ন্যায়বিচার : অপরাধ দমনের প্রধান ব্যবস্থা

এ বি এম ওসমান গণি

মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত। সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ মানুষগুলো কোনো কোনো সময় দুনিয়াবি স্বার্থ হাসিল করার জন্য ন্যায়নীতি বিসর্জন দিয়ে নানা রকম অপরাধে জড়িয়ে পড়ে। অপরাধীদের অপরাধ অনুযায়ী শাস্তি না হওয়ায় সমাজে অনাচার, জুলুম, অত্যাচার, হত্যা, ধর্ষণ ইত্যাদি বেড়েই চলেছে। ইনসাফভিত্তিক নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থার মাধ্যমে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দমন করা সম্ভব বলে বিজ্ঞজনের ধারণা। পবিত্র কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইনসাফভিত্তিক নিরপেক্ষ বিচারব্যবস্থা সংক্রান্ত প্রয়োজনীয় বিভিন্ন দিক তুলে ধরা হলো-
১. বিচারকের মর্যাদা : একজন বিচারক তার ন্যায়বিচারের মাধ্যমে পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র থেকে অপরাধ দূর করে সুন্দর সমাজ গঠনে ভূমিকা রাখতে পারেন। হাদিসের ভাষ্য অনুযায়ী- ন্যায়বিচারক বাদশাহ কিয়ামতের দিন আল্লাহর আরশের ছায়ায় স্থান লাভ করবেন এবং জান্নাতে যাওয়ার সৌভাগ্য লাভ করবেন। এ প্রসঙ্গে হজরত বুরায়দাহ (রা.) তার পিতার থেকে, তার পিতা রাসূলুল্লাহ (সা.) থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি (রাসূলুল্লাহ) বলেন, কাজীগণ (বিচারকগণ) তিন শ্রেণিভুক্ত। দুই শ্রেণির কাজী জাহান্নামি এবং এক শ্রেণির কাজী জান্নাতি। যে ব্যক্তি (কাজী) ন্যায়সঙ্গত ফায়সালা দান করে সে জান্নাতি। যে ব্যক্তি (কাজী) সত্য উপলব্ধি না করে অজ্ঞতার ভিত্তিতে বিবদমান দলের মধ্যে রায় দেয়, সে জাহান্নামি এবং যে ব্যক্তি (কাজী) জ্ঞাতসারে অন্যায় রায় দেয়, সেও জাহান্নামি। (সুনানে ইবনে মাজাহ, ২৩১৫ নং হাদিস)
২. উচ্চ-নীচ সবার বেলায় শাস্তি কায়েম করা : অপরাধীদের মধ্যে ধনী-গরিব, উচ্চ-নীচ, আত্মীয়-অনাত্মীয়, দলীয়-নির্দলীয় ভেদাভেদ না করে ন্যায়বিচারের স্বার্থে কোনো অযৌক্তিক সুপারিশ গ্রহণ না করে যথাযথ রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন করলে দেশে অপরাধের মাত্রা অনেকাংশে কমে আসবে। এ প্রসঙ্গে হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত- মাখজুমি গোত্রের এক মহিলা যে চুরি করেছিল তার ব্যাপারে কুরাইশ বংশের লোকদের খুব দুশ্চিন্তায় ফেলে দিয়েছিল। সাহাবিরা বললেন, রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে কে (সুপারিশের) কথা বলতে পারবে? আর রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রিয়জন হজরত উসামাহ (রা.) ছাড়া এটা কেউ করতে পারবে না। তখন হজরত উসামাহ (রা.) রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর সাথে (সুপারিশের) কথা বললেন। এতে তিনি (রাসূলুল্লাহ) বললেন, তুমি আল্লাহর শাস্তির বিধানের ব্যাপারে সুপারিশ করছ? এরপর তিনি দাঁড়িয়ে খুতবা দিলেন এবং বললেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! নিশ্চয়ই তোমাদের আগের লোকেরা গুমরাহ হয়ে গেছে। কারণ, কোনো সম্মানী ব্যক্তি যখন চুরি করত, তখন তারা তাকে ছেড়ে দিতো। আর যখন কোনো দুর্বল লোক চুরি করত, তখন তার ওপর শরিয়াতের শাস্তি কায়েম করত। আল্লাহর কসম! মুহাম্মদ (সা.)-এর কন্যা ফাতেমাও যদি চুরি করে, তবে অবশ্যই মুহাম্মদ (সা.) তার হাত কেটে দেবেন। (সহিহ বুখারি-৬৭৮৮ নং হাদিস)
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়েছে, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ অন্যায় সুপারিশ গ্রহণ না করে দেশের রাষ্ট্রীয় আইন অনুযায়ী শাস্তির বিধান কার্যকর করা যেতে পারে।
৩. ঘুষখোর ও ঘুষদাতা উভয়ের প্রতি লানত : ঘুষের লেনদেনের দ্বারা অনেক সময় ন্যায়বিচার ব্যাহত হয়। এটি আল্লাহ এবং তাঁর রাসূল (সা.)-এর কাছে অত্যন্ত ঘৃণিত কাজ। এদের ওপর রাসূলুল্লাহ (সা.) লানত করেছেন। হজরত আবু হুরাইরা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন- বিচারের ক্ষেত্রে ঘুষখোর ও ঘুষ প্রদানকারীকে রাসূলুল্লাহ (সা.) অভিসম্পাত তথা লানত করেছেন। (তিরমিজি, হাদিস নং ১৩৩৬)
৪. যাদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয় : ন্যায়বিচারের স্বার্থে সাক্ষীদের সাক্ষ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে কিছু লোকের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। হজরত আবদুল্লাহ বিন আমর ইবনুল শুয়াইব (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি তার পিতা থেকে, তার পিতা তার দাদা থেকে বর্ণনা করেছেন, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, প্রতারক (খেয়ানতকারী) নারী-পুরুষ, ইসলামী আইনের আওতায় হদ্দের শাস্তি ভোগকারী এবং বিপক্ষের প্রতি শত্রুতা পোষণকারীর সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়। (ইবনে মাজাহ, ২৩৬৬ নং হাদিস)
৫. ধর্ষণের শাস্তি : ধর্ষণ বর্তমান সময়ের সর্বাধিক আলোচিত বিষয়। দেশের আইন অনুযায়ী এদের সর্বোচ্চ শাস্তির প্রয়োগ জনসাধারণের কাম্য। হজরত আলকামাহ ইবনে ওয়াইল (রা.) থেকে, তিনি তার পিতা থেকে বর্ণনা করেন, তিনি বলেন- নবী (সা.)-এর যুগে জনৈকা মহিলা সালাত আদায়ের উদ্দেশে যাচ্ছিল। পথিমধ্যে এক ব্যক্তি তাকে নাগালে পেয়ে তার ওপর চেপে বসে তাকে ধর্ষণ করে। সে চিৎকার দিলে লোকটি সরে পড়ে। এ সময় অপর এক ব্যক্তি তার পাশ দিয়ে যাচ্ছিল। সে মহিলাটি ভুলবশত বলল- (এ সময় মুহাজিরদের একটি দল ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন) এ লোকটি আমার সাথে এরূপ করেছে। অতএব যার সম্পর্কে মহিলাