
হাসান রাজীব
সে বলেছিল চোখ নিয়ে কিছু লিখতে। কিন্তু চোখ তো দেখে না সব। হৃদয়ের ক্লেশ অথবা প্রাণান্ত ভালবাসা। তাই নীল চোখের গভীর অবগাহনে টালমাটাল এ জীবনে আজ আমি নিরুদ্দেশ।
আটত্রিশ বসন্তের এ দু’চোখে নানা রঙের ঝর্নাধরায় ঝরেছে কতই না রঙ। লাল, নীল, সবুজ. হলুদ, সোনালীচ্ছটায় এ এক অক্লান্ত জীবনের ঘনঘটা। এমনি এক জীবনের সোনালী দিনগুলোতে প্রথম দেখা নীল চোখের। ষোড়শী নীলাঞ্জনার নীল চোখে সেই প্রথম দৃষ্টিপাত। আর ফেরাতে পারিনি। বলেছিলাম-
ওহে নীল চোখ কতটা গভীর হলে তবেই ডুবে থাকা যায় ও চোখের অবগাহনে। মৃদু হেসে সে বলেছিল, নীল চোখের লোনা জলে ভিজো না। তারপরও ভিজেছি যথেচ্ছাভাবে।
একাদশ শ্রেণির প্রথম ক্লাসেই তার সঙ্গে প্রথম দেখা। ক্লাসে ঢুকতেই সর্বপ্রথম তার চোখাচোখি হলাম। অনেকটা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে লাজুক স্বভাবে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। অথচ দেখতে যেন ততটাই কিউট যতটা প্রথম দর্শনেই ভালো লাগে।
সহপাঠীদের মাধ্যেমে জানলাম তার নাম নীলাঞ্জনা। তারপর কতটা দিবস ঘুরেছি তার পিছু পিছু। ইনিয়ে বিনিয়ে কথা বলার চেষ্টা করেছি। কিন্তু সাহসের পরিধি বেশিদূর গড়াতে পারিনি। তাই কথা বলা হয়ে ওঠেনি।
তবে দেখেছি, দু’চোখ ভরে দেখেছি তাকে। কখনো সরাসরি, কখনো লুকিয়ে, কখনো চোখ বন্ধ করে কল্পনার দু’চোখে হৃদয় ভরে দেখার চেষ্টা করেছি।
এরপর হঠাৎ একদিন কথা হলো। ও আমাকে দেখে বলেছিল-
-কিছু বলবে?
আমি বলেছিলাম-
-কি নাম তোমার?
যদিও আমি তার নাম জানতাম। সে বললো
-নীলাঞ্জনা
-আমি হেসে বললাম- তাই? তবে আমি কিন্তু শুধু নীল বলবো।
-যেটা তোমার খুশি। তোমার নাম?
-রানা। রানা মাহমুদ।
-আমি কিন্তু শুধু রানা বলবো।
-যেটা তোমার খুশি।
তারপর উভয় হেসে লুটোপুটি। হাসলে অসাধারণ সুন্দর লাগে ওকে। ওর সৌন্দর্যের ভাষা আমার জানা নেই। তবে আমার কাছে ও সবার চেয়ে সুন্দরী। মুখটা গোল না ডিম্বাকৃতির, হাসলে গালে টোল পড়ে যায়। সেদিনই প্রথম বসন্ত এসেছিল।
নূপুরের রিনিঝিনি তান আর কাকনের কিঙ্কন শব্দের মতো সে এসেছিল। এসেছিল শুভ্র সাদা বরফের মতো পূত-পবিত্রতায়। প্রজাপতির লাল-নীল প্রশাখায় সে এসেছিল এবং বলেছিল, কবি তোমাকে ভালবাসি। সেদিন কতো ছলনায় ইনিয়ে-বিনিয়ে নজরে পড়েছি, সেই থেমে থেমে পথচলায়।
তারপর আর থামতে হয়নি কখোনো কোনোদিন। যেন অশান্ত বিচরণ ছিল আমাদের। বুধ, শুক্র, নেপচুন, প্লোটো,তারপর মঙ্গল অতঃপর প্রক্সিমা সেঞ্চুরায়। উহ্ কি ভিষণ তাপ সেখানে। প্রচণ্ড উত্তাপে ছুটে গেলাম চাঁদের মাটিতে। চাঁদের নয়নাভিরাম দৃশ্যে তার মুখে হাসির ফোয়ারা আর আমার এ বুকে সুখের নহর বইছিল।
তবুও জানিনা কেনো এলাম পৃথিবীতে। সেই যে এলে আরতো ফিরে গেলে না। চলনা ফিরে যায় এ ভূবনের মায়ামৃগ ছেড়ে আরেক পৃথিবী। কাটলোতো বহুদিন সেই যে ওয়াশিংটন, নিক্সন, রিগান, বুশ, ক্লিনটন আর আজকের ওবামা পর্যন্ত।
তারপরও ভেসেছি পৌষের হিমেল হাওয়ায়। শরৎ, হেমন্তে সেই সুবর্ণ দিনগুলোতেও। উদ্দিপ্ত যৌবনে ভরে ওঠা আকাশ দেখেছি নীলাভ সবুজের ঘনঘটায়। আলো-ছায়া আড়ালের মায়া মমতায় সেই এক বসন্তের গান ছিল। তারপর একদিন প্রচণ্ড গতিতে যেন উল্কার মতো ছুটে এলো গৃষ্মের দাবদাহ। হঠাৎ কে যেন ওলট-পালট করে দিল জীবনের সব বসন্তকে। এরপর চৈতের প্রখরতায় চৌচির ললাটে অঝরে বৃষ্টি ঝরলেও বসন্ত আসেনি।
