রিমি রুম্মান : তখন মে মাসের তৃতীয় সপ্তাহ। হালকা ঝিরিঝিরি বাতাস প্রকৃতিতে। চারপাশে ফুলের মৌসুম। চেরি ফুলের গোলাপি রঙে ছেয়ে গেছে গোটা শহরের রাস্তার দুইধার। এমনকি বাড়ির সামনের খোলা উঠানও। উঠানের সবুজ ঘাস আগের চেয়ে আরো গাঢ় সবুজে রূপ নিয়েছে। ব্যালকনিতে বসে নিচে লনের দিকে তাকালে সেখানকার সৌরভমাখা সৌন্দর্য মন কেড়ে নেয় সহজেই। এমন পরিবেশে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেওয়া যায় অনায়াসে। একচিলতে ব্যালকনি, গাছগাছালি ঘেরা সবুজ উঠান, এসব ছেড়ে কোথাও যেতে ইচ্ছা করে না আজকাল মোনার। এখানে বসলে তার রোজ উপলব্ধি হয়, প্রকৃতির সাথে কাটানো নিবিড় সময়ের চেয়ে স্বর্গীয় আর কী হতে পারে? যেখানে বসে একাধারে সে বিশাল মুক্ত আকাশ, পাখির ডাক, ফুলের সৌরভ এবং অস্বাভাবিক রকমের সবুজ প্রান্তর দেখতে পায়।
এত কিছুর মাঝে থেকেও প্রায়ই নিজেকে দূরের মূল সড়কের পাশে দাঁড়িয়ে থাকা ম্যাপল গাছের মতোই নিঃসঙ্গ মনে হয়। কিংবা আপস্টেটের সেই গহিন বনের মতোই শব্দহীন, একাকী। যেন দুর্লভ কোনো করুণ সংগীতের সুর ভেসে আসে সেই ঝিরিঝিরি পাইন বন থেকে। পৃথিবীর সমস্ত কিছু থেকে একা। একেবারেই একাকী নির্জন সময়ে সকলেই কি এমন সংগীত সুর শুনতে পায়? মোনা ভাবে, কারো মনোজগতে কোনোভাবে বিচরণ করার সুযোগ থাকলে বিষয়টা জানা যেত।
বিয়ের এক যুগ হতে চলেছে মোনা আর মারুফ দম্পতির। আজ অবধি সন্তানের মুখ দেখা হয়নি তাদের। সৃষ্টিকর্তা কাউকে দুই হাত উজাড় করে দেন, কাউকে শূন্য হাতে ফিরিয়ে দেন। অবশ্য সৃষ্টিকর্তাকে দোষ দিয়েই বা কী লাভ? তিনি দেননি কিছুই এমনটি বললে ধৃষ্টতা হবে, স্রষ্টাকে অবমাননা করা হবে। তিনি দিয়েছিলেন, কিন্তু মোনা-মারুফ দম্পতি সেই পাওয়াকে দুই হাতে ঠেলে দিয়েছিল সেই সময়ে। সময়টা তখন বড় বেশি প্রতিক‚লে ছিল যে!
দেশে বাবার সংসারে থাকাকালে মোনা যখন কেবল বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছিল, সেই সময়ে মারুফ বিশ্ববিদ্যালয় পাস করে চাকরি খুঁজছিল হন্যে হয়ে। মোনার বাবার বাসার চিলেকোঠার রুমটিতে ভাড়া থাকত মারুফ। আসা-যাওয়ার পথে রোজ দেখা হতো তাদের। ভালো ছাত্র হওয়ায় পড়াশোনায় মোনাকে অল্পবিস্তর সাহায্য করত সে। মারুফ নম্র, ভদ্র এবং জলের মতো শান্ত স্বভাবের হওয়ায় বিষয়টিকে মোনাদের বাড়ির কেউই সন্দেহের চোখে দেখেনি। যদিও তাদের একের প্রতি অপরের ভালো লাগা শুরু হয়েছিল প্রথম দেখার দিন থেকেই। কিন্তু তা প্রেমে গড়াতে খানিকটা সময় লেগেছিল। তবে এ প্রেম ভাঙচুর টাইপের কোনো প্রেম ছিল না। মোনা-মারুফ দুজনই ভাবনা-চিন্তায় বেশ পরিণত। পারিপার্শ্বিক অবস্থা, পরিবারের সম্মান বিবেচনায় বেশ সচেতন ছিল। মারুফের বিনয়, ভদ্রতা, নম্রতা মোনার বাবা-মায়ের বিশেষ পছন্দের ছিল। ওই বয়সী অন্য আরো ছেলেদের মতো সে নয়। মারুফের জীবনবোধ বেশ প্রখর। তার মনোযোগ পড়াশোনায়, চাকরি খোঁজায়, পরিবারের প্রতি দায়িত্ববোধে। স্কুলশিক্ষক বাবাদের সন্তানেরা সম্ভবত এমনই হয়ে থাকে। মারুফের বাবা-মা, ছোট ভাইবোন দুটি গ্রামে থাকে। পরিবারের বড় ছেলে সে। তার যে পরিবারের সবার প্রতি দায়িত্ব অসীম, এই চিন্তা তাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে ফেরে। একটি চাকরি না পেলেই যে নয়! ঢাকা শহরে চাকরি যেন সোনার হরিণ! মামা-চাচার ক্ষমতা ছাড়া চাকরি জোটাতে পেরেছে কে কবে, জানা নেই। তবু দমে যাবার কিংবা হতাশ হবার পাত্র নয়। দীর্ঘশ্বাস নেয় মারুফ। প্রাণপণে চেষ্টা করে যাচ্ছিল। বিভিন্ন অফিসে সিভি জমা দিয়েছে, ইন্টারভিউতে যোগ দিয়েছে, তারপর আর কোনো খবর থাকে না কোথাও, যেন শ্মশানের নীরবতা। চাকরি পাওয়া না-পাওয়ার দোলাচলের কঠিন সেই সময়টা প্রবল ঝড়ের কবলে পড়া ডিঙি নৌকার প্রতিক‚ল বাতাস মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবার মতো। রোজ ভোরে শহরের কোলাহল শুরুর আগেই বেরিয়ে যাওয়া, আর সন্ধ্যার আঁধার ঘনাবার কালে চিলেকোঠায় ফিরে আসা ছিল একরকম রুটিন জীবন।
সেদিন ছিল জুলাইয়ের এক উষ্ণ দুপুর। ভরদুপুরের এই সময়টায় যেন পুরো পৃথিবী ক্ষণিক থেমে থাকে। বিশ্রাম নেয়। বিশ্রাম নেওয়া হয় না কেবল ডাকপিয়নদের। পাড়ার ঘরে ঘরে চিঠি বিলি করে বেড়ায়। মোনা ভার্সিটি থেকে ফিরেছে কেবল। গেটের ভেতরে যাবার প্রাক্কালে ডাকপিয়নের ডাক, ‘আফা, আপনাদের চিঠি।’ খামটি হাতে ধরিয়ে দিয়ে ডাকপিয়ন ছুটছে অন্য ঠিকানার উদ্দেশে, যেন তার অনেক তাড়া। মোনা খামের ওপর প্রাপকের নাম দেখে একনজর। মারুফ মাহমুদ। ইউএসএ থেকে এসেছে। সন্ধ্যায় ক্লান্ত, শ্রান্ত মারুফ বাইরে থেকে ফিরে খুব ধীরে সিঁড়ি ভেঙে উপরে যাচ্ছিল। রবীন্দ্রসংগীতের মতোই ধীরে, খানিক টলায়মান। উটের কাফেলার মানুষজন যেমন কিছুটা কুঁজো হয়ে হাঁটে, অনেকটা তেমন। যেন সে জানে না তার পা দুটি কোথায়, কোন গন্তব্যের দিকে হাঁটছে। সিঁড়ির দিকে পায়ের আওয়াজ পেয়ে মোনা দরজা খুলে সিঁড়ির গোড়ায় এসে দাঁড়ায়। মারুফের হাতে খামটি ধরিয়ে দেয়।
