচ্চ চাইলেও অংশগ্রহণমূলক ও সন্তোষজনক নির্বাচন আয়োজন করতে পারবে না।
অন্যদিকে নির্বাচন কমিশনের তৎপরতাকে মুখে ইতিবাচক বললেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কিছুটা নাখোশ। দলের সিনিয়র নেতারা বলছেন, নির্বাচন কমিশন স্বাধীন। তারা তাদের স্বাধীনতায় কাজ করছে। কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট দলের জন্য অতিরিক্ত দরদ ও আমন্ত্রণ জানানো ঠিক হবে না। বিএনপির জন্য বারবার সিদ্ধান্ত বদল করছে ইসি। ইভিএমের ঘোর বিরোধিতা করেছে বিএনপি। কিন্তু আমরা তার পক্ষে ছিলাম। আর নির্বাচন কমিশনের প্রতিটি পদক্ষেপকেই বিএনপি আড় চোখে দেখছে। তবুও বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে কমিশনের দরদ উথলে উঠেছে।
রাজনৈতিক অভিজ্ঞরা বলছেন, আগামী নির্বাচনে বিএনপি আসলে কী করতে যাচ্ছে, সরকার কিছুই বুঝতে পারছে না। এ জন্য সরকার বারবার বিএনপিকে খোঁচা দিচ্ছে কথা বের করতে। কিন্তু বিএনপিও এবার সূক্ষ্মভাবে ভোটের পলিসি নিয়ে হাঁটছে। বাধার বাঁধ ভেঙে, হামলা-নির্যাতন, কারফিউ পরিস্থিতিতেও কর্মসূচি বাস্তবায়ন করে কোমর সোজা করে দাঁড়িয়েছে। তৃণমূলকে শক্তভাবে দাঁড় করিয়েছে দলটি। কেন্দ্রীয় নেতারা কর্মসূচি বাস্তবায়নে জেলায় জেলায় ছুটে যাচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে বিএনপি কি আন্দোলন করেই সরকারকে ঠেকানোর চেষ্টা করবে নাকি ভোট বর্জন করে একটি বিতর্কিত পরিবেশ সৃষ্টি করতে চাচ্ছে, আওয়ামী লীগের ঘরে এমন কোনো সঠিক বার্তা নেই। দুই দলের মরণকামড়ের প্রস্তুতিতে অনেক অঘটনের জন্ম দিয়ে তৃতীয় শক্তির আবির্ভাবকেও অনেকে উড়িয়ে দিচ্ছেন না।
বিএনপির দলীয় সূত্রগুলো বলছে, নির্বাচনের আগে বিএনপি হরতাল-অবরোধের মতো কোনো কর্মসূচিতে যাবে না। ঢাকা ঘেরাও, সচিবালয় ঘেরাও, ঢাকামুখী লং মার্চ, রোড মার্চ, চলো চলো ঢাকা চলো-এ ধরনের মধ্যম কর্মসূচি নিয়ে ভাবা হচ্ছে। মে ও জুন মাসে দেশের পাঁচটি জনবহুল ও গুরুত্বপূর্ণ সিটি করপোরেশনে যে নির্বাচন হবে, তাতে অংশ নেবে না বিএনপি। সম্প্রতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-২ আসনের উপনির্বাচনে উকিল আবদুস সাত্তার দলছুট প্রার্থী হয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সমর্থন পেয়ে জয়ী হন। উকিল সাত্তারের মতো কেউ প্রার্থী হয়ে বসেন কি না, সেই শঙ্কাও বিএনপির ঘরে বেশি কাজ করছে। তাই বিএনপি দলের চেয়ারম্যানের বার্তা নিয়ে তৃণমূলে পৌঁছে যাচ্ছে। সরকারের বড় উদ্দেশ্য রয়েছে বিএনপিকে ভাঙা, সেটি প্রতিরোধের সঙ্গে ভোটের পলিসির পদক্ষেপগুলোও মাঠের অবস্থান থেকে জেনে নিচ্ছেন তারেক রহমান। তবে শেষবেলায় সিদ্ধান্ত কী, তা একমাত্র তারেক রহমানই জানেন বলে বলছে দলটির হাইকমান্ড। ভোটে যাওয়া না যাওয়া, কিংবা ভোট রাজনীতির অনেক কিছুই দলটির শীর্ষ নেতারা ইঙ্গিত পেতেন। এবার তারেক রহমান ছাড়া কেউ সঠিক কোনো বার্তা জানেন না।
অন্যদিকে সাংগঠনিক শক্তিতে মজবুত আওয়ামী লীগ। সরকারবিরোধী আন্দোলন করে সরকারের পতন ঘটানো ও সরকারে থেকে সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছে দলটি। নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলন যেমন সফলতার সঙ্গে করেছে আওয়ামী লীগ, তেমনি বিএনপি-জামায়াত জোটের বিরুদ্ধে আন্দোলন করে ওই সরকারের পতন ঘটিয়েছে দলটি। অভিজ্ঞতার ঝুড়িতে আওয়ামী লীগের সব ধরনের সফলতা রয়েছে। তাই আগামী দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে যেকোনো বাধাই আসুক মোকাবিলার সক্ষমতা রাখে দলটি, এমনই মনে করা হচ্ছে।
সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজনের সাধারণ সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বাংলাদেশের সব নির্বাচনের আগে-পরে অনেক রহস্য থাকে। এবারও রয়েছে। তবে এবারের বার্তার চূড়ান্ত কিছু এখনই বলা যাচ্ছে না।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) এম. সাখাওয়াত হোসেন বলেন, এখনো অনেক বাকি আছে সংসদ নির্বাচনের। নির্বাচন এলে ঝুঁকি থাকে। এখনো যেহেতু আরও সময় রয়েছে, অনেক কিছু দেখার বাকি আছে। রাজনীতির স্বাভাবিক ইস্যুগুলো এখন চলছে। নির্বাচনে কী ঘটবে, সেই আভাস আগের মতো এবার পাওয়া যাচ্ছে না।