ন্যায়বিচারের গুরুত্ব ও তাৎপর্য

ড. মুহাম্মদ নজরুল ইসলাম খান

আরবী আল-আদল শব্দের সাদামাটা বাংলা প্রতিশব্দ ন্যায়-বিচার। আল-আদল আল্লাহ তা’আলার ৯৯ বৈশিষ্ট্যের অন্যতম। আল্লাহ তা’আলা ন্যায়বিচারক, সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক তা আল-কুর’আনের বহু আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৯০: আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা, সদাচরণের আদেশ দেন। {১৬-নাহল}; ৪০: নিশ্চয়ই আল্লাহ কারো প্রাপ্য হক বিন্দু-বিসর্গও রাখেন না।{৪-নিসা}; ৪৭: আমি কেয়ামতের দিন ন্যায়বিচারের মানদন্ড স্থাপন করবো। সুতরাং কারো প্রতি জুলুম হবে না। যদি কোন আমল সরিষার দানা পরিমাণও হয়, আমি তা উপস্থিত করব এবং হিসাব গ্রহণের জন্যে আমিই যথেষ্ট। {২১-আম্বিয়া}; ১০৯: আর তুমি চল সে অনুযায়ী যেমন নির্দেশ আসে তোমার প্রতি এবং সবর কর, যতক্ষণ না বিচার করেন আল্লাহ। বস্তুতঃ তিনি হচ্ছেন সর্বোত্তম বিচারক।{১০-ইউনুস}। আকাশে অবস্থিত সকল বস্তুর মধ্যে রয়েছে মীযান [ভারসাম্য বা তুলাদন্ড]। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৭: তিনি আকাশকে করেছেন সমুন্নত এবং স্থাপন করেছেন তুলাদন্ড, ৮: যাতে তোমরা সীমালংঘন না কর তুলাদন্ডে।{৫৫-রহমান}। আয়াতে উল্লেখিত শব্দ মীযান [তুলাদন্ড ] অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। বলার অপেক্ষা রাখে না যে বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের সব কিছুই নিয়ম-শৃঙ্খলে আবদ্ধ এবং ন্যায়পরায়ণতা, শান্তি ও ইনসাফের মাধ্যমেই পৃথিবীতে নিরাপত্তা ও স্বস্তি কায়েম হতে পারে। অনেক বিশেষজ্ঞ মীযানের অর্থ করেছেন আল-আদ্্ল বা ন্যায়বিচার তথা দাড়িপাল্লা বা তুলাদন্ড। এর মূল লক্ষ্য হচ্ছে আল-আদল বা ন্যায়বিচার কায়েম করা এবং পারস্পরিক লেন-দেনে ন্যায় ও ইনসাফ কায়েম করা। {মা’আরেফুল কুর’আন, পৃষ্ঠা ১৩১৭}। উপরোক্ত আয়াতে আল্লাহ তা’আলা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা এবং ওজনে কম-বেশি না করার বিশেষ তাগিদ দিয়েছেন। সমগ্র বিশ্বে দাঁড়িপাল্লাকে আদালতে ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করা হলেও মানব সম্প্রদায়ের বৃহত্তর অংশ ও স্বৈরশাসকগণ মীযানের তেমন তোয়াক্কা করেন না। সুশাসনের এবং ন্যায়-বিচারের প্রতিশ্রুতি থাকা সত্ত্বেও অনেক মুসলিম শাসকের স্বেচ্ছাচারিতা, ঈর্ষাপরায়ণতা ও প্রতারণার বহুমুখী দাবানল থেকে জনগণ মুক্তি পাচ্ছে না। অথচ বিশ্ব মুসলিম সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৭: যারা ঈমান আনে [মুসলিম] ও সৎকর্ম [ন্যায়বিচার, সুশাসন প্রতিষ্ঠা] কওে, তারাই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ। {৯৮- বাইয়্যিনাহ}। কাজেই তাদের আচরণ ও সুশাসনের এবং বিচারকার্যের ধরর হবে অন্যদের জন্য উদাহরণস্বরূপ এবং শিক্ষণীয় বিষয়।
সকল মানব সন্তানের সাথে সদাচরণ ও ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা হচ্ছে ইসলামী মূল্যবোধের অন্যতম উদ্দেশ্য। আল-কুর’আনে কমপক্ষে ২০ টি আয়াতে মানব পার্থিব জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পবিত্র হাদিসের বর্ণনানুসারে আদ্্লের অপরাপর অর্থ হচ্ছে: ভারসাম্য রক্ষা করা, একটি বিষয়ের যথার্থ মর্যাদা দেওয়া, সমতা রক্ষা করা, নৈতিকতা অবলম্বন, জাতিধর্ম নিবিশেষে, আপন-পর, শত্রু-মিত্র এবং সকল সৃষ্ট জীবের সাথে ন্যায়পরায়ণ আচরণ করা। ইসলাম সার্বিক শান্তি