নির্বাচন-২০১৮: শেখ হাসিনার বিশাল জয়, জনগণের বিশাল প্রত্যাশা

মুহম্মদ ফজলুর রহমান

বাংলাদেশে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন শেষ হলো। এমপিদের শপথ গ্রহণ সম্পন্ন হয়েছে। মন্ত্রিপরিষদও গঠিত হয়ে গেছে। নির্বাচনী উত্তেজনা, ডামাডোল-সব এখন স্তিমিত। তবে নির্বাচন নিয়ে কথা শেষ হয়ে যায়নি। কথা হচ্ছে, লেখা হচ্ছে এবং এসব হতেই থাকবে। বহুদলীয় রাজনীতি যখন আছে, বহু চিন্তার সমাজ যত দিন আছে, নির্বাচন যত দিন থাকবে-তত দিন কথা হবে। বহু মতের তর্ক-আলোচনা-সমালোচনা থাকবে। একেকজন একেকভাবে দেখবে। একেকভাবে মূল্যায়ন ও বিশ্লেষণ করবে, বলবে এবং লিখে তা প্রকাশ করবে।
বাংলাদেশে সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন নিয়ে দেশে ও দেশের বাইরে এখন সেটাই হচ্ছে। রাজনীতির ভাষায় যাকে নির্বাচনী পোস্টমর্টেম বলা হয়ে থাকে। সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে নির্বাচনের ফলাফল। নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মূল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল বা বিএনপি মাত্র ৫টি আসনে বিজয় লাভ করেছে। যেকোনো বিচারে এই ফলাফল একদিকে আওয়ামী লীগের অবশ্যই ভূমিধস বিজয়। অন্যদিকে বিপর্যয়ের দিক থেকে বিএনপির ভূমিধস বিপর্যয়। বিএনপির ফল বিপর্যয়ের নানা কারণ বলার চেষ্টা করছে। যারা ইতিহাস বিমুখ, তারা ইতিহাসের পাতা উল্টানোর শ্রম এড়িয়ে এর পেছনে যেসব ঘটনাকে দায়ী করছে, তার বাস্তব ভিত্তি কতটুকু, তার মূল্যায়নও ইতিহাস করবে। তবে এর ফলে বর্তমানে জনগণের রায়কে যে অসম্মান করা হচ্ছে, তা স্পষ্ট। আসলে মানুষের প্রতি অশ্রদ্ধা দেখানোর প্রবণতার মধ্যেই তাদের পরাজয়ের কারণ নিহিত কি না, সেটাও বিবেচনার দাবি রাখে।
বাংলাদেশের রাজনীতির বড় একটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, নিজের ভুল-ত্রুটি, দুর্বলতা, সীমাবদ্ধতার দিকে না তাকিয়ে কেবলই অন্যের নিন্দা করা, অন্যের ভুল, ত্রুটি, দুর্বলতা খোঁজা। পরাজিত পক্ষের মুখে অনেক কথাই উচ্চারিত হয়। তাদের অনেক রকম ক্ষোভ থাকে, যে কারণে তারা অনেক কিছু যুক্তি দিয়ে বুদ্ধি বিবেচনা নিয়ে দেখতে এবং বিচার-বিশ্লেষণ করতে চায় না। একাদশ নির্বাচনের যে ফলাফল নিয়ে এবার এত কথা হচ্ছে, তা কি এবারই অভূতপূর্ব। এ রকম নজির কি ইতিহাসে আর নেই? পাকিস্তানে কি নির্বাচনে এ রকম ফলাফল আর হয়নি? এ রকম ফলাফল কেন হলো? এর পেছনে কি নির্মম হলেও রিয়াল এবং পজিটিভ কোনো কারণ নেই? পরাজিত পক্ষ নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি এবং ভোট ডাকাতির অভিযোগ তুলতে পারে। তবে সেটাই সত্য হলে প্রথমত এ রকম ভূমিধস বিপর্যয় হয় না। আন্তর্জাতিক মহলের এ রকম সমর্থনও বিজয়ীদের পক্ষে আসে না। ইতিপূর্বে এসব সমর্থকের অনেকে পরাজিতদের মিত্র বলেই জানা ছিল সর্বমহলে। ইতিহাস ও বাস্তবতাকে সামনে নিয়ে বাংলাদেশের সদ্য সমাপ্ত নির্বাচন সম্পর্কে খুব সহজভাবে দু-একটি কথা বলার ইচ্ছা থেকেই এই লেখা। বাংলাদেশে যারা রাজনীতি করেন এবং এমন একটা শ্রেণি যারা মানুষের মাথার ওপরে বসে তাদের মাথাতেই কাঁঠাল ভেঙে খায়, তারা কথায় কথায় বলে থাকেন যে মূর্খ অশিক্ষিত চাষা-ভূষা মানুষ রাজনীতি, সরকার, রাষ্ট্র এসবের কী বোঝে। তারা ভুলে যান, বাংলাদেশের এই অশিক্ষিত মূর্খ মানুষেরা রাজনীতি নির্বাচন আন্দোলন সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে কখনো ভুল করেন না।
