নির্বাচন দূরে থাকলেও কথা শুরু হয়েছে

প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে বাংলাদেশে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু হয়ে গেছে। পেছনে দড়ি টানাটানি, আন্দোলনের নামে দর-কষাকষি চলার খবরও পাওয়া যাচ্ছে। এবং এ কথা বিশ্বাস করা যায় যে, বাংলাদেশে যা রটে, বাস্তবে তা সবটা না হলেও কিছুটা বটে। রাজনীতির প্রবাহমান বাতাস থেকে অতি সাধারণ মানুষও কিছু কিছু আভাস পাচ্ছে। আমরা যারা নিজেরা নিজেদেরকে শিক্ষিত-পণ্ডিত বলে মনে করি, আর ভাবিÑসাধারণ মানুষেরা অশিক্ষিত-মূর্খ, ওরা কিছু বোঝে না, শেষ পর্যন্ত দেখা যায় আমরাই মূর্খের স্বর্গে বাস করি।

সামনের নির্বাচন, যে নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বরে বা ২০২৪-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা, তা নিয়ে পর্দার আড়ালে বা আভাসে কথা-চালাচালি, হিসাব-নিকাশ হচ্ছে, তা অস্বীকার করা যাবে না। সংবাদপত্রে, রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা মঞ্চের পারদ ওঠানামা থেকে কিংবা চায়ের টেবিলের আলোচনা থেকেও তা কিছু কিছু প্রকাশ পাচ্ছে। মিডিয়ার কথা বলার আগে মানুষের মুখের কথা বলা যাক। মন্ত্রী থেকে যেকোনো পর্যায়ের রাজনীতিবিদেরা এখন মেতে আছেন বিএনপির চেয়ারপারসন এবং বর্তমানে সাজাপ্রাপ্ত প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়া রাজনীতি এবং নির্বাচন করতে পারবেন, কি পারবেন না-সে নিয়ে।

এই আলোচনা থেকে মানুষ বুঝে নিচ্ছে নির্বাচনকে সামনে রেখে একটি সিদ্ধান্ত হতে যাচ্ছে খালেদা জিয়ার রাজনীতির ভবিষ্যৎ নিয়ে। আইনমন্ত্রী, যিনি কিছুদিন আগেই বলেছিলেন, ‘সাজাপ্রাপ্ত আসামি খালেদা জিয়ার রাজনীতি করার কোনো সুযোগ নেই, নির্বাচনে অংশ নেওয়া তো দূরের কথা’। তবে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণের মালিক সাধারণ মানুষ নয়, আজ যারা রাজনীতি করছেন এবং আজ এক কথা আবার কাল আরেক কথা বলে যাচ্ছেন, তারাই সিদ্ধান্ত নেবেন। সুতরাং দেখারাম দেখে যা, খেলারাম খেলে যা।

এ তো গেল অন্দরের কথা। বাইরে যারা বাংলাদেশের উন্নয়ন পার্টনার-অংশীজন, তারা কী ভাবছেন বাংলাদেশের আগাম নির্বাচন নিয়ে? এ কথা স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের স্বাধীন মানুষ বলতে পারে না, নির্বাচন নিয়ে বিদেশিদের সাথে আমাদের কী কথা? আমাদের নির্বাচন, সিদ্ধান্তও আমাদের। আমাদের নির্বাচনে তাদের নাক গলানোর কিছু নেই। আমরা ভোট দেব। আমাদের নেতা নির্বাচিত করব। কথা শেষ। না, কথা শেষ নয়। অনেক সময় তাদের কথাই আসল কথা। স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব নিঃশর্ত হলেও আমরা নিঃশর্ত স্বাধীনতা ভোগ করতে পারি না। নানা শর্তের বেড়াজালে আমাদের হাত-পা বাঁধা। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফ, আমেরিকা, ভারত, রাশিয়া ও চীন। একেক দেশের একেক শর্ত। কারো-বা একাধিক শর্ত। তার পরও আছে রাজনীতির সম্পর্কের হিসাব।

প্রকাশ্যে এক হিসাব, গোপনে অন্য। প্রকাশ্যে সবাই চায় প্রভাবমুক্ত নির্বাচন। সব দলের অংশগ্রহণেরও নিশ্চয়তা চায় তারা। গোপনের আলোচনার ফল জানা না গেলেও শোনা যায়, ‘আমাদের কথা শুনলে তোমাদের দিকে। না শুনলে নেই।’ আবার সবাই দেখছে, বেশ কিছুদিন আগে থেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দলের পক্ষে নির্বাচনী প্রচারণা শুরু করে দিয়েছেন। নৌকার পক্ষে ভোট চাচ্ছেন। বহুবিধ উন্নয়নের কথা বলছেন। যেসব মেগা প্রকল্প শেষ হয়েছে, যেসব প্রকল্প সম্পন্ন হওয়ার পথে এবং সেই সঙ্গে ভবিষ্যতের উন্নয়ন প্রকল্পের কথাও সবিস্তারে তুলে ধরে তিনি সবাইকে নৌকায় ভোট দেওয়ায় আহ্বান জানাচ্ছেন।

সরকারি দল হিসেবে আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অনেক ভালো অবস্থানে আছে বলে মনে করছেন অভিজ্ঞজনেরা। প্রধানমন্ত্রীর নির্বাচনী প্রচারণার বিরুদ্ধে অনেকের অভিযোগও আছে। তিনি সরকারি সুবিধা নিয়ে অনেক জায়গায় নির্বাচনী প্রচারণা চালাচ্ছেন। নির্বাচনের বাইরে এও অনেকেই মনে করছেন, যারা নিজেদের দাবি মানা না হলে একেবারেই নির্বাচনে যাবেন না বলে এত দিন অটল ছিলেন, মনে হচ্ছে এখন তারা সেই অনড় অবস্থা থেকে অনেকটাই সমঝোতার পথে ফিরে এসেছেন।

সরকারও ছাড় দেওয়ার বিষয়ে কিছুটা নমনীয় বলে মনে করছে মানুষ। নির্বাচনকালীন সরকার পরিচালনার বিষয়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে কথা-চালাচালির খবরও জানা যাচ্ছে।

বাংলাদেশের মানুষ সবার সমঝোতায় একটা অবাধ, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হোকÑসেটাই আশা করে। দেশের মানুষ নিজেরা ভোট দিয়ে নিজেদের পছন্দে একটি সরকার গঠন করতে চায়। তারা ২০১৪’র মতো নির্বাচনের সেই ভয়ংকর অভিজ্ঞতা যেমন পেতে চায় না, তেমনি ২০১৮’র নির্বাচনের অভিযোগও আর শুনতে চায় না। অন্যদিকে অনির্বাচিত কারো ওপর নির্বাচন পরিচালনার দায়িত্ব পড়ুকÑসেটাও মনে হয় মানুষ আর চায় না। তাই নির্বাচনী ব্যবস্থা যেভাবে সংস্কার করে সব পক্ষের সমর্থন পেতে পারে, সেভাবেই পরিকল্পনা গ্রহণ এখন সময়ের দাবি হয়ে দাঁড়িয়েছে।