প্রতিষ্ঠার সুষ্ঠু বিধিমালা দিয়েছে। সার্বিকভাবে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠিত করা ছাড়া সমাজে স্বস্তি ও শান্তি ও নিরাপত্তা আসেনা। মুসলিম শাসকদের সর্বদা মনে রাখা উচিত: এক আল্লাহ তা’আলার ইবাদত করার জন্যই মানব ও জ¦ীন সম্প্রদায়কে আল্লাহ তা আলা সৃষ্টি করেছেন, ৫৬: আমার ইবাদত করার জন্যই আমি মানব ও জ¦ীন জাতি সৃষ্টি করেছি। {৫১-যারিয়াত}। ন্যাপরায়ণতা বা ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার তাগিদ সম্পৃক্ত অন্যতম আয়াতে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৯০: আল্লাহ ন্যায়পরায়ণতা [আল-আদল], সদাচরণ [আল-এহসান] এবং আত্মীয়-স্বজনকে [আল-কুরবা] দান করার আদেশ দেন এবং তিনি অশ্লীলতা [আল-ফাহশা], অসঙ্গত [আল-মুনকার] এবং অবাধ্যতা [আল-বাগহী] করতে বারণ করেন। তিনি তোমাদেরকে উপদেশ দেন-যাতে তোমরা স্মরণ রাখ। {১৬-নাহল}। এই আয়াতে বর্ণিত তিনটি আদেশ এবং তিনটি নিষেধাজ্ঞা মেনে চলা বিশ্ব মুসলিমের একান্ত দায়িত্ব। এ সকল নির্দেশ ও নিষেধাজ্ঞা অবমাননার দরুনই বিশ্বজুড়ে অশান্তি ও অস্থিরতা আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাতের মত ছড়িয়ে পড়ছে। বর্তমান বিশ্বে রাজনৈতিক অস্থিরতা এবং অন্যান্য অপরাধের সাথে বিচারহীনতার সংস্কৃতি পুরোমাত্রায় বিদ্যমান। এর অন্যতম কারণ মানব সম্প্রদায়ের দুই-তৃতীয়াংশ ইসলামী মূল্যবোধে বিশ^াসী নয়। আবার মুসলমানগণও ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবনে ইসলামী মূল্যবোধের কোন গুরুত্ব দেয় না। আল্লাহ তা’আলা প্রদত্ত জীবনাদর্শ উপেক্ষা করায় পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র পরিচালনায় জড়িত হয়ে মুসলমানগণ মূলত ভয়ানক অপরাধ করে চলেছেন। অনেক আলেম বলে থাকেন: মানুষ যখন কোন গোনাহ করে, সে সারা বিশে^র মানুষ, চতুস্পদ জন্তু ও পশু-পাখীর প্রতি অবিচার করে। কারণ তার গোনাহর কারণে অনাবৃষ্টি ও অন্য যেসব বিপদাপদ দুনিয়াতে আসে, তাতে সব প্রাণীই ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এ প্রসঙ্গে আল-কুর’আনের আয়াত উল্লেখ করা যায়. ৪১: স্থলে ও জলে মানুষের কৃতকর্মের দরুন বিপর্যয় ছড়িয়ে পড়েছে। আল্লাহ তাদেরকে তাদের কর্মের শাস্তি আস্বাদান করাতে চান, যাতে তারা ফিওে আসে।{৩০-রূম}। {মা-আরেফুল কুর’আন, পৃষ্ঠা ১০৪৬}।
পবিত্র কুরআনের বর্ণনানুসারে প্রত্যেক ব্যক্তিই স্ব স্ব অবস্থানে একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি। ইবনে উমর (রাঃ) বর্ণনা করেন যে, রাসূল (সঃ) বলেছেন, তোমরা সাবধান হও। তোমরা প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল। আর [শেষ বিচারে] তোমাদের প্রত্যেকের দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। সুতরাং জনগণের শাসকও এজন্য শেষ বিচারের দিন জবাবদিহি করতে বাধ্য থাকবেন। এমতাবস্থায় পরিবারের সকল পুরুষ এবং মহিলাকে নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হবে। এই দৃষ্টিকোণ থেকে মালিক-কর্মচারি প্রত্যেকে নিজ নিজ কর্মের জন্য জবাবদিহি করতে বাধ্য হবেন। মহানবী (স) বলেছেন সাবধান! তোমরা প্রত্যেকেই একজন দায়িত্বশীল। আর তোমাদের এ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬, ৬৬৩৯}। রাসূল (সঃ) আরও বলেছেন, যদি কোন ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা প্রজা-পালনের দায়িত্ব অর্পণ করেন, কিন্তু সে তাদের কল্যাণ ও নিরাপত্তা বিধান করলো না, সে বেহেশতের গন্ধও পাবে না।