তারপর নীলাঞ্জনা এক সময় হারিয়ে গেল। রক্ষণশীল পরিবারের এক অলঙ্ঘনীয় নিয়মে সে চলে গেল অন্য কারো ঘরে। এ যেন আমাদের সুরের মূর্ছনায় এক অসহনীয় ছন্দপতন। নীলাঞ্জনাকে কিছু না বলেই ওর পরিবার বিয়ের কাজটা শেষ করে ফেলে। নীলাঞ্জনা হারিয়ে যায় আমার জীবন থেকে।
এরপর বহুদিন চলে গেছে। সেই পথচলার পথগলি আর ফিরেও দেখিনি। খুঁজিনি কোনো নীল চোখ, নীল আর নীলাঞ্জনাকে। দিবসের কাকডাকা ভোর থেকে গভীর নিশি পর্যন্ত হেঁটেছি একা। সুরের মুর্ছনায় বাজাইনি কোনো বীনা। গভীর সমুদ্রে ভাসাইনি কোনো পাল তোলা নাও। মাঝে মাঝে মনে হয় আমি একটা সাগর পেরুলাম। কি অসম্ভব রকম গভীরতায় ঢেউ খেলে গেল বুকের পাজড়ে। তথাপি আমি সাগর পেরুলাম।
নীল সাগরের তীরে দাঁড়িয়ে নীলাভ সাগরের ঘনঘটায় একবুক নীল বেদনা এ বুকে ধারণ করেছি। এইতো বয়ে চলেছে নিরন্তর জীবন যেন অনাদি কাল ধরে।
তারপর দীর্ঘ প্রায় সাড়ে চার বছর কেটে গেছে। নীলাঞ্জনার কোলজুড়ে এসেছে তার জুনিয়র। কিন্তু ঘটে গেছে এক অনাকাক্সিক্ষত ঘটনা। এসবের কিছুই আমি জানতাম না যদি না নীলাঞ্জনা আমাকে হঠাৎ করেই মোবাইল করে বসতো। সেই পরিচিত কণ্ঠস্বর আমাকে আবার আহ্বান করল। কি বলবে নীলাঞ্জনা আবার সাড়ে চার বছর পর। নাকি শুনবে কিছু। যাহোক আবার দেখা হলো আমাদের সেই নীল মোহনায়।
-রানা তোমাকে কিছু বলতে চায় আমি।
-বলো, আমিতো শুনতেই এসেছি।
-রানা আমরা কি পারি না সেই আগের জীবনে ফিরে যেতে?
-কি বলছো তুমি? তোমার স্বামী সংসার সন্তান এসব?
-না কিছুই নেই। স্বামী সংসার কিছুই নেই শুধু সন্তান ছাড়া।
-প্লিজ নীল হেয়ালি ছাড়ো, খুলে বলো তোমার চোখে পানি কেনো?
-সে অনেক কথা রানা। যে বিত্তের কারণে তোমার আমার মিল হয়নি। সেই বিত্তই আমার সবকিছু কেড়ে নিল। প্রচুর বিত্ত-বৈভব দেখে বাবা আমাকে রায়হানের সঙ্গে বিয়ে দেয়। কিন্তু এই সম্পদই অন্যের চক্ষুশূল হলো। আমার রাজনীতিবিদ স্বামী চেয়ারম্যান নির্বাচনের প্রস্তুতি নিতে যাওয়ায় ঘটে আমার জীবনের সবচেয়ে দুঃখজনক ঘটনা।
প্রতিপক্ষের অভিযোগে সে দুর্নীতিবাজ ও সন্ত্রাসী অভিযুক্ত হয়। এক সময় গত মাসে সে র্যাবের ক্রসফায়ারে নিহত হয় এবং আমি হারায় আমার জীবনের একমাত্র অবলম্বন এবং আমার বাবুনি হারায় তার পিতাকে। এখন আমি কি করবো, কোথায় যাব রানা? এই একটা মাসে আমি মনের সঙ্গে অনেক যুদ্ধ করেছি এবং অনেক কষ্টে তোমার মোবাইল নাম্বারটা জোগাড় করে তোমাকে কল করি। প্লিজ তুমি আমাকে একটা সাজেশন দাও। আমি ভুলে যেতে চাই ঐ সাড়ে চারটা বছর।
-কিন্তু আমিতো আর আমাতে নেই নীল। নীল সাগরের বেলাভূমিতে দাঁড়িয়ে আমি আজ অন্য কেউ। অন্য কোথাও অন্য কোনো খানে।
-তারপরও রানা কিছু করুণা কি অবশিষ্ট থাকে না?
-দেখ নীল, ভালবাসা এবং করুণা পাশাপাশি অবস্থান করে। একে অপরকে আলাদা করা অসম্ভব। করুণা করতে করতে যেমন ভালোবাসার সৃষ্টি হয় তেমনি ভালোবাসাও এক সময় করুণাই পর্যবশিত হতে পারে। জগতের সমূদয় সৃষ্টি এই দুইয়ে আবর্তিত।