পরদিন প্রত্যুষে বাড়ির মানুষদের ঘুম ভাঙেনি তখনো। কলিংবেলের শব্দে ঘুমজড়ানো এলোকেশী মোনা খানিক বিরক্তিতে দরজা খোলে। কে এল এই সাতসকালে? দরজা খুলতেই ভড়কে যায়। এই ভোরে মারুফের হাসি ছড়ানো মুখ! ঠোঁটের ওপর আঙুল ছুঁয়ে শব্দ করতে বারণ করে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই মোনাকে জড়িয়ে ধরে খুশিতে। সূর্যের সোনালি কিরণ জলের ওপর পড়লে তা যেমন উজ্জ্বল চিকচিক করে ওঠে, তার মুখখানি সেই মুহূর্তে ঠিক তেমন ছিল। কেউ কি দেখে ফেলল? ডানে-বাঁয়ে ভীতসন্ত্রস্ত মোনা ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। তার ঘুম উবে গেছে দুই চোখ থেকে। মোনার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে বলে মারুফ, ‘এবার আর কোনো চিন্তা নেই।’ অতঃপর একটু দূরত্বে গিয়ে হাত দিয়ে প্লেন ওড়ার ভঙ্গিতে আকাশের দিকে দেখিয়ে বলে, ‘স্বপ্নের দেশে চলে যাচ্ছি সহসাই।’ মোনার মুখজুড়ে অন্ধকার নেমে আসে। তাকে ছেড়ে মারুফ বিদেশে চলে যাবে? সে কি মোনাকে না জানিয়ে স্টুডেন্ট ভিসার জন্য কোনো দেশে আবেদন করেছিল? মুহূর্তেই সংবিৎ ফেরে মারুফের কথায়, ‘আমি ডিভি লটারি জিতেছি, বুঝলে?’ মোনার মুখে হাসি ফোটে। মাসখানেক আগে সে-ই আবেদন করেছিল মারুফের হয়ে। মারুফ তখন তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, ‘আমার তো ভাগ্য কখনোই এত সুপ্রসন্ন নয়, খামোখা এসব করে সময় নষ্ট করে কী লাভ?’ মোনা কেন যেন খুব আত্মবিশ্বাসের সাথে খামের মুখ বন্ধ করে ডাকবাক্সে ফেলে দিয়ে এসেছিল একেবারে শেষ দিনে। মোনার মনে হয়েছে, করেই দেখি না। না করলে তো আর আশা করাই দুরাশা! করলে বরং আশা থেকে যায়।
সেদিনের একটিমাত্র খাম তাদের জীবন বদলে দিয়েছে। মনে হয়েছে, সারা পৃথিবী যেন কিনে নিয়েছে তারা। এরপর মোনা-মারুফের বিয়ের বিষয়টি আরো সহজ হয়ে ওঠে। দুই পরিবারের কেউই আর আপত্তি করেনি এ বিয়েতে। শুধু এয়ারপোর্টে বিদায় জানাতে এসে মারুফের বাবা দুহাত চেপে ধরেছিলেন। বাবার হাত দুখানার স্পর্শ নিবিড় প্রাচীন বৃক্ষের ন্যায় খসখসে আর স্বাভাবিকের চেয়ে শীতল মনে হলো মারুফের। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শৈত্যপ্রবাহ দিনের মতোই শীতল। বাবার চোখের আবদ্ধ জল আর বাঁধ মানতে পারেনি। উপচে পড়েছিল কপোল বেয়ে। কাঁপা কণ্ঠে শুধু বলেছিল, ‘বাবা মারুফ, তোমার ছোট ভাইবোন দুইটার কথা ভুইল্যা যাইয়ো না বৈদেশ গিয়া। তোমারে বহুত কষ্টে লেহাপড়া শিখাইছি। জমিজমাও আর কিছু অবশিষ্ট রাখি নাই।’ মারুফের বুক ভেঙে কান্না পাচ্ছিল। কান্না লুকাতে তাড়াহুড়োর অভিনয় করে সে। বাবার খসখসে কঠিন চামড়ার হাত ছেড়ে পা ছুঁয়ে সালাম করে। মোনাও আবেগপ্রবণ হয়ে ওঠে পিতা-পুত্রের কথোপকথন শুনে। সালাম করে শ্বশুরকে। অতঃপর ইমিগ্রেশন কাউন্টারের দিকে এগিয়ে যায়। যেতে যেতে পাঁজরভাঙা দীর্ঘশ্বাসে পিছু ফিরে চায় মোনা-মারুফ দম্পতি। একসময় দৃষ্টিসীমায় একটি বিন্দুর মতো মিলিয়ে যায় বাবা এয়ারপোর্টের কাচের দেয়ালের ওপাশে।
আমি রিমঝিম।
এই স্বপ্নের শহর নিউ ইয়র্কে বসতি গেড়েছি এক যুগ আগে। মোনার সাথে আমার পরিচয়টা হয়েছিল হাসপাতালে। মোনার পুরো নাম সুমনা মাহমুদ। আমার দূরসম্পর্কের এক আত্মীয় এসেছিলেন দেশ থেকে। তিনি সন্তানসম্ভবা। এসেছেন ভিজিট ভিসায় আমার অতিথি হয়ে। উদ্দেশ্য, আমেরিকায় সন্তান জন্মদান শেষেই আবার দেশে ফিরে যাবেন। আমেরিকার ভ‚খÐে জন্মগ্রহণ করলে শিশুটি জন্মসূত্রে আমেরিকার নাগরিক হবে, সেই ভাবনা থেকে এমন পরিকল্পনা পরিবারটির। সেই আত্মীয়কে নিয়ে আমি হাসপাতালে গিয়েছিলাম নিয়মিত চেকআপে। ওয়েটিং এরিয়ায় বসে আছি। রুমভর্তি রোগী। কেউ কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছিলেন চোখ বুজে। কেউ ফোন দেখছেন ঘাড় নিচু করে। কেউবা নিউজপেপারে গভীর মনোযোগে চোখ বুলাচ্ছেন। আমাদের বাংলা কথোপকথন শুনে একজন নারী পাশের চেয়ার থেকে বিস্ময়ে তাকালেন। একটু এদিকটায় ঝুঁকে জানতে চাইলেন, ‘আপনারা বাংলাদেশি?’ নিজ ভাষার কাউকে পেয়ে স্বস্তি পেলেন যেন। হাতের কাগজটি সামনে এগিয়ে দিয়ে খানিক সহযোগিতা চাইলেন। প্রয়োজনীয় তথ্যসংক্রান্ত কাগজটি পূরণ করে সামনে ডেস্কে জমা দিয়ে ফের বসলেন। জানালেন, ডাক্তারের সাথে এটি তার নিয়মিত সাক্ষাৎ। আমাদের আগে অনেক রোগী বিধায় আমরা হাসপাতালের বাইরের বেঞ্চিতে মুক্ত আকাশের নিচে এসে বসি।
সময়টা অক্টোবর মাসের শুরুর দিক। শহরজুড়ে হিমেল বাতাস বইছিল। আমরা নানান বিষয়ে গল্প করছিলাম। একপর্যায়ে তিনি বললেন,
‘দোয়া করবেন, যেন মিরাকল কিছু হয়’ কথাটি কানে আসতেই ফিরে তাকাই। তিনি বলেন, নয় বছরের সংসার-জীবন, অথচ কোনো সন্তানসন্ততি হয়নি আজো। নিঃসন্তান। আক্ষেপ আর দীর্ঘশ্বাসের সংমিশ্রণে বেদনাবিধুর এক পরিবেশ তখন। তিনি বলে চলেছেন, ‘দেশে গিয়েছিলাম দুবার বেড়াতে। কিন্তু সে বেড়ানো আনন্দদায়ক ছিল না। তিক্ত আর বিরক্তিকর অভিজ্ঞতা নিয়ে ফিরে এসেছি প্রতিবার। ফের দেশে যাবার আগ্রহ মিটে গেছে।’
Ñকেন? (জানতে চাইলাম)
Ñসেখানে সবার একটিই প্রশ্ন, এত দিন হয়ে গেল, কোনো সন্তান হয়নি কেন? বাঁজা (সন্তান জন্মদানে অক্ষম) নাকি?