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬, ৬৬৫১}। ইসলামী শরিয়তের দৃষ্টিতে আত্মীয়স্বজনের সাথে ভালো সম্পর্কে বজায় রাখার এবং বিভিন্ন সমস্যায় সাহায্য-সহযোগিতা করার আদেশ রয়েছে। অথচ অনেকে নানা ছল-চাতুরির আশ্রয়ে এবং অনেক ভাই নিজেদের বোনকে ন্যায্য অধিকার ও প্রাপ্য থেকে বঞ্চিত করে থাকে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৩৮: আত্মীয়স্বজনকে তাদের প্রাপ্য দাও এবং মিসকীন ও মুসাফিরদেরর। এটা তাদের জন্যে উত্তম, যারা আল্লাহ সন্তুষ্টি কামনা করে। তারাই সফলকাম। {৩০-রূম}। আত্মীয়তার সর্ম্পক ছিন্ন করার পরিণতি সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন, আত্মীয়তা আল্লাহ রহমানুর রহীমের সাথে জোড়ালাগা ডালস্বরূপ। সুতরাং আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, যে তোমার [আত্মীয়র] সাথে মিলিত হয়, আমি তার সাথে সম্পর্কে জুড়ি [তাকে পছন্দ করি বা ভালোবাসি]। আর যে তোমার সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করে আমিও তার সাথে সম্পর্কে ছিন্ন করি।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৫, ৫৫৫৩}।
ব্যক্তি ও কর্মজীবনে ধর্মীয় মূল্যবোধের গুরুত্ব না থাকায় মুসলিম সমাজেও অশান্তি দিনে দিনে বাড়ছে। অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি নিজেই অন্যায়ে জড়িত বলে অন্যের অন্যায়ের প্রতিকার বা প্রতিবিধান করতে পারছেন না। ফলে সমাজ এবং রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার রন্ধ্রে রন্ধ্রে অন্যায় ও দুর্নীতি স্থায়ী আসন পেতে বসেছে। অনেকে স্বেচ্ছায় বা চাপে পড়ে সকল অন্যায়-অবিচার ও নৈরাজ্যকে মেনে নিচ্ছে। ফলে নানাবিধ দুর্যোগ ও বিপর্যয় আমাদের জীবনের অঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এ ব্যাপারে রাসূল (সঃ) বলেছেন, আমার উম্মাহ যখন পনরটি বিষয়ে মগ্ন হবে তখন তাদের উপর বিপদ-মুসীবত আসবে। জিজ্ঞেস করা হল, ইয়া রাসূলুল্লাহ (সঃ) সেগুলো কি? তিনি (সঃ) বললেন: যখন গনীমতের মাল [বর্তমানে সরকারী সম্পদ] ব্যক্তিগত সম্পদে পরিণত হবে, আমানত [ব্যাংকে গচ্ছিত সম্পদ] লুটের মাল হয়ে যাবে, যাকাত জরিমানারূপে গণ্য হবে, পুরুষ তার স্ত্রীর আনুগত্য [অনৈতিক কাজে স্ত্রীর পরামর্শকে প্রাধান্য দিবে] এবং তার মায়ের অবাধ্য হবে, বন্ধুর সাথে সদ্ব্যবহার করা হবে কিন্তু পিতার সাথে দুর্ব্যবহার করা হবে, মসজিদে শোরগোল করা হবে, সবচাইতে নিকৃষ্ট চরিত্রের লোক হবে তার সম্প্র্রদায়ের নেতা, এমন লোককে তার অনিষ্টের ভয়ে সম্মান করা হবে, মদ পান করা হবে, রেশমী বস্ত্র পরা হবে, নর্তকী-গায়িকাদের প্রতিষ্ঠিত করা হবে, বাদ্যযন্ত্রকে কদর করা হবে এবং এই উম্মাহর শেষ জামানার লোকেরা তাদের পূর্বযুগের লোকদের লানত করবে, তখন তোমরা একটি অগ্নিবায়ু অথবা ভূমিধস অথবা চেহারা বিকৃতির শাস্তির অপেক্ষা করবে{তিরমিযী, ২১৫৭}।
আমেরিকায়ও বর্তমানে ধর্মীয় স্বাধীনতা, ন্যায়বিচার এখন হুমকির সম্মুখীন এবং মানবাধিকারও বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিঘিœত হচ্ছে সর্বোপরি অভিবাসী বিরোধী মনোভাব দিনে দিনে চাঙ্গা ও শাণিত হচ্ছে। ন্যায়বিচার সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন,‘হে আমার বান্দারা! আমি নিজের উপর জুলুমকে হারাম করে রেখেছি এবং তোমাদের মধ্যেও তা হারাম করেছি। কাজেই তোমরা পরস্পর জুলুম করো না।{মুসলিম, রিয়াদুস-সালেহীন, ১/১১১}। ন্যায়বিচারে ও ন্যায় শাসনে যে সকল শাসকবৃন্দ রয়েছেন তাদেও জন্য রয়েছে আল্লাহ তা’আলার তরফ থেকে সুসংবাদ। রাসূল (সঃ) বলেছেন, সাত ব্যক্তিকে আল্লাহ তা’আলা [কিয়ামতের দিবসে] তার [আরশের] ছায়াতলে আশ্রয় দিবেন, যেদিন তার ছায়া ছাড়া অন্য কোন ছায়া থাকবে না। [সাত ব্যক্তির মধ্যে] (১) ন্যায় পরায়ণ রাষ্ট্রনায়ক বা শাসক। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ২, ১৩৩৯}