এবার এই একাদশ নির্বাচনেও তারা ভুল করেছে বলে বিশেষজ্ঞ পর্যায়ের কোনো প্রতিষ্ঠান বা ব্যক্তি মনে করে না। তাদের সচেতন সিদ্ধান্তেরই ফসল নির্বাচনের এই ফলাফল। এখানে জাদুমন্ত্র বা কারসাজি কাজ করেনি। জাদুমন্ত্র যদি কিছু থেকে থাকে, তবে সেটা বিজয়ী দলের কর্মসূচি, কৌশল, সিদ্ধান্ত এবং তা বাস্তবে প্রয়োগ করে নিজেদের পক্ষে ফসল তোলার মেধা শ্রম কর্র্মদক্ষতা অধ্যবসায়। কর্মীদের উদ্বুদ্ধ করা, সংগঠিত করার যোগ্য নেতৃত্ব, নেতৃত্বের প্রজ্ঞা আর গ্রহণযোগ্যতা।
এবার বিরোধীদের পক্ষ থেকে প্রশ্ন তোলা হয়েছে, ‘সরকার ক্ষমতায় থেকে নির্বাচন করলে ফলাফল এমনটাই হয়। এবারের ফলাফল প্রমাণ করেছে, গত ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল।’ তাদের এই যুক্তি ঠিক নয়। ইতিহাসের দিকে তাকালে তার প্রমাণ মেলে। পাকিস্তান আমলে ১৯৫৪ সালে এবং ১৯৭০ সালে দুটি নির্বাচন হয়েছিল। গণতন্ত্র এবং বাংলার মানুষের ১৯৭০ অধিকার প্রতিষ্ঠায় ১৯৫৪ সালে শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মজলুম জননেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী এবং গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে যুক্তফ্রন্ট অংশ নেয় ক্ষমতাসীনদের অধীনে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে। ওই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওই তিন মূল নেতার একজন না হয়েও সারা বাংলাদেশ চষে বেড়ান নির্বাচনী প্রচারণায় মানুষকে সংগঠিত করতে। ওই নির্বাচনে যুক্তফ্রন্ট সম্ভবত ৩০৯টি আসনের মধ্যে ৩০০টিতেই জয়ী হয়। ১৯৭০-এর নির্বাচন হয়েছিল বাংলার মানুষের স্বায়ত্তশাসনের ছয় দফা দাবি নিয়ে। তখন বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ওই নির্বাচনে ১৬৯ আসনের মধ্যে দুটি বাদ দিয়ে সব আসনে আওয়ামী লীগ জয়ী হয়। এটিও তৎকালীন সরকারের অধীনেই অনুষ্ঠিত হয়। এই নির্বাচনের ফলাফলই ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করার জন্য মানুষের ম্যান্ডেট পান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব। ওই ম্যান্ডেট থাকায় বঙ্গবন্ধু, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ঘোষণা দেওয়ার বৈধতা পান এবং কারও পক্ষে বিচ্ছিন্নতাবাদীর অভিযোগ প্রতিপন্ন করার সুযোগ হয় না। ওই নির্বাচনী ম্যান্ডেট নিয়ে বাঙালিরা মুক্তিযুদ্ধ শুরু করলে ভারত এবং তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পাশে দাঁড়াতে পারে বিশ্বসভায় অভিযুক্ত না হয়েও এবং এত সবের পরও নির্বাচন নিয়ে কোনো কথা ওঠেনি।
