নির্বাচন নিয়ে যে বিতর্কের মীমাংসা নেই

বাংলাদেশের প্রায় সব মানুষই কথাটা জানে, ‘বিশ্বাসে মিলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর।’ বাংলাদেশে একটা সুষ্ঠু, অবাধ, সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের স্বপ্ন নিয়ে মানুষের ৪৮ বছর কেটে গেল, কিন্তু মানুষের বিশ্বাস পূরণ হলো না। তর্ক ও বিবাদের মধ্যেই রয়ে গেল সবার কাছে গ্রহণযোগ্য, বিতর্কমুক্ত একটি জাতীয় নির্বাচনের স্বপ্ন। মানুষের বিশ্বাসের প্রতিফলন দেখা গেল না বাস্তবে। সেই গণবিশ্বাস অধরাই থেকে গেল।
আসলে বাংলাদেশে নির্বাচনের বছর শুধু নয়, নির্বাচনের কথা যখনই ওঠে, রাজনৈতিক তখনই দুই পক্ষের দুই বক্তব্য প্রায় অপরিবর্তিতভাবে শুনতে পায় পাবলিক। শুধু বাংলাদেশেই বা বলি কেন! পাকিস্তান আমলেও জনগণের অভিজ্ঞতা প্রায় একই রকম। বাংলাদেশে সরকারি দল আর বিরোধী দলের বক্তব্য সব সময় এক রকম। সে সরকারি দলে যেই থাক, আর বিরোধী দলে যেই থাক। যদি ক্ষমতায় আর বিরোধী দলে থাকাকালে কেউ ‘এ’ দলের কথা, যুক্তিতর্ক রেকর্ড করে রাখেন এবং কেউ ‘বি’ দলের সরকারে থাকাকালে ও বিরোধী পক্ষে থাকার সময়কালের কথাবার্তা রেকর্ড করে রাখেন, তবে দেখা যাবেÑসব দলের দুই অবস্থানে কথাবার্তার কোনো রদবদল নেই।
সামনে বাংলাদেশে জাতীয় নির্বাচন। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন হয়ে যাওয়ার কথা। দেশের রাজনৈতিক বিশ্লেষকসহ সর্বস্তরের সব মানুষের ধারণা, নির্বাচন নিয়ে সাধারণ মানুষের গত ৪৮ বছরের যে একটা সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বপ্ন, তা এবারও পূরণ হবে না। তাদের সাধারণ ধারণাই জয়ী হবে। নির্বাচন হবে। কেউ বিজয়ী হয়ে ক্ষমতায় যাবে। কিন্তু কথা হবে সেই একই রকম, পুরোনো ঢংয়ে। বিজয়ীরা যেমন করে বলে থাকেন তেমন করেই বলবেন, বিজিতরাও অতীতের মতোই একই অভিযোগ তুলবেন। এর বাইরে নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সুর মিলে যাবে বিজয়ী দলের সঙ্গে। আর ‘নির্বাচন পর্যবেক্ষক’ বলে একটি গোষ্ঠী থাকবে, তারা বলবে তাদের মতলব বুঝে। কিন্তু নির্বাচন নিয়ে জনগণ যে স্বপ্ন দেখে, যে স্বপ্ন পূরণের মধ্য দিয়ে তাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং মুক্তিযুদ্ধে তাদের জীবনদানের সার্থকতা ফলবে, যে জন্য তারা পাকিস্তানের বিরুদ্ধে লড়াই করে ৩০ লাখ মানুষ জীবন দিয়েছিলেন, সেই স্বপ্ন অতীতের মতোই অধরা থেকে যাবে।
ইদানীং বাংলাদেশে খুব উচ্চারিত হয় ফ্রি, ফেয়ার, অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ। যার ভোট সেই দেবেন, যাকে খুশি তাকে দেবেন। এসব কথার সঙ্গে গ্রামের যারা হদ্দমূর্খ চাষাভুষা, সূর্যের মুখ দেখেনি এমন গৃহবধূরাও এখন পরিচিত। কিন্তু সবই কাজির গরুর মতো, খাতায় থাকে গোয়ালে মেলে না। কার ভোট কে দেয়, বাংলাদেশে তার খোঁজ পাওয়া যায় না। বিজয়ী দল যদিও বলে সবকিছু ঠিক আছে। পরাজিতরা কী না বলে! কিন্তু ভোটের বাক্সে মৃত মানুষেরও ভোট পড়ে যায়! কোনো কোনো কেন্দ্রে প্রকৃত ভোটারের চেয়ে ব্যালট পেপারের সংখ্যা বেশি মেলে ব্যালট বক্সে। লোকে বলে ভৌতিক কারবার! কিন্তু করে মানুষেই। কথায় আছে, ‘৮০ মণ তেল দিলে নাকি রাধা নাচে!’ বাংলাদেশের নির্বাচন নিয়ে বলা হয়, অবাধ, নিরপেক্ষ আর সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন সেদিন হওয়া সম্ভব, যেদিন ক্ষমতাসীনদের মস্তক থেকে ‘যেনতেন প্রকারে ক্ষমতায় থাকতে হবে’-এ পোকা দূর হবে। কিন্তু সেটা দিল্লি দূর অস্ত। তাই আপাতত জনগণের স্বপ্ন পূরণ হচ্ছে না। তাদের ভোট কাউকে নির্বাচিত করার ক্ষমতা রাখছে না, ভোটদানের সুযোগ পেলেও। ইদানীং অবশ্য সেই সুযোগও আর রাখা হচ্ছে না। ২০১৪ সালে যার একটা রিহার্সেল হয়ে গেছে।
তবে বাংলাদেশ যেহেতু সব সম্ভবের দেশ, তাই হিসাব-নিকাশের বাইরেও অনেক কিছু ঘটে যায়। সেখানেও সাধারণ মানুষের কোনো হাত নেই, কৃতিত্বও নেই। রাজনৈতিক শক্তির বাইরের কোনো শক্তির কারসাজি থাকে। সে ভেতরের শক্তি হতে পারে আবার বাইরের শক্তিও হতে পারে। সবকিছুই হতে পারে বাংলাদেশে! শুধু হতে পারে না বাংলাদেশের মানুষের প্রত্যাশা পূরণ। তারা স্বপ্ন দেখে, সেই স্বপ্ন পূরণের জন্য লড়াই করে কিন্তু তার স্বাদ নিতে পারে না। তার আগেই লুট হয়ে যায়! তারা অনেক কিছু দেখে, আবার শোনেও অনেক কিছু। তাদের জীবনযাত্রায় কেবল তার প্রতিফলন দেখে না। তারা মাথাপিছু আয়ের কথা শোনে লক্ষ টাকার ওপরে। তারা ৪-৫ লক্ষ কোটি টাকার বাজেটের কথা শোনে। কিন্তু বাজারে গিয়ে ছেলেমেয়ের জন্য পছন্দের কিছু কিনতে পারে না। ভালো স্কুল-কলেজে শিক্ষার সুযোগ পায় না। রোগ-ব্যাধিতে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা পায় না। দেশের মানুষ নিজেরা যে পণ্য উৎপাদন করে, তার ন্যায্য দামও পায় না।
অনেককে বলতে শোনা যায়Ñবাংলাদেশ এখন ক্ষমতাসীনদের কথার স্বর্গে পরিণত হয়েছে। গণতন্ত্র আর আইনের শাসনের কথা পাবলিক অহরহ শুনতে পায় উপরিমহল থেকে। বিচার-বহির্ভূত হত্যাকা- অহরহ দেখতে পায় মানুষ। গণতন্ত্রের কথা যখন ওঠে, তখন এ প্রশ্নও ওঠে যে গণতন্ত্র কাদের? ‘উইনার টেক্স দ্য অল’Ñবিশ্বে বাংলাদেশের বাইরে এ কথার ভালো আর কোনো দৃষ্টান্ত আছে বলে মনে হয় না। গণতন্ত্র এক বুঝেছে গণজাগরণ মঞ্চের ছেলেমেয়েরা। আর এখন বুঝছে যারা কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন করছে। বাংলাদেশে যারা সাপ হয়ে দংশন করে, তারাই আবার নাকি ওঝা হয়ে ঝাড়ে! কোটা সংস্কারের দাবি মেনে নেওয়া এবং আন্দোলনকারীদের ওপর ছাত্রলীগের হামলা তার একটা চমৎকার দৃষ্টান্ত।