আল-কুর’আন অবতীর্ণের পূর্বে সকল মানব সন্তানই শিরকের মত গর্হিত পাপে জড়িত ছিল। আল্লাহ তা’আলার অস্তিত্বে বিশ^াস করা সত্ত্বেও তারা ইবাদতে আল্লাহ তা’আলার সাথে অন্যবস্তুকে শরিক করতো। আহ্লে কিতাবীরা ওযায়ের এবং ঈসা (আঃ)-কে আল্লাহ তা’আলার পুত্র বানিয়ে শিরকে লিপ্ত থেকে নিজের প্রতি অবিচার ও জুলুম করছিলেন, আজও করছেন। খ্রিস্টানদের সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন ১৭: নিশ্চয় তারা কাফের, যারা বলে, মসীহ্ ইবনে মরিয়মই আল্লাহ। {৫-মায়েদা}। তাই তাদেরকে নিজের প্রতি জুলুম করা থেকে মুক্তি পাওয়ার এবং ন্যায়বিচার, নিরাপত্তা ও শান্তি প্রতিষ্ঠিত করার ব্যবস্থা সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৫: তোমাদের কাছে একটি উজ্জ্বল জ্যোতি [রাসূল (সঃ)] এসেছে একটি সমুজ্জ্বল কিতাব [আল-কুর’আন}। ১৬: এর দ্বারা আল্লাহ যারা তার সন্তুষ্টি কামনা করে, তাদেরকে নিরাপত্তার পথ [শান্তি ও ন্যায়বিচারের পশ] প্রদর্শন করেন এবং তাদেরকে স্বীয় নিদের্শ দ্বারা অন্ধকার [শিরক,অন্যায়-অবিচার] থেকে বের করে আলোর [একাত্মবাদের, নিরাপত্তার, শান্তির, ন্যায়বিচারের] দিকে আনয়ন করেন এবং সরল পথে [ইসলামী মূল্যবোধের] পরিচালনা করেন। {৫-মায়েদা}্ আরব জাহানে ছিল মূর্তিপূজার প্রচলন, নারীর প্রতি অবিচার, হিং¯্রতা, মূর্তিপূজা, গোষ্ঠী ও বংশ মর্যাদা রক্ষায় কলহ-বিবাদ-মারামারি, প্রভু-গোলাম শ্রেণী ভিত্তিক সামাজিক ব্যবস্থা। তখন অন্যায়-অবিচারে গোটা সমাজ সমাচ্ছন্ন ছিল। বিশ^প্রতিপালক মহানবী রাসূলের (সঃ) মাধ্যমে আল-কুর’আন নাযিল করে দয়াময় আল্লাহ তা’আলা আরবের সামাজিক অশান্তি, অস্থিরতা, শোষণ, জুলুম দূরে করে ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতা প্রতিষ্ঠা করেন। তাই ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় আল-কুর’আন দিয়েছে একটি সুনিদিষ্ট দিকনির্দেশনা। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৩৫: হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্কী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে প্রবৃত্তির কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সর্ম্পকে অবগত।{৪-নিসা}; ৮: ধর্মের ব্যাপারে যারা তোমাদের বিরুদ্ধে লড়াই করেনি এবং তোমাদেরকে দেশ থেকে বিতাড়িত করেনি, তাদের প্রতি সদাচরণ ও ইনসাফ করতে আল্লাহ তোমাদেরকে নিষেধ করেন না। নিশ্চয় আল্লাহ ইনসাফকারীদেরকে ভালোবাসেন।{৬০-মুমতাহিনা}; ৪২: নিশ্চয় আল্লাহ সুবিচারকারীদের ভালোবাসেন। {৫-মায়িদা}। এই আয়াত থেকে সুস্পষ্ট যে প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদায় ব্যক্তি বা গোষ্ঠী স্বার্থের দাবী পূরণ করতে গিয়েই মানব অন্যায়-অবিচারে লিপ্ত হয়। কাজেই যারা অন্যায়-অবিচার, বে-ইনসাফ করে, তারা সাধারণতঃ নিজের খেয়াল -খুশীর ইবাদত করে। আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ২৯: বরং যারা বে-ইনসাফ, তারা অজ্ঞানতাবশতঃ তাদের খেয়াল-খুশীর অুুসরণ করে থাকে। {৩০-রূম}। এমনকি কারও প্রতি ঘৃণা পোষণ করার মত কোন কারণ থাকলেও ন্যায়বিচারে দৃঢ়তা অবলম্বন করার আদেশ আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন, ৮: হে মু’মিনগণ! তোমরা আল্লাহর উদ্দেশ্যে ন্যায় সাক্ষ্যদানের ব্যাপারে অবিচল থাকবে এবং কোন সম্প্রদায়ের শত্রুতার কারণে কখনও ন্যায়বিচার পরিত্যাগ করো না। সুবিচার কর। এাঁই খোদাভীতির অধিক নিকটবর্তী। আল্লাহকে ভয় কর। তোমরা যা কর, নিশ্চয় আল্লাহ সে বিষয়ে খুব জ্ঞাত।