ড. এম এল আর সরকার
নির্বাচন নিয়ে বর্তমানে যে সংলাপ বা কথাবার্তা চলছে, তাতে মনে হচ্ছে- দেশে এখন এক ধরনের বল খেলা চলছে। এটি হতে পারে ফুটবল, পিংপং বল বা অন্য কোনো বল। খেলছে আমাদের দেশের দুই রাজনৈতিক জোট। আইনের কাছে বা রাজনৈতিক দলগুলোর কাছে অনেকটা নিরুপায় হয়েই এ খেলা পরিচালনা করার চেষ্টা করছে নির্বাচন কমিশন। এ খেলা অধীর হয়ে দেখছেন দেশের নিরুপায় মানুষ। দর্শক কেউ কেউ ভাবছে ‘এ-দল’ গতবার ভালো খেলছে; অতএব তাদের এবারও জিততে দিতেই হবে। এ ক্ষেত্রে ‘এ-দল’ যদি কিছু ফাউল করে বা রেফারির যদি অন্যায়ভাবে তাদের কয়েকটি পেনাল্টি দেয়, তাতেও কোনো সমস্যা নেই।
অন্য দিকে কিছু দর্শক মনে করছে ‘বি-দল’ গতবার মাঠে ছিল না বলেই ‘এ-দল’ এত গোল করতে পেরেছিল। এবার ‘এ-দল’কে ফাঁকা মাঠে গোল করতে দেয়া হবে না। খেলা শুরু হওয়ার আগেই ‘বি-দল’ রেফারিকে বারবার বলছে, আমাদের খেলার মাঠে নিশ্চিন্তে খেলতে দিতে হবে। ইচ্ছাকৃতভাবে ‘এ-দল’কে পেনাল্টি দেয়ার চেষ্টা করলে ফল হবে ভয়াবহ। ‘এ-দল’ যাতে বারবার ফাউলের মাধ্যমে ‘বি-দলের’ খেলোয়াড়দের আহত করে মাঠ থেকে বের করে না দিতে পারে, সে ব্যাপারে রেফারিকে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে বলছে। ‘বি-দলের’ আরও দাবি হচ্ছে- মাঠে কঠোর নিরাপত্তাব্যবস্থা নিতে হবে; যাতে করে ‘এ-দলের’ খেলোয়াড়দের পাশাপাশি তাদের ক্যাডার-দর্শকরা মাঠে ঢুকে গোল দিতে না পারে। ‘বি-দলের’ খেলোয়াড়রা ভীতু এ কারণে যে, অতীতে তাদের ক্যাডার-সমর্থকরাও এভাবে মাঠে ঢুকে তাদের পক্ষে গোল দিয়েছিল।
আমরা দর্শক, খেলা দেখব এবং সমর্থন দেবো। ফাউল-পেনাল্টি বা বহিরাগতদের গোলে যেভাবেই হোক না কেন, এক দল খেলায় জিতবে। সঙ্গত কারণেই পরাজিত দল এ পরাজয় মেনে নেবে না। ফল- কিছু মারামারি, সাধারণ মানুষের সম্পদের ক্ষতি এবং কিছু অমূল্য জীবনহানি। তারপর আর কী? কিছু আশ্বাস, কিছু বিশ্বাস এবং কিছু ‘আগামীর আসা’। কিন্তু সেই শুভ আগামী আর আসে না। বারবার আমরা অতীতের কাছেই ফিরে যাই। এর শেষ কোথায় এবং কিভাবে, তা আমরা জানি না; খুঁজি না, খুঁজতে চাই না এবং মানি না, মানব না। আমরা শুধু একটাই জানি ও মানি, তা হচ্ছে- গোল এবং সেটা আমাকেই দিতে হবে; তাতে প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে ফাউল, পেনাল্টি এবং তা সমর্থকদের মাধ্যমে হলেও কোনো সমস্যা নেই। প্রয়োজন একটি বিজয় এবং তা থেকে ক্ষমতা।
পাঠক হয়তো ভাবছেন, রাজনীতি বলতে হয়তো আমি এটিই বোঝাতে চেয়েছি। কিন্তু আমি অত্যন্ত বিনয়ের সঙ্গে বলতে চাই- বলখেলার নাম রাজনীতি নয়। রাজনীতি হচ্ছে নীতির খেলা। এ খেলায় বিদ্যমান দলগুলো প্রতিপক্ষকে পরাজিত করবে জনগণ ও দেশের কল্যাণার্থে প্রদত্ত তাদের নীতির উৎকর্ষ দ্বারা। গায়ের জোর, ভোটচুরি, টাকার খেলা, গ্রেফতার, ভয়-ভীতি প্রদর্শন, বিদেশিদের কাছে নালিশ বা সমর্থন চাওয়া অত্যন্ত অশোভনীয়, অপ্রয়োজনীয়, বেমানান এবং জাতির জন্য তা বেদনাদায়ক ও লজ্জাজনক।
দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আমাদের দেশে রাজনীতির নামে চলছে বল খেলাখেলি। পাঠকের প্রশ্ন থাকতেই পারে, রাজনীতির নামে কেন বলখেলা খেলছে এ দুটি জোট? উত্তরটি হচ্ছে- আমাদের দেশের মানুষের মঙ্গল বা সমস্যা সমাধানের জন্য যে ভিশন বা মিশন প্রয়োজন, তা রাজনৈতিক দলগুলোর নির্বাচনী এজেন্ডায় নেই। তারা নির্বাচনী বক্তব্য দ্বারা মানুষকে আশান্বিত বা উদ্বুদ্ধ করতে পারছে না। তাদের এজেন্ডায় বা দফায় আছে ক্ষমতায় যাওয়ার কথা বা আশা। এখানে জনগণের সমস্যা সমাধানের কোনো দিকনির্দেশনা নেই। জনগণের কাছে তাদের কথা বিশ্বাসযোগ্য বলেও মনে হচ্ছে না। জনগণ অনেকটা বাধ্য হয়েই হয় এদিক, না হয় ওদিক ভোট দেবে- এটি জোটনেতারা ভালো করেই জানেন।
ফলে এ খেলায় শক্তি বুদ্ধির জন্য প্রধান দুটি রাজনৈতিক জোট এ মুহূর্তে অতি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র দলকে বা কিছু দলছুটকে অথবা একজন মানুষের যে দল, তাকেও দলে নেয়ার চেষ্টায় উদগ্রীব। তাদের ধারণা, এ লোকগুলো তাদের পক্ষে কথা বললে গ্রামের নিরীহ মানুষগুলো তো বটেই, আমরা যারা নিজেদের শিক্ষিত বলি; তারাও কিছু বুঝে বা না বুঝে অমুক মার্কা-তমুক মার্কা বলে বলে চিৎকার করবে এবং তাদের ভোটের গোল করতে সহায়তা করবে। এ গোল করে জিততে পারলেই পাঁচ বছরের জন্য অফুরন্ত ক্ষমতা।
ক্ষমতা ছাড়া জনগণের জন্য রাজনৈতিক দলগুলোর কোনো লক্ষ্য বা উদ্দেশ্য নেই। এটি পেলে প্রথম চেষ্টা হচ্ছে, ক্ষমতা পাকাপোক্ত করা এবং প্রয়োজন মোতাবেক নিজের আখের গোছানো। এরপর তারা ভেবে দেখেন, জনগণের জন্য কিছু করা যায় কি না! যদি দয়াবশত তারা কোনো উন্নয়নমূলক কাজ করেন, তবে তা থেকে তারা ও তাদের লোকেরা এত বেশি লাভের চেষ্টা করেন; সেই কাজ শেষ পর্যন্ত অল্প দিনেই নষ্ট হয়ে যায়। এই তো হচ্ছে আমাদের হালের রাজনীতি। প্রকৃতপক্ষে নির্বাচনের জন্য দেশে রাজনৈতিক দলগুলোর এজেন্ডায় অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত ছিল, দেশের বর্তমান বিদ্যমান বহুবিধ সমস্যা; এর মধ্যে কিছু উল্লেখযোগ্য সমস্যা হচ্ছে নিম্নরূপ-
