
আহবাব চৌধুরী খোকন :
দেশে একদিকে শেষ হচ্ছে বহুল সমালোচিত ও নিন্দিত বর্তমান নির্বাচন কমিশনের (নুরুল হুদা কমিশন) মেয়াদ আর অন্যদিকে চলছে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নাটক। মনে হচ্ছে, রাষ্ট্রপতি সংলাপের মাধ্যমে করিতকর্মা নির্বাচন কমিশনের সন্ধানে গঠন করতে চান সার্চ কমিটি, যেন তার এই কমিটি গঠনের মধ্যে আটকে আছে নির্বাচন কমিশন গঠনের তাবৎ কাজ। যদিও সংলাপের আমন্ত্রণ সরকারি দল আওয়ামী লীগ ও তাদের সমর্থনপুষ্ট কিছু দল ব্যতীত অনেক রাজনৈতিক সংগঠন প্রত্যাখ্যান করেছে। মহামান্য রাষ্ট্রপতি খুব সৎ ও অমায়িক লোক, তাতে সন্দেহ নেই। তাঁর সহজ-সরল অভিব্যক্তির জন্য দেশের অনেক মানুষ তাঁকে ভালোবাসে। আমি তাঁকে অনেকবার দুঃখ করে জনসম্মুখে বলতে শুনেছি, তাঁর ক্ষমতা খুব সীমিত। দেশের সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করে, একটি শক্তিশালী নির্বাচন কমিশন গঠন করার ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির থাকলেও সেই সক্ষমতা তিনি এখনো অর্জন করতে পারেননি। সরকার যাকে দিয়ে স্বার্থসিদ্ধি হবে, হোক সে নুরুল হুদার চেয়েও অধম, তাকে খুঁজে বের করবে এবং রাষ্ট্রপতি অবশেষে সেই নাম ঘোষণা করবেন। তবে প্রশ্ন থেকে যায়, কেন এই সংলাপ নাটক?
পাঁচ বছর আগে রাষ্ট্রপতি যখন সকল রাজনৈতিক দলকে এই সংলাপের জন্য আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন, তখন আমরা দেখেছি আওয়ামী লীগ, বিএনপিসহ প্রায় সব রাজনৈতিক সংগঠন সেই সংলাপে অংশগ্রহণ করেছিল। আমার যতটুকু মনে পড়ে, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্বয়ং সংলাপে যোগ দিয়েছিলেন। কিন্তু সেই সংলাপের কোনো সুফল আমরা দেখতে পারিনি। বরং সবাই বিস্ময়ের সঙ্গে লক্ষ করেছে, সেই সংলাপে দেশের অভিজ্ঞ সুশীল সমাজ ও বিজ্ঞ রাজনৈতিক নেতাদের পক্ষ থেকে যেসব সুপারিশ এসেছিল, তা সম্পূর্ণভাবে অবজ্ঞা করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি অযোগ্য একজন লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার পদে নিয়োগ দিয়ে নিজের বিশ্বাসযোগ্যতা ও নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন। তাই এবারের সংলাপকে শুরু থেকে না জানিয়েছে সরকারবিরোধী অনেক রাজনৈতিক দল। কথায় আছে না, ন্যাড়া বেলতলায় একবারই যায়। দেশে ভালো লোকের কি এত আকাল পড়েছিল যে একজন অবসরপ্রাপ্ত সচিবকেও তখন খুঁজে পাওয়া যায়নি। নুরুল হুদার মতো যুগ্ম সচিব (অবসরপ্রাপ্ত) মর্যাদার একজন লোককে প্রধান নির্বাচন কমিশনার দেখতে হলো! আর সেই নুরুল হুদা মার্কা কমিশন কী ধরনের নির্বাচন দেশের মানুষকে গত পাঁচ বছর উপহার দিয়েছে, জনগণ সেটা দেখেছে। এখন জনগণকে কিছু বলতে হচ্ছে না, নির্বাচন কমিশনের কমিশনার খোদ মাহবুব তালুকদারের ভাষায় নুরুল হুদা কমিশনের অধীনে দেশের নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্র এখন লাইফ সাপোর্টে আছে।