{৫-মায়িদা}। এই আয়াতে রয়েছে সুবিচার প্রতিষ্ঠায় সাক্ষ্যদানে ন্যায়পরয়াণতার ভূমিকা। ন্যায়সাক্ষী হচ্ছে সুষ্ঠুবিচারের জন্য আমানত। রাসূল (সঃ) বলেছেন, আমি কি তোমাদেরকে উত্তম সাক্ষীগণের কথা বলব না? উত্তম সাক্ষী হল সে ব্যক্তি, যে তাকে সাক্ষ্য দিতে ডাকার পূর্বেই চলে আসে। {সহীহ মুসলিম, ৪৩৪৭}। অথচ বর্তমানে এ ব্যবস্থা নানা কারণে নির্বাসনে গেছে। উপরোক্ত আয়াতের নিদের্শনা মানা মুসলিম উম্মাহর জন্য আবশ্যক দায়িত্ব। জাতিধর্ম, বর্ণ, গোষ্ঠী, বিশ^াসী-আবশ^াসী সবার জন্যই ন্যায়বিচারের আদেশ আল্লাহ তা’আলা দিয়েছেন। এক্ষেত্রে সরকার, বিচারবিভাগ ও জনগণের সমান দায়িত্ব রয়েছে। বিচার বিভাগ আইনের সংশোধন করবে, সরকার আইন প্রণয়নের সব রকম ব্যবস্থা করবে এবং জনগণের দায়িত্ব হচ্ছে দেশের প্রতিষ্ঠিত আইনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে তা মেনে চলা এবং ন্যায়নীতি অনুসরণ ও সব কিছুতেই ইনসাফ এবং সরকারকে সাহায্য করা। এই তিনটির সমন্বয়ে সৃষ্টি হয় ন্যায়নীতির সুশাসনের সুযোগ। অথচ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বর্তমানে এর ব্যত্যয় ঘটছে। ব্যক্তি ও দলীয় স্বার্থের যুপকাষ্ঠে ন্যায়বিচার, মানবিক মূল্যবোধ ইত্যাদি মাথা ঠুকে মরছে। আমাদের মহানবী (সঃ) বললেন, তোমরা অপরের অধিকার পরিশোধ করে দিবে, আর নিজেদের অধিকার আল্লাহর নিকট প্রার্থনা করবে। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬, ৬৫৬২}। বর্তমানে ন্যায়বিচার বহু ক্ষেত্রে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। মুসলিম উম্মাহকে সর্তক করার জন্যে বিদায় হজ্বে রাসূল (সঃ) উপস্থিত লোকদের উদ্দেশ্যে বলেন, এটা কোন দিন? লোকেরা বলল, হজে¦র বড় দিন [আরাফাতের দিন]। তিনি (সঃ) বলেনঃ আজকের এ দিন এবং তোমাদেও এ শহর [মাক্কা মোক্কাররমা ] যেমন হারাম [মহাপবিত্র], তদ্রƒপ তোমাদের রক্ত, তোমাদের সম্পদ ও তোমাদের মান-সম্মান পরস্পরের জন্য হারাম [অর্থাৎ নিরাপরাধ মানুষ হত্যা করা, জোরর্পূবক মানুষের ধন-সম্পদ দখল করা]। সাবধান! অপরাধী নিজেই তার অপরাধের জন্য দায়ী। সাবধান! জনকের অপরাধ সন্তানের উপর এবং সন্তানের অপরাধ জনকের উপর বর্তায় না [তিরমিযী ২১০৬}।
সরকারকে সৎ পরামর্শ দেয়ার জন্য প্রায় সকল দেশেই উপদেষ্টা নিয়োগ দেয়া হয়। উপদেষ্টা প্রসঙ্গে রাসূল (সঃ) বলেছেন, আল্লাহ তা’আলা যাকেই নবী ও খলিফা বা প্রতিনিধি [শাসক গোষ্ঠী, রাজনৈতিক নেতা-নেত্রী, সামাজিক প্রশাসক ইত্যাদি] করে পাঠিয়েছেন [ দায়িত্ব পালনের সুযোগ দিয়েছেন], তার জন্যে দু’জন পরামর্শদাতা নিধারিত করে রেখেছেন। একজন পরামর্শদাতা তাকে (সর্বদা) ন্যায় ও সৎ কাজ করার জন্য নিদের্শ দেয় এবং সৎ কাজের জন্য তাকে উৎসাহিত করে। আর অপরজন তাকে অন্যায় ও অসৎ কাজের জন্য পরামর্শ দেয় এবং অন্যায় -অসৎ কাজের জন্য তাকে উৎসাহিত করে। অতএব নিষ্পাপ ও কলুষমুক্ত সেই ব্যক্তি যাকে [এমন খারাপ পরামর্শদাতা থেকে] আল্লাহ তা’আলা রক্ষা ও হেফাযত করেছেন। { সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬ ৬৬৯৩}। অর্থাৎ প্রতিটি মানবের সাথে রয়েছে একজন করে শয়তান এবং ফিরেশতা। মন্দকাজে সে শয়তানের পরামর্শ পায় আর ভালো কাজে ফিরেশতার সহযোগিতা পায়। এজন্য ভালো-মন্দ যাচাই করে তাকেই নির্ধারণ করতে হয় সে কার পরামর্শ গ্রহণ করবে। এক্ষেত্রে প্রবৃত্তির চাহিদা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