ফের নির্বাচনের কথা বলা যায়, ক্ষমতাসীনদের জাতীয় নির্বাচনে বিজয়ের ক্ষুধা দূরে থাক, স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ক্ষুধাও তাদের এতটুকু কম নয়। সব নির্বাচনের ফলই যেভাবেই হোক তাদের চাই-ই চাই। গত স্থানীয় সরকার নির্বাচনে গাজীপুর, রাজশাহী সিটি করপোরেশনসহ অনেকগুলো নির্বাচনে যখন বিরোধী দলের প্রার্থীরা জয়ী হতে থাকলেন, তখনই যেন সরকার দিশেহারা হয়ে তাদের বিজয় রুদ্ধ করে নিজেদের বিজয়ের চাকা ঘোরাতে শুরু করে দিল। বিষয়টি মানুষজন বেশ ভালোই অনুধাবন করতে পারলেন। তা আরও স্পষ্ট হলো যখন বিএনপির বিজয়ী প্রার্থীদের বিজয়বঞ্চিত করা হলো আদালতের মাধ্যমে।
সম্প্রতি গাজীপুর, খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনেও পরিস্থিতির কোনো পরিবর্তন দেখা গেল না। আগামীতে যেসব সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হতে যাচ্ছে, সেসব জায়গাতেও যে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটতে দেখা যাবে, সে ব্যাপারে দেশের মানুষের মধ্যে কোনো সংশয় আছে বলে মনে হচ্ছে না। শুধু দেশের মানুষ গাজীপুর-খুলনার নির্বাচন ভালো হয়নি বলছে না, পত্রপত্রিকা, টেলিভিশনের সচিত্র প্রতিবেদনেও দেখা যায় নির্বাচন ভালো হয়নি। অনিয়মের অনেক অভিযোগ। অনেক চিত্র। নির্বাচন পর্যবেক্ষক দলের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনেও নির্বাচনে অনেক অনিয়মের কথা বলা হয়েছে।
অন্যতম নির্বাচন কমিশনার মাহবুব তালুকদারও সব দ্বিধা ঝেড়ে, ভীতি ত্যাগ করে সাহস নিয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘খুলনা, গাজীপুরে নির্বাচন ভালো হয়নি।’ এ কথা বলার জন্য প্রয়োজনে চেয়ার ছেড়ে দিতে হলেও তিনি তার জন্য প্রস্তুত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন। এ এক ব্যতিক্রমী ঘটনা। নির্বাচন কমিশনের ইতিহাসে আর কখনো এরূপ ঘটনা ঘটেনি। এরপর নির্বাচন কমিশনের বিশ্বাসযোগ্যতা আর কিছু থাকে বলে কেউ মনে করে না। অবশ্য নির্বাচন পর্যবেক্ষক দল তাদের পর্যবেক্ষণ নিয়ে যে প্রতিবেদন জমা দিয়েছে, সেই প্রতিবেদনকে প্রত্যাখ্যান করেছেন নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) শাহাদাত হোসেন চৌধুরী।
এদিকে পত্রপত্রিকায় যেসব তথ্য এসেছে, তাতে দেখা যায়, অবাধ ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোটকেন্দ্রের ভেতরে চলেছে নৌকা প্রতীকে সিল মারার মহোৎসব। প্রতিবাদ করার কেউ নেই। ধানের শীষের কোনো এজেন্টকে থাকতে দেওয়া হয়নি। কেউ ধানের শীষের ব্যাজ নিয়ে ঘুরতেও সাহস পাননি। তবে গাজীপুর জেলার রিটার্নিং অফিসার রাকিবউদ্দিন মন্ডল ‘কিছু অপ্রীতিকর ঘটনা’র কথা স্বীকার করেছেন। অন্য অনেকেই ধানের শীষের এজেন্টদের মারধর করে, ভয় দেখিয়ে কেন্দ্র থেকে বের করে দেওয়ার অভিযোগ করেছেন। অনেককে আগের রাতে গ্রেফতার করা হয়েছে বলেও অনেকের অভিযোগ থেকে জানা যায়।
এই হচ্ছে সামগ্রিকভাবে সুষ্ঠু, অবাধ শান্তিপূর্ণ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের নমুনা। সামনে যে জাতীয় নির্বাচন, সে নির্বাচনে ‘মিরাকল’ কিছু না ঘটলে, জনগণ ব্যতিক্রম কোনো নির্বাচন দেখতে পাবে-এমনটা আশা করা যায় না।