এবার আওয়ামী লীগের কেন এ রকম ভূমিধস বিজয় আর বিএনপির কেন এমন ভূমিধস পরাজয়, ১৯৫৪ এবং ১৯৭০-এর নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বিচার করলে খুব সহজেই সবাই উপলব্ধি করতে পারবেন। নির্বাচনে বিজয় অর্জনের জন্য নির্বাচনী অ্যাজেন্ডা লাগে, মানুষ যা বিশ্বাস করে আস্থায় নেয়। সেই অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়নে সংগঠন লাগে। সেই সংগঠনের একজন যোগ্য, মেধাবী ও প্রজ্ঞাসম্পন্ন নেতা লাগে। লাগে একদল দেশপ্রেমিক সাহসী কর্মী, যা গড়ে তুলতে হয় দলের নেতাকে।
এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ স্পষ্ট, গ্রহণযোগ্য অ্যাজেন্ডা নিয়ে নির্বাচন করেছে। তাদের অ্যাজেন্ডা মুক্তিযুদ্ধ, উন্নয়ন, সুশাসনের পক্ষে এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার। অ্যাজেন্ডা এবং দলের এই অ্যাজেন্ডাও নেতৃত্বের প্রতি মানুষ আস্থা রেখেছেন এবং নির্বাচনে তার পক্ষে রায় দিয়েছেন। অন্যদিকে ঐক্যফ্রন্টের অ্যাজেন্ডা, সংগঠন, নেতৃত্ব সবকিছু ছিল এলোমেলো, দুর্বল, লক্ষ্যহীন। আদর্শ হিসেবে তারা কখনো মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস রাখে, সেটা প্রমাণ করতে পারেননি। বঙ্গবন্ধুর প্রতি তাদের প্রকাশ্য অশ্রদ্ধা। মুক্তিযুদ্ধবিরোধীদের সঙ্গে তাদের সখ্য। জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে তাদের সম্পর্ক স্বচ্ছ নয়। নেতা কে-বেগম খালেদা জিয়া, তারেক রহমান, না ড. কামাল, সে সম্পর্কে দেশের মানুষ কোনো ধারণা পায়নি। মানুষও তাই কোনো দ্বিধায় ভোগেননি। আস্থার জায়গায় তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছেন। ফলাফলটাও মুক্তিযুদ্ধ, উন্নয়ন এবং ধারাবাহিকতার পক্ষে গিয়েছে।
এবার নির্বাচনে নতুন প্রজন্মের প্রায় আড়াই কোটি ভোটার। বিএনপি তাদের স্বপ্ন দেখাতে পারেনি। তারা তাদের নিজেদের স্বপ্ন, নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন শেখ হাসিনার চোখে। তার রাজনৈতিক ইশতেহার ও অঙ্গীকারে। বাংলাদেশের মানুষ আইনের শাসনে বিশ্বাস রাখেন। অপরাধী যেই হোক, ধর্ম-বর্ণ, সম্প্রদায়, রাজনৈতিক পরিচয়-নির্বিশেষে মানুষ অপরাধীদের শাস্তি প্রত্যাশা করেন। এদিক থেকে সাহসিকতার পরিচয় দিতে পেরেছেন শেখ হাসিনা। তিনি যে বঙ্গবন্ধুর খুনিদের বিচার করে শাস্তি দিয়েছেন, মানবতাবিরোধীদের বিচার করে দ- দিয়েছেন, মানুষ তা পছন্দ করেছেন। দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টলারেন্স ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছেন, তাতে মানুষ আস্থা স্থাপন করেছেন। বিশ্বাস রেখেছেন তাদের ঘোষিত কর্মসূচিতে। বিএনপি তাদের কর্মসূচি স্পষ্ট করতে পারেনি। জামায়াতের সঙ্গে তাদের সম্পর্কও ধোঁয়াশাপূর্ণ ছিল। জামায়াতকে না বলতে পারেনি, জামায়াতও তাদের রাজনৈতিক আদর্শ ও বিশ্বাস থেকে সরে আসেনি। যে কারণে ১৯৭০-এ মানুষ যেমন ৬ দফার মাধ্যমে স্বাধীনতার পক্ষে তাদের ম্যান্ডেট দিয়েছেন বঙ্গবন্ধুকে। এবার মুক্তিযুদ্ধবিরোধী শক্তির বিরুদ্ধে ও উন্নয়নের ধারাবাহিকতা রক্ষার পক্ষে বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনাকে ম্যান্ডেট দিয়েছেন। ফলাফলও একই রকম হয়েছে। যারা গণমানুষের রাজনীতি করেন, তাদের মনে রাখা দরকার, তৃতীয় পক্ষ বা তৃতীয় শক্তি কখনো কারও সাহায্যে হাত বাড়ায় না। আইএসআই বলি আর যা-ই বলি, সবাই কাজ করে তাদের নিজেদের স্বার্থে। কথাটা যদি কেউ শুধু নিজেদের ক্ষমতার মোহে ভুলে যেতে চায়, তবে তাতে তাদেরও লাভ হয় না, দেশেরও হয় না। বিএনপি যদি তার কারণ খুঁজতে চায়, তবে এই বিষয়গুলোও সামনে রাখা দরকার।
মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর নির্বাচনের পূর্বে বারবার ভোটবিপ্লবের কথা বলেছেন। বিপ্লবের কথা শুনলে রক্তে একটা নাচন অনুভূত হয়। কিন্তু এ কথা জানি যে বিপ্লবের কথা শোনা আর বিপ্লব দেখা এক নয়। বিপ্লব কী করে হয় বাম রাজনীতির পথ ধরে হেঁটে আসা মির্জা ফখরুল তা বিলক্ষণ জানেন। তিনি কি তবে বিএনপির রাজনীতি করতে এসে সেসব পাঠ বিস্মৃত হয়েছেন? বিপ্লব করতে গেলে বিপ্লবের পজিটিভ শর্ত লাগে। একটা বিপ্লবী সংগঠন লাগে। বিশ্বস্ত নেতা এবং সাহসী কর্মী বাহিনী লাগে। ‘বিপ্লব স্পন্দিত বুকে মনে হয় আমিই লেনিন’Ñকেবল মুখে মুখে আওড়ালেই বিপ্লব সম্পন্ন হয় না।
এ প্রসঙ্গে আরও একটি কথা বলা দরকার, মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম একজন সেক্টর কমান্ডার জেনারেল জিয়াউর রহমান যে বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিএনপি গড়ে তুলেছিলেন তৎকালীন বাংলাদেশে, আজকের বাংলাদেশে কি সেই শর্ত বিদ্যমান আছে? সেই নেতৃত্বও কি আছে? নেতৃত্ব কে দিচ্ছেন, নেতা কোথায়, নেতৃত্বের লক্ষ্য, উদ্দেশ্য কীÑএসব নিয়ে মানুষের বহু রকমের প্রশ্ন। যার উত্তর খুঁজে পায়নি মানুষ। এ রকম অবস্থা দেশের জন্যও মঙ্গলজনক হতে পারে না। সাংগঠনিক দুর্বলতা, রাজনীতির অস্বচ্ছতা এবং নেতৃত্বের লক্ষ্যহীনতার পরিণতিই এবারের নির্বাচনে বিএনপির এই ভয়াবহ বিপর্যয়ের কারণ বলে গবেষকদের ধারণা। এ ছাড়া প্রায় আড়াই লাখ নতুন তরুণ ভোটারদের রাজনীতি, রাজনীতিবিদ এবং দেশ নিয়ে কী ভাবনা তার খোঁজ করা ও তাদের মনোযোগ আকর্ষণের কর্মসূচি নিয়ে সফল হওয়ার লক্ষণ তাদের মধ্যে দেখা গেছে, এমনটা কেউ মনে করেন না। এমনকি তাদের নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া যে জেলে, সে নিয়েও মানুষের সহানুভূতি জাগাতে চরম ব্যর্থতা দেখা গেছে বিএনপি নেতৃত্বের মধ্যে।
মনে রাখা দরকার, অন্যের ত্রুটি ধরার আগে বুদ্ধিমানেরা প্রথমে নিজেদের ত্রুটি ও দুর্বলতা সন্ধান করে। মানুষ আশা করবে, এই পরাজয়ের পর কারচুপি, ভোট ডাকাতির কথা না বলে নিজেদের ঘাটতি এবং ব্যর্থতার কারণ খুঁজে দেখার চেষ্টা করবেন পরাজিতরা। এবং ২০১৪-তে নির্বাচনে অংশ না নেওয়ার মতো এবারও ভুল করে সংসদে যোগদান থেকে বিরত থাকবেন না। তারা সংসদে গিয়ে জনগণের পক্ষে ভূমিকা রাখবেন-এটাই মনে করে মানুষ। ত্রুটি বা ভুল স্বীকারে লজ্জা নেই। বরং লজ্জা নিজের ভুল শোধরানোর উদ্যোগ না নেওয়ায়। আর জনগণের নামে রাজনীতি করে জনগণের রায়ে সন্দেহ পোষণ করাটাও হবে অন্যায়। এবার সংসদে বিরোধী দলের যে অবস্থান তাতে অনেকেই শঙ্কিত। বিরোধী দলহীন