সুবিচারের স্বর্ণোজ্জ্বল উদাহরণ রয়েছে মুসলিম প্রথম চার খলিফার শাসনামলে। দ্বিতীয় আমিরুল ম’ুমিনিন উমর (রাঃ) ছিলেন দক্ষ ও ন্যায়পরায়ণ শাসক। মাঝে-মধ্যে তাকে প্রধান বিচারকের দায়িত্ব পালন করতে হতো। একবার নিজের সন্তান আবু সাহমাহ মদ্যপানে মাতাল হয়ে ব্যভিচারে লিপ্ত হলে একনারী অন্তঃসত্ত্বা হন। বিচারে নিজ সন্তানের উপর শরিয়ত ভিত্তিক শাস্তি ৮০টি বেত্রাঘাতের আদেশ দেন। তাতে সন্তান মৃত্যুবরণ করেন। কোন এক সভায় উমর (রাঃ) দেন মহারের একটি সীমা নির্ধারণ করার ঘোষণা দিলে উপস্থিত এক মহিলা আল-কুর’আনের আয়াত দ্বারা প্রতিবাদ করেন। আমিরুল মু’মিনিন উক্ত মহিলার প্রতিবাদ সমর্থন করে বলেছিলেন, আমার ভুল হয়েছে, মহিলাই ঠিক। সুবিশাল সাম্রাজ্যের খলিফা হয়েও হযরত আলী(রা)কে একবার আদালতে হাজির হতে হয়। যুদ্ধে ব্যবহারিত নিজের বর্ম হারিয়ে যাওয়ার পর এক খ্রিস্টানের কাছে সেটা দেখতে পান তিনি। গায়ের জোরে সেটি ছিনিয়ে না নিয়ে তিনি আদালতে বিচারপ্রার্থী হন। তার পক্ষে একমাত্র পুত্র আদালতে সাক্ষী দেন। আদালত সে সাক্ষী গ্রহণ করেনি। বিচারক আলী (রা) এর বিপক্ষে রায় দেন। বিচারকের ন্যায়বিচার এবং বিচারের প্রতি খলিফার শ্রদ্ধা দেখে সেই খ্রিস্টান পরবর্তীতে ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন। [দি পাইয়াস খালিফিস, ড. মজীদ আলী খান, পৃষ্ঠা ১০৮ এবং ২৩১]।
মূলত ন্যায় বিচার বা আদলের প্রকৃত ভিত্তি হচ্ছে আল্লাহ ভীতি ও জবাবদিহিতার বাধ্যবাধকতা। শেষ বিচারের প্রত্যেককে নিজ কৃতকর্মের জন্য জবাবদিহি করতে এই বিশ্বাস দৃঢ়ভাবে মনে পোষণ করলে কেউ ভুলক্রমেও অন্যায় করতে পারেনা। ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রা) ছিলেন অত্যন্ত ধীশক্তিসম্পন্ন ও বড় মাপের বিচারক। বিভিন্ন সমস্যার সমাধানে পূর্ববর্তী তিন খলিফার উপদেষ্টা ছিলেন, অথচ তিনি ছিলেন আল্লাহভীরু অত্যন্ত বিনীয় ব্যক্তি। এ প্রসংগে মুহাম্মদ ইবনে হানফিয়া বলেন আমি আমার পিতা [আলী (রাঃ)-কে] জিজ্ঞেস করলাম, নবী (সঃ)-এর পর কোন ব্যক্তি সকলের চেয়ে উত্তম? তিনি (রাঃ) বললেন, আবু বকর (রাঃ)। আমি আবার জিজ্ঞেস করলাম, অতঃপর কোন ব্যক্তি? তিনি বললেন. উমর (রাঃ)। আমার আশঙ্কা হলো, এবার জিজ্ঞেস করলে তিনি উসমানের কথা বলবেন। তাই আমি বললাম, অতঃপর তো আপনিই (সবচাইতে উত্তম)। তিনি বললেন: আমি তো অন্যান্য মুসলমানের মত একজন মুসলমান মাত্র।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৩, ৩৩৯৬}।
উল্লেখ্য, ইসলামের ৪ খলিফা কোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চ ডিগ্রী গ্রহণ করেনি। তাঁরা ন্যায় শাসন ও অন্যান্য জ্ঞান অর্জন করেছিলেন মহানবী হযরত মুহম্মদ (স) থেকে। তাদের অন্তরে ছিল আল্লাহ-সচেতনতা, পরকালে জবাবদিহির ভয় এবং পার্থিবের প্রতি, ক্ষমতাসীন হওয়ার প্রতি অতি সামান্য লোভ এবং আল্লাহ তা’আলার সন্তুষ্টির জন্য জীবন উৎসর্গ করার মানসিকতা। বিচারের ক্ষেত্রে আল্লাহ তা’আলার আদেশ মানায় তারা ছিল স্বতঃর্স্ফূত। বিচার সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৪৯: আর আমি আদেশ করছি যে, তুমি তাদেও পারস্পরিক ব্যাপারদিতে আল্লাহ যা নাযিল করেছেন, তদনুযায়ী বিচার করুন, তাদের প্রবৃত্তির অনুসরণ করবে না এবং তাদের থেকে সর্তক থাক- যেন তারা তোমাকে এমন কোন নিদের্শ থেকে বিচ্যুত না করে, যা আল্লাহ তোমার প্রতি নাযিল করেছেন। ৫০: তারা কি জাহেলিয়াত আমলের বিচার কামনা করে? আল্লাহ অপেক্ষা বিশ^াসীদের জন্যে উত্তম বিচারকারী কে? {৫-মায়িদা}। অর্থাৎ সর্বজ্ঞানী আল্লাহ তা’আলা মুসলিম উম্মাহর জন্যে বিচারের যে ব্যবস্থা দিয়েছেন, তা সর্বশ্রেষ্ঠ এবং তা মানা তাদের দায়িত্ব। অথচ মুসলিম উম্মাহ বিচারের ক্ষেত্রে ইসলামী বিচারবিধির আংশিক মানছে, এ কারণেই তারা পাপী এবং সীমালংঘনকারী। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ৪৭: যারা আল্লাহ যা অবর্তীণ করেছেন, তদনুযায়ী বিচার কওে না, তারাই পাপাচারী। (৫-মায়িদা}।
ন্যায়বিচার করা, সত্যকথা বলা, স্বজনপ্রীতি পরিহার করা এবং দুর্নীতির মূলোচ্ছেদের প্রচেষ্টা হচ্ছে পরহেজগারী বৈশিষ্ট্য। এটা একমাত্র ঈমানে দৃঢ়তা সম্পন্ন জবাবদিহিতার ভয়ে আল্লাহভীতি, আল-ফিতরায় প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তির পক্ষে সম্ভব। এই বিষয়টাই সূরা মায়িদার ৮ নম্বর আয়াতে আল্লাহ তা’আলা উল্লেখ করেছেন। প্রবৃত্তির চাহিদা পূরণে যারা সমাজে অনাচার সৃষ্টি এবং ন্যায়বিচারে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন, তারা অবগত নয় যে, শেষ বিচারে তাদেরকে এসকল অন্যায়ের ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। উম্মাহকে সর্তক করার জন্যে রাসূল (সঃ) বলেছেন, কোন ব্যক্তি আপন ভাইয়ের ওপর জুলুম করে থাকলে সে যেন তার কাছ থেকে [পার্থিবেই মৃত্যুর] পূর্বেই মাফ করিয়ে নেয়। কারণ শেষ বিচারে [মযলুম] ভাইয়ের পক্ষে তার নেকীর অংশ কেটে নেয়া হবে, কিন্তু যদি নেকী তার [জালিমের] নিকট মওজুদ না থাকে তবে, তার [মযলুমের] ভাইয়ের গুনাহ কেটে এনে-এর [জালিমের] সাথে যোগ করে দেয়া হবে। কেননা, সেদিন দিনার-দেরহামের কোন লেন-দেন কিংবা আদান-প্রদান চলবে না। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬, ৬০৮৪}। অন্যের ভূসম্পদ জবর দখল সম্পর্কে নবী (সঃ) এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি কারো জমিনের সামান্যতম অংশ আত্মসাৎ করেছে, কিয়ামতের দিন সাত তবক জমিনের নিচে তাকে ধসিয়ে দেয়া হবে। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৩, ২১৫৫}। আমানতের খিয়ানৎ ও অন্যের সম্পদ লুন্ঠন বর্তমান বিশ্বে ক্যান্সারের মত বিস্তার লাভ করেছে। এ সম্পর্কে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন. ৫৮: নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদেরকে নিদের্শ দেন যে, তোমরা প্রাপ্য আমানতসমূহ প্রাপকদের নিকট পৌঁছে দাও। আর যখন তোমরা মানুষের কোন বিচার-মীমাংসা আরম্ভ কর, তখন মীমাংসা কর ন্যায়ভিত্তিক। আল্লাহ তোমাদেরকে সদুপেশ দান করেন। নিশ্চয়ই আল্লাহ শ্রবণকারী, দর্শনকারী। {৪-নিসা}। আমাদের প্রিয় নবী(স) ধ্বংস আনয়নকারী ৭টি বিষয় থেকে দূরে সরে থাকার নির্দেশ দিয়েছেন। এগুলো হচ্ছে: আল্লাহর সাথে কাউকে অংশীদার স্থাপন করা। যাদু-মন্ত্র শিক্ষা করা বা ব্যবহার করা। এমন ব্যক্তিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করা যা আল্লাহ তা’আলা হারাম করেছেন, অবশ্য ন্যায়ভাবে হত্যা করা নিষিদ্ধ নয়। সুদ খাওয়া, এতিমের সম্পদ অন্যায়ভাবে ভক্ষন করা, জিহাদেও ময়দান থেকে পৃষ্ঠ-প্রদর্শন বা পলায়ন করা, সচ্চরিত্র-ঈমানদার নারীদের চরিত্র কলংকিত করা।{সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৬, ৬৩৮০}