সুহৃদ পাঠক, রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের এই দায়সারাগোছের সংলাপ দেখে আমার নিধিরাম সর্দারের কথা মনে পড়ে গেল। অনেকেই হয়তো গল্পটি শুনেছেন। এক এলাকায় নিধিরাম সর্দার নামের এক লোক ছিলেন। তিনি দেখতে যেমন ছিলেন মোটাসোটা, তেমনি নিজেকে খুব সাহসী বলে সর্বত্র জাহির করতেন। ভাবখানা এমন যে, তার এই সাহসের নিকট কেউ কিছু নয়। এলাকার মানুষও এমন সাহসী লোককে পেয়ে ধন্য। একদা দিনের বেলায় একদল ডাকাত এলাকায় ঢুকে অস্ত্রের ভয় দেখিয়ে সাধারণ মানুষের সবকিছু নিয়ে যায়। পরের দিন লোকজন নিধিরাম সর্দারকে জিজ্ঞাসা করেছিল, তুমি এত সাহসী অথচ ডাকাত ঢুকে সবকিছু নিয়ে গেল, আর তুমি কিছুই করতে পারলে না। জবাবে নিধিরাম সর্দার বলেছিল, তোমরা আমাকে ঢাল-তলোয়ার কিছু দাওনি। ডাকাতের অস্ত্রের সামনে আমার কী করার আছে? আমাদের মহামান্য রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন তেমনি এক ঢাল ও তলোয়ারবিহীন নিধিরাম সর্দার। নিজের কোনো সক্ষমতা নেই, অথচ রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে সংলাপ করে নিজের ক্ষমতা দেখাচ্ছেন। পরে দেখা যাবে, শেখ হাসিনা সরকারের প্রেসক্রিপশন অনুযায়ী কমিশনে নুরুল হুদা মার্কা কিছু লোকের নাম ঘোষণা দিয়ে মূল দায়িত্ব সম্পন্ন করবেন। এই যদি হয় অবস্থা, তাহলে সংলাপের নামে সময় ও অর্থ অপচয়ের কী প্রয়োজন?
নির্বাচন কমিশন গঠন নিয়ে রাষ্ট্রপতির ডাকা সংলাপে অংশগ্রহণ না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশের অন্যতম বৃহত্তম দল বিএনপি। রাষ্ট্রপতির সাথে সংলাপকে অর্থহীন বলে তাতে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দলটি। সংলাপে যোগদানে অপারগতা প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি)। দলের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কারের জন্য ৫৩টি সুনির্দিষ্ট সুপারিশমালা ২০১৭ সালের জানুয়ারি মাসে সিপিবি রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করেছে। কিন্তু সেগুলো বাস্তবায়নে কোনো পদক্ষেপ নেই। এমতাবস্থায় সিপিবি আবার রাষ্ট্রপতির সাথে নতুন করে সংলাপে বসার কোনো প্রয়োজন দেখছে না। সংলাপে না যাওয়ার দলীয় সিদ্ধান্ত জানিয়ে রাষ্ট্রপতিকে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ)। চরমোনাইয়ের পীরের নেতৃত্বাধীন ইসলামী আন্দোলনও সংলাপে না যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের আমির পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীম বলেন, দেশের বর্তমান প্রেক্ষাপটে নির্বাচন কমিশন গঠনের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে রাষ্ট্রপতির সংলাপ নিয়ে দেশের চিন্তাশীল মহল ও সাধারণ জনগণের মাঝে কোনো আগ্রহ নেই। অতীতের সংলাপ যেমন প্রত্যাশা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, চলমান সংলাপও তেমনি ব্যর্থ হবে।