পার্লামেন্ট আসনে শক্তিশালী গণতন্ত্রের কিংবা গণতন্ত্র বিকাশের সহায়ক নয়। এ ক্ষেত্রে সরকারি দলকে আরও বেশি দায়িত্ব পালন করতে হবে। বিচার, বুদ্ধি, বিবেচনা, ধৈর্য, সহিষ্ণুতা এবং প্রজ্ঞা দিয়ে সরকারি দলকেই বিরোধী দলের ভূমিকা পালন করতে হবে। কান্ডারি হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকেই এ ক্ষেত্রে অগ্রসর ভূমিকা নিতে হবে। মানুষ যেন হতাশ না হন। কান্ডারিকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে। এবার বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ, তার নেতা আওয়ামী লীগের সভাপতি বঙ্গবন্ধু-কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিজয়ী এমপি, মন্ত্রী ও দলের সকল নেতা-কর্মীকে আন্তরিক অভিনন্দন ও শুভকামনা জানিয়ে বিনয়ের সঙ্গে কয়েকটি কথা বলতে চাই। দেশে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা সত্ত্বেও সাধারণ মানুষ শাসন পরিচালনায় গুণগত পরিবর্তন প্রত্যাশা করে। সেই প্রত্যাশা তাদের কতটা পূরণ করা সম্ভব হবে, সেই ভাবনা থেকেই কথাগুলো বলা। বিশাল বিজয় যেন বিজয়ীদের লক্ষ্যচুতির কারণ না ঘটায়।
জনগণের ভোটে ভূমিধস বিজয়ে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্তদের কাছে মানুষ খুব সংগতভাবেই প্রত্যাশা করে পদ্মা সেতুসহ মেগা মেগা প্রকল্প যেগুলো চলমান আছে এবং যেগুলো পরিকল্পনাধীন, সেসব প্রকল্পের সফল ও সময়মতো বাস্তবায়ন। তা সম্ভব না হলে প্রকল্পের বাস্তবায়ন ব্যয় বৃদ্ধি পাবে, যা রাষ্ট্রের জন্য ক্ষতির কারণ হবে। ব্যয় বৃদ্ধির মধ্যে দুর্নীতি বৃদ্ধিরও আশঙ্কা থাকে। এর ফলে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্বাচনী ইশতেহারে দুর্নীতির বিরুদ্ধে ঘোষিত জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে কি না সংশয় থেকে যাবে।
আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার ক্ষেত্রে দৃশ্যমান ও গ্রহণযোগ্য ভূমিকা রাখতে হবে। এই ভূমিকা পালন করতে না পারলে দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জিরো টলারেন্সের অঙ্গীকার কাজীর গরু খাতায় পাওয়া গেলেও গোয়ালে পাওয়া যাবে না। আর্থিক খাতের বিশৃঙ্খলাও কিন্তু দুর্নীতির ফসল। উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি টেকসই করতে গেলে আর্থিক খাতের শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠা গুরুত্বপূর্ণ।
টানা ১৫ বছর এবং মোট ২০ বছর ক্ষমতায় থাকার ফলে কিছু দুর্বলতা দেখা যাওয়ার আশঙ্কা দেখা দিতে পারে ক্ষমতাসীনদের ক্ষেত্রে। বিষয়টি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভালোই জানা আছে। সে ক্ষেত্রে প্রধানমন্ত্রী আন্তরিক হলে সেই দুর্বলতা দূর করা মোটেও অসম্ভব হবে না। অন্যদিকে আত্মপ্রসাদে আক্রান্ত হলেও চলবে না। শেখ হাসিনা নিজেই জানবেন তিনি কোন পথে হাঁটবেন। জনগণ তাকে আস্থায় নিয়ে ভূমিধস বিজয় দিয়েছেন। তিনি জনগণের আস্থার প্রতিদান দেবেন, এটাই মানুষের বিশ্বাসে দৃঢ়। একটি সুখী, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়তে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পদক্ষেপ গ্রহণে ভুল হবে না বলে সর্বস্তরের মানুষ আস্থা রাখবে।