বাংলাদেশসহ প্রায় সমগ্র বিশ্বে ঘুষ, দুর্নীতি, অন্যায় অনেকটা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পরিগ্রহ করেছে। রাজনীতিতে রয়েছে মিথ্যা আশ^াস দেওয়া, প্রুতিশ্রুতি ভঙ্গ করা, স্বজনপ্রীতি, পরচর্চ্চা, প্রতিহিংসাপরায়ণতা ইত্যাদি। সরকারি সম্পদ লুন্ঠন এবং ক্ষমতার অপপ্রয়োগে কথা বাদই দিলা। অথচ জনস্বার্থ সংরক্ষণ ও এতিমের ধন-সম্পদ রক্ষা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার প্রসংগে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৫২: এতিমের ধন-সম্পদের কাছেও যেয়ো না, কিন্তু উত্তম পন্থায়-যে পর্যন্ত সে বয়ঃপ্রাপ্ত না হয়। ওজন ও মাপ পূর্ণ কর ন্যায় সহকারে। আমি কাউকে তার সাধ্যের অতীত কষ্ট দেই না। যখন তোমরা কথা বল, সুবিচার কর, যদিও সে আত্মীয়ও হয়। আল্লাহর অঙ্গীকার পূর্ণ কর।{৬-আন’আম}।
দেশের বিচার ব্যবস্থাও প্রশ্নবিদ্ধ। গোষ্ঠী স্বার্থ অনেক সময় প্রাধান্য পায়। তাতে সমাজের অনেকেই ন্যায়বিচার পাওয়া থেকে বঞ্চিত থাকেন। এ কারণে উপরোক্ত আয়াতের পওে আল্লাহ তা’আলা বলেছেন. ১৫৩: তোমাদেরকে এ নিদের্শ দিয়েছেন, যেন তোমরা উপদেশ গ্রহণ কর। নিশ্চিত এটি আমার সরল পথ। অতএব, এ পথে চল এবং অন্যান্য পথে চলো না। তা হলে সেসব পথ তোমাদেরকে তার পথ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দিবে। তোমাদেরকে এ নির্দেশ দিয়েছেন, যাতে তোমরা সংযত হও। {৬-আন’আম}। মূলত উম্মাহর প্রতি আল্লাহ তা’আলার নির্দেশ হচ্ছে, ৩৬: তোমরা আল্লাহর ইবাদত কর এবং তার সাথে কাউকে শরীক করো না। আর মাতা-পিতার সাথে ভালো ব্যবহার কর এবং আত্মীয়, এতিম, মিসকীন, পাশের প্রতিবেশী, দূরের প্রতিবেশী, সঙ্গী-সাথী, মুসাফিরদেও সাথেও, আর তোমাদেও মালিকানাধীন যারা তাদেও সাথেও। আল্লাহ কখনো এমন লোকদের ভালো বাসেন না, যারা নিজেকে নিজে বড় মনে করে এবং বড়াই করে। {৪-নিসা}। প্রতিবেশীর প্রতি সুবিচার ও সদাচারণ করা সম্পর্কে রাসূল (সঃ) বলেছেন, আল্লাহর কসম! সে ব্যক্তি ঈমানদার নয়, আল্লাহর কসম! সে লোক মু’মিন নয়, আল্লাহর কসম! সে লোক মু’মিন নয়, জিজ্ঞেস করা হলো, ইয়া রাসূলুল্লাহ! কে সে ব্যক্তি? তিনি (সঃ) বললেন, যে ব্যক্তির অনিষ্ট থেকে তার প্রতিবেশী নিরাপদ নয়। {সহীহ আল-বোখারী, খন্ড ৫, ৫৫৮২}। অতএব বলা যায়, আল-আদ্ল বা ন্যায়বিচার ও ন্যায়পরায়ণতার প্রতিবন্ধক হচ্ছে মানব প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদা। প্রবৃত্তির চাহিদা নিয়ন্ত্রণে আল্লাহ তা’আলার উপর দৃঢ়ঈমান, আল্লাহ-সচেতন হৃদয় এবং শেষ বিচারে জবাবদিহির ভয় মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এ কারণেই আল্লাহ তা’আলা বলেছেন, ১৩৫: হে ঈমানদারগণ! তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক, আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্মীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদেও শুভাকাঙ্কী তোমাদের চাইতে বেশি। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার [প্রবৃত্তির অবৈধ চাহিদার] অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেচিঁয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ-কর্ম সর্ম্পকে অবগত।{৪-নিসা}।
আইওয়া।