নতুন নির্বাচন কমিশন (ইসি) গঠনে রাষ্ট্রপতির ডাকা চলমান সংলাপে অংশ নিচ্ছে না গণফোরাম (মন্টু)। গণফোরাম একাংশের সভাপতি মোস্তফা মহসীন মন্টু বলেছেন, সাবেক রাষ্ট্রপতি মরহুম জিল্লুর রহমান এবং বর্তমান রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের দুটি সংলাপে তারা অতীতে অংশগ্রহণ করলেও তাতে কোনো ফল হয়নি। এই সংলাপের কোনো পরামর্শ এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। বরং গত জাতীয় নির্বাচনে প্রশাসন ও পুলিশের নগ্ন হস্তক্ষেপ তারা লক্ষ করেছেন। গণফোরামের একাংশের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরীর ভাষায়, রাষ্ট্রপতির এই সংলাপ কার্যত একটি নাটকীয় আনুষ্ঠানিকতা মাত্র। চলমান সংলাপ দেশবাসীর কাছে আগের মতোই চাতুর্যপূর্ণ সংলাপ হিসেবে বিবেচিত হবে। তা ছাড়া আ স ম রবের নেতৃত্বাধীন জাসদ ও কর্নেল অলি আহমদের নেতৃত্বাধীন এলডিপি এই সংলাপে অংশ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত জানিয়েছে। সংলাপ প্রসঙ্গে এলডিপির চেয়ারম্যান কর্নেল অলি বলেছেন, আগেও সংলাপ হয়েছে, কিন্তু কাক্সিক্ষত ফল আসেনি। তাই এই সংলাপে যাওয়া অর্থহীন। চা খেতে ও জনগণের টাকা নষ্ট করতে বঙ্গভবনে যাবে না তাঁর দল এলডিপি। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ, জাতীয় পার্টি, জাসদ (ইনু), বিকল্পধারা বাংলাদেশসহ সরকার সমর্থক কিছু রাজনৈতিক দল রাষ্ট্রপতির এই সংলাপে যোগ দিয়েছে বা দিচ্ছে।
নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে পরামর্শ করে সার্চ কমিটি গঠন করবেন। এই সার্চ কমিটি একজন সিইসির জন্য একাধিক নাম ও চারজন ইসির জন্য আটজন সুনির্দিষ্ট ব্যক্তির নাম রাষ্ট্রপতির নিকট পেশ করবে। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনা সাপেক্ষে কেবল প্রস্তাবিত ব্যক্তিদের মধ্য থেকে সিইসি ও ইসি নিয়োগ দেবেন। কিন্তু ২০১২ ও ২০১৭ সালে দুটি সার্চ কমিটি গঠিত হলেও দেখা গেছে, সার্চ কমিটির কোনো সুপারিশ রাষ্ট্রপতির নিকট গ্রাহ্য হয়নি। বরং রাষ্ট্রপতি সরকারের ইচ্ছা অনুযায়ী তাদেরই আজ্ঞাবহ লোককে নির্বাচন কমিশনে নিয়োগ দিয়ে পুরো নির্বাচনব্যবস্থাকে বিতর্কিত করেছেন। রাষ্ট্রপতি যদি নির্বাচন কমিশন গঠনে কেবল প্রধানমন্ত্রীর পছন্দের ব্যক্তিদের প্রাধান্য দেবেন, তাহলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে কেন সংলাপ? নির্বাচন কমিশনের ত্রুটিপূর্ণ ও দুর্বল আইন বিদ্যমান রেখে শুধু সার্চ কমিটি গঠন কিংবা সংলাপ করে কোনো লাভ হবে না। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য সর্বাগ্রে নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা বাঞ্ছনীয়। একটি স্বাধীন ও শক্তিশালী নির্বাচন কমিশনই কেবল দেশে নিরপেক্ষ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে পারবে। অন্যথায় রাষ্ট্রপতির এই সংলাপ কিংবা সার্চ কমিটি গঠন লোক দেখানো বলেই সাধারণ মানুষের নিকট বিবেচিত হবে।
লেখক : কলামিস্ট ও কমিউনিটি নেতা, নিউইয়র্ক।