প্রথমত, ব্যাংক ও শেয়ারবাজার লুটপাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণে ব্যর্থতা; দ্বিতীয়ত, সর্বস্তরে ঘুষ-দুর্নীতি, যার নমুনা কয়েকদিন আগে একজন জেলারের থলে থেকে বের হয়েছে; তৃতীয়ত, শত শত নামকাওয়াস্তে সার্টিফিকেটধারী উচ্চশিক্ষিত বেকার সমস্যা, যারা বের হচ্ছে কোনোরূপ পূর্ণাঙ্গ পরিকাঠামো ছাড়াই গড়ে ওঠা জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, অনেকটা বাণিজ্যিকভাবে গড়ে ওঠা বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভবিষ্যতে বের হবে রাজনৈতিক বিবেচনায় স্বীকৃতিপ্রাপ্ত কওমি মাদ্রাসাগুলো থেকে; চতুর্থত, নির্বিচারে বিদেশি ঋণ গ্রহণ এবং প্রতিটি উন্নয়নমূলক কাজ দীর্ঘায়িত করে অতিরিক্ত কয়েকগুণ টাকা ব্যয় করা; পঞ্চমত, লাখ লাখ মামলাজট দূর করা এবং পুলিশকে রাজনীতির হাতিয়ার না করে জনগণের বন্ধু হিসেবে পরিণত করা; ষষ্ঠত, ট্যাক্স ফাঁকি, ঘুষ ও দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত অর্থ বিদেশে পাচার এবং মাদক চোরাচালান; সপ্তমত, দেশের স্বার্থবিরোধী বিদেশি আগ্রাসন এবং অষ্টমত, প্রতিহিংসার রাজনীতি।
দুটি প্রধান জোটের অন্যতম আওয়ামী লীগ তার নির্বাচনী সভায় বারবার বলছে- উন্নয়ন, উন্নয়ন এবং উন্নয়ন। এটি কোনোভাবেই অস্বীকার করার উপায় নেই, শেখ হাসিনার সরকার দেশের ব্যাপক উন্নয়ন করেছে; কিন্তু আমাদের ঋণের বেড়াজাল এবং দুর্নীতিও অস্বীকার করার উপায় নেই। আরও অস্বীকার করার উপায় নেই- শত ব্যর্থতার পরও অর্থমন্ত্রী এবং নৌপরিবহনমন্ত্রীর প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আনুকূল্য। অর্থমন্ত্রী যতই মাননীয় হোন না কেন, ব্যাংক এবং শেয়ারবাজার রক্ষায় তার ব্যর্থতা কোনোভাবেই আড়াল করার উপায় নেই। অন্যদিকে নৌপরিবহনমন্ত্রীর কর্মকা- নিয়ে জনঅসন্তুষ্টির কথা সর্বজনবিদিত। একজন মন্ত্রী বা ব্যক্তি যতই শক্তিশালী বা শ্রদ্ধার পাত্র হোক না কেন, রাষ্ট্র তার কাছে কোনো দিনও পরাজিত হতে পারে না। অনেকেই মনে করেন, আওয়ামী লীগের ভালো কাজগুলো মøান হয়েছে এ দুই মন্ত্রীর ব্যর্থতায়।
উন্নয়নের কথা বলে প্রধানমন্ত্রী আবারও ভোট চাচ্ছেন। ধরে নিলাম, ভোট আপনার প্রাপ্য; কিন্তু আবার ক্ষমতায় এলে দেশের ব্যাংকগুলোর কী হবে এবং পরিবহন ব্যবস্থার জন্য আপনি কী করবেন? আপনার নির্বাচনী প্রচারে এ বিষয়গুলো পরিষ্কার না হলে জনগণ কোন ভরসায় আপনাকে আবারও ভোট দেবে? শুধু তাই নয়, উপরের যে আটটি সমস্যার কথা বলা হয়েছে, তা সমাধানের জন্য আপনার সরকার ভবিষ্যতে কী কী পদক্ষেপ নেবে; এটাও পরিষ্কার করা প্রয়োজন। না হলে জনগণকে শুধু উন্নয়নের দোহাই দিয়েই ভোট পাওয়া যাবে কিনা, এতে ব্যাপক সন্দেহ রয়েছে। জনগণ উন্নয়ন চায়, উন্নয়নের সঙ্গে সুশাসন চায়। চায় দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা। চায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের পরিকল্পনা; কিন্তু দেখতে চায় না ব্যক্তিস্বার্থে দেশের সর্বনাশ!
এবার আসি জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের কথায়। মোটকথা, তারা মূলত খালেদা জিয়ার মুক্তি, ক্ষমতার পরিবর্তন, স্বৈরশাসন বন্ধ এবং ক্ষমতা চায়। খালেদা জিয়ার প্রসঙ্গ বাদ দিলাম। বয়স হয়েছে, তাই মুক্তি পেলে কী এমন ক্ষতি! কিন্তু ক্ষমতা পেলে আপনারা আসলে দেশের জন্য কী করবেন, তা কি কখনও কোথাও বলেছেন? শুধু বলেছেন- গণতন্ত্র, গণতন্ত্র এবং গণতন্ত্র। হ্যাঁ, গণতন্ত্র ভালো জিনিস। কিন্তু গণতন্ত্রের মাধ্যমে নির্বাচিত ক্ষমতাবানরাই তো আস্তে আস্তে স্বৈরশাসন শুরু করে।
আপনারা নির্বাচিত হলে কেমন করে স্বৈরশাসন বন্ধ হবে? আবার হাওয়া ভবন হবে না এবং বিদ্যুতের পরিবর্তে শুধু খাম্বা বিক্রি করবেন না বুঝলাম। কিন্তু ড. কামাল ভবন শুরু হবে না, তার কি কোনো নিশ্চয়তা আছে? ড. কামাল হোসেন, আপনার আশপাশের লোকগুলো অত্যন্ত সুযোগসন্ধানী। দেখুন না, কাদের সিদ্দিকী কতদিন সময় নিয়ে, ভেবেচিন্তে, লাভক্ষতির হিসাব কষে তারপর আপনার সঙ্গে যোগ দিলেন! একবার ভেবে দেখুন তো, ক্ষমতা পেলে যেসব লোক আপনার আশপাশে আছে; তাদের আপনি কী করে সামলাবেন? তারপর কথা হচ্ছে- এতদিন পর এখন আপনি নিজেই খালেদা জিয়ার মুক্তি চাচ্ছেন; কিন্তু তারেক জিয়ার কথা কিছুই বলছেন না। এখন বলুন তো, আপনার জোট ক্ষমতায় এলে আপনি তারেক জিয়ার জন্য কী করবেন?
সবচেয়ে বড় কথা, দেশের জন্য ঐক্যফ্রন্ট আসলে কী করবে, তা মনে হয় আপনাদের চিন্তাতে নেই। যদি থাকত, তা হলে উপরের আটটি সমস্যার কথা না হয় বাদই দিলাম; ক্ষমতায় এলে দেশের উন্নয়ন, দুর্নীতি দমন, স্বৈরশাসনের অবসান, পরিবারতন্ত্র বন্ধ ইত্যাদি বিষয়ে কী পদক্ষেপ নেবেন- তার তো অন্তত একটি রূপরেখা আপনারা দিতেন বা দিতে পারতেন! কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য- দেশের সমস্যা সমাধানের পরিকল্পনা তো দূরের কথা, ক্ষমতায় এলে কে দেশ পরিচালনা করবে, সে বিষয়েও মনে হয় আপনাদের মধ্যে কোনো ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়নি। কী সংলাপ, কী জনসভা- সবখানেই শুধু আপনারা বলে চলছেন দফার পর দফা। বিশ্বাস করুন, কিছু অত্যন্ত দলকানা লোক ছাড়া কেউ বুঝতে পারছে না আপনাদের ভোট দিলে দেশের কী পরিবর্তন হবে? আর আপনাদের উদ্ধার করা গণতন্ত্র দিয়ে মানুষ কী করবে!
পরিশেষে দুই জোটের কাছেই অনুরোধ- দেশ ও জনগণের কল্যাণার্থে একটি সমঝোতায় উপনীত হোন। দেশের জন্য আপনাদের সফলতা এবং ব্যর্থতার কথা মানুষকে বলুন। ব্যর্থতার দায়ভার গ্রহণ করুন এবং তা থেকে পরিত্রাণের উপায় নির্ধারণ করুন। দেশের বর্তমান সমস্যাগুলো সমাধানে জনগণের কাছে আপনাদের পরিকল্পনা তুলে ধরুন। জনগণকে তাদের মতামত দিতে দিন। জনগণ খেলার বল না যে, আপনারা যেদিকে যেভাবে খুশি ছুঁড়ে দেবেন।
জনগণ একটি শক্তি। এ শক্তিকে যে অবহেলা করেছে বা করবে, তার পরাজয় একদিন হবেই। অনুগ্রহপূর্বক অতীত ভুলে, হিংসা হানাহানি ভুলে দেশকে এগিয়ে নিয়ে যান। শুধু ক্ষমতার জন্য এ দেশকে আর পিছিয়ে দেয়ার সময় নেই। কোর্টে বল ছোড়াছুড়ি বন্ধ করুন। আবারও অনুরোধ করছি- এখনও সময় আছে, সম্ভব হলে ক্ষমতার অংশীদারিত্বমূলক একটি সরকারব্যবস্থা প্রবর্তন করুন। এটি না হলে বন্ধ হবে না প্রতিহিংসার রাজনীতি এবং বন্ধ হবে না প্রতিবার ভোটের আগের এ দেন-দরবার।
ড. এম এল আর সরকার : অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়