এ ছাড়া সামনে দুটি বৃহৎ যজ্ঞ আছে। ২০২০-এ বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১-এ স্বাধীনতার অর্ধশতবার্ষিকী। প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বে এ দুটি ঐতিহাসিক কর্মসূচি পালনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ নতুন এক উচ্চতায় পৌঁছে যাবে-প্রত্যাশা করেন মানুষ।
বিরোধী দলের প্রতি এটুকুই শুধু বলার থাকবে যে নির্বাচনে জয়-পরাজয় থাকবে। জনগণের রায়কেও মেনে নিতে হবে। পার্লামেন্টে সদস্যসংখ্যা যা-ই থাক, তা নিয়েই সংসদে তাদের গণতন্ত্র, মানুষ এবং রাষ্ট্রের কল্যাণে ভূমিকা রেখে যেতে হবে। প্রধানমন্ত্রীকে শুধু বিরোধিতার খাতিরে বিরোধিতা না করে জনকল্যাণে তার সকল কর্মপরিকল্পনাকে সম্পন্ন করে তুলতে সর্বোতভাবে সমর্থন ও সহযোগিতা করা উচিত বলে মনে করি। তাতে তিনি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জিরো টরারেন্স ও সুশাসন প্রতিষ্ঠার যে অঙ্গীকার করেছেন, সে ক্ষেত্রে সফল হওয়া সহজ হবে এবং ভবিষ্যতে নিজেদের সাফল্যের পথও তৈরি হবে। সমালোচনা এবং বিরোধিতা করার সময় ভবিষ্যতে অনেক পাওয়া যাবে। মানুষের হাসির খোরাক হলে কিন্তু মানুষের মনেও আর জায়গা থাকে না।
অন্যদিকে মানুষ এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে যে রকম অভূতপূর্ব বিজয় উপহার দিয়েছেন, তাতে তাদের পাওয়ার প্রত্যাশাও হয়তো আকাশচুম্বী হবে। সেই চাপ নিয়ে মানুষের প্রত্যাশা পূরণে সবাইকে সংযত ও সজাগ থাকতে হবে। দেশের মানুষের যেমন সমর্থন, তেমনি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়েরও সমর্থন লক্ষ করা যাচ্ছে শেখ হাসিনার প্রতি। তিনিই এখন কান্ডারি। সবাই মনে করেন নির্বাচনে বিজয়ের সকল কৃতিত্ব এই কান্ডারির। আপনি বলেছেন, বিশাল বিজয়ের দায়িত্বও বিশাল। যারা আপনাকে বিজয়ী করেছেন তাদের বিশ্বাস, আপনি এই বিশাল বিজয় ধারণ করেই সামনের সব বাধা-বিপত্তি অতিক্রম করে এগিয়ে যাবেন মানুষের প্রত্যাশা পূরণে। এখন আপনার হাতেই দেশের এবং দশের স্বপ্নপূরণের চাবি। আপনি ১৫ বছরের অভিজ্ঞ একজন চৌকস কান্ডারি। ঝড়-তুফান যতই উঠুক, আপনার হাতেই নৌকা নিরাপদ বলে মানুষের দৃঢ় প্রত্যয়।
বাংলার মানুষ আপনাকে কতটা ভালোবাসে, তা আরও একবার নির্বাচনী ফলাফলে প্রকাশ পেল। আপনিও দেশের জনগণকে ভালোবাসেন। এ তারই প্রতিদান। আপনাদের পারস্পরিক এই ভালোবাসা অটুট থাক। শেষ করার আগে শুধু এটুকুই বলার যে, যে ক্ষমতা আপনি অর্জন করেছেন, তা জনগণের। তাদের সেবাতেই আপনি এই ক্ষমতা ব্যবহার করবেন। শুধু ষড়যন্ত্রকারী এবং চাটুকারদের সম্পর্কে খুব সতর্ক থাকতে হবে। চাটুকাররাই জনগণ থেকে রাজনীতিবিদদের বিচ্ছিন্ন করে রাখে। ষড়যন্ত্রকারীরা সুযোগ পেলেই কোচের ছুরি বের করে ফেলে।
আপনি আপনার অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাতে সফল ও সার্থক হন।
লেখক : প্রধান সম্পাদক, ঠিকানা।
৭ জানুয়ারি, ২০১৮
নিউ ইয়র্ক।