এমন নানান প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হতো প্রায়ই। বিশেষ করে, শ্বশুরবাড়ির কেউ আর আগের মতো আপন করে গ্রহণ করেনি। বিদেশের কষ্টার্জিত অর্থ পাঠিয়ে সকল চাহিদা মেটানোর পরও এমন আচরণ আহত করে খুব।
আমি বলি, ‘জন্ম-মৃত্যু তো মানুষের হাতে নয়, এই সহজ কথাটি তো আমাদের সবার জানা।’
তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন। সূর্যের কিরণে আধো বুজে আসা চোখে সামনে তাকালেন। হালকা শীতল বাতাসে উড়ে আসা চুল কপাল থেকে সরাতে সরাতে বললেন, ‘আচ্ছা বলেন তো, এখানে আমার কী করার আছে? আমি তো বাঁজা নই। এ দেশে আসার পর একবার কনসিভ করেছিলাম। তখন আমাদের প্রস্তুতি ছিল না। এ দেশে আসার আগে আমার স্বামীর পরিবার অনেক ঋণে জর্জরিত ছিল। তা ছাড়া তার ছোট ছোট ভাইবোনের পড়াশোনার খরচসহ পরিবারে নানাবিধ আর্থিক সংকট প্রকট ছিল। বিধায় দুজনে মিলেই নির্দয়, কঠিন সিদ্ধান্তটি নিয়েছি, এখনই কোনো সন্তান নয়। যদিও ঈষৎ ভাবনা জেঁকে বসেছিল, প্রথম সন্তান নষ্ট করা ঠিক হবে কি না। স্বামী-স্ত্রী দুজন মিলে দিনরাত কঠোর পরিশ্রম করেছি, দেশে টাকা পাঠিয়েছি, স্বামীর ছোট ভাইবোনদের সুন্দর ভবিষ্যৎ হয়েছে। পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে। গ্রামে ইটের দালান করা হয়েছে। অবশেষে যখন বাবা-মা হবার জন্য নিজেদের প্রস্তুত মনে হয়েছে, নিজেদের দিকে ফিরে তাকাবার সময় হয়েছে, সন্তানের জন্যে উন্মুখ হয়েছি, তখন তো আর ¯্রষ্টা ফিরে চান না। বিগত কয়টি বছর সীমাহীন উৎকণ্ঠায় অপেক্ষার প্রহর কেটেছে একটি সুসংবাদ শুনব বলে। সেই থেকে ডাক্তারের কাছে ছোটাছুটি। এই পর্যন্ত বলে হাতের উল্টো পিঠে অশ্রæসজল মুখ মুছলেন। বুকের ভেতর থেকে কেঁপে কেঁপে আসা দীর্ঘশ্বাস লুকাতে চাইলেন।
বাইরে বাতাসের তীব্রতা বেড়েছে। সাথে শীতও। ভেতরে যাওয়া প্রয়োজন। কখন আবার ডাক পড়ে! হাসপাতালের করিডর ধরে হাঁটতে হাঁটতে বলি, কিছু মনে না করলে একটি প্রশ্ন করি?
Ñহুম, করুন।
Ñতুমি বয়সে আমার অনেক ছোট। তুমি করেই বলি। এ ব্যাপারে তোমার স্বামীর অভিমত কী?
Ñআমার স্বামী ভালো মনের মানুষ। তিনি আমাকে বোঝেন। নিজেকে অপরাধী ভাবেন, একটি নিষ্পাপ ভ্রƒণ নষ্ট করার অপরাধে। নিজের বাবা-মা, ভাইবোনের সুখ চাইতে গিয়ে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে গিয়ে নিজের সুখটুকুই চিরতরে হারাতে বসেছেন। তিনি তার পরিবারের ওপর যারপরনাই বিরক্ত, ব্যথিত। শেষবার দেশ থেকে ফিরে আসার পর সব শুনে বাবা-মায়ের ওপর চটেছেন খুব। তাদের কঠিনভাবেই জানিয়েছেন, ‘তোমাদের দেখভালের জন্যই আমরা আমাদের প্রথম সন্তান পৃথিবীতে আনিনি তখন। আমার স্ত্রী তো বাঁজা নয়।’
আমি ভেবে পাই না, পৃথিবী কত এগিয়েছে, অথচ আমাদের মানসিকতা কতটা পিছিয়ে আছে! এখনো এই সমাজ একজন নিঃসন্তান দম্পতির ভেতরের দহন বুঝতে চায় না। ‘কাটা ঘায়ে নুনের ছিটা’র মতোই ক্ষতস্থান আরো যন্ত্রণাদায়ক করে তোলে। সবটুকু দায় একজন নারীর ওপর চাপিয়ে দেয়। স্বামী-স্ত্রী ভালো থাকলেও চেনা আপনজনেরা ভালো থাকতে দেয় না।
আমরা ওয়েটিং এরিয়ায় ফিরে আসি। অপেক্ষমাণ রোগী কমেছে। সুনসান নীরবতায় কেউ কেউ ঝিমুচ্ছে। নীরব আমরাও। কী বলব? কী বলা উচিত? আচমকা অ্যানাউন্সের গমগম শব্দ। স্পিকারে ডাকছে, সুমনা মাহমুদ…।
তিনি উঠলেন। একটি কাগজে ফোন নাম্বার লিখে দিয়ে শুধু বললেন, ‘আসি, দোয়া করবেন।’
তিনি বাঁ দিকের করিডর দিয়ে হেঁটে কাচের দরজার দিকে এগিয়ে যাচ্ছেন, যেদিকে ডাক্তারের রুম, সেই দিকে। আমি সেদিকে দৃষ্টি স্থির করে, মেঘলা মন নিয়ে বসে থাকি। নিজের ফেলে আসা সময়ের কথা ভাবি। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করার সময়টাতে আমরা বেশ কয়েক বছর সন্তান নিইনি শুধু একটু গুছিয়ে নেব বলে। সাবলেটে থাকা এক রুমের সেই বাড়িটিতে কোথায় খেলা করবে, কীভাবে বেড়ে উঠবে একটি শিশু, সেই ভাবনায় এই সময় নেওয়া আমাদের। পাঁচ বছর বাদে দেশে বেড়াতে গিয়েছিলাম যখন, কেউ কেউ তাবিজ দিতে চাইল। কেউবা পানিপড়া। নির্বোধ আমি সেই অবুঝ মানুষগুলোকে বোঝাতে চেয়েছি। ব্যাখ্যা করতে চেয়েছি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! কজনের মুখই-বা বন্ধ করতে পেরেছি আমি? সবচেয়ে বড় ধাক্কা খেয়েছি খুব কাছের প্রিয় এক আত্মীয়ের কাছ থেকে। তিনি ফোন করেছিলেন আমার দেশে যাবার সংবাদ শুনে কুশলাদি জানতে। একপর্যায়ে ফোনের অন্য প্রান্ত থেকে বলেছিলেন, ‘কিছু মনে কোরো না, তুমি কি বাঁজা?’ সেদিন ফোনের রিসিভার রেখে নিশ্চুপ, মেঘলা মনে ঠায় বসে ছিলাম অনেকটা সময়, ঠিক আজকের মতোই, ভীষণ এক নৈঃশব্দ্যে। আমাদের নারীদের জীবনের সাথে জীবনের কত মিল! কোলাহলের মাঝেও বড় বেশি নৈঃশব্দ্য!
-নিউ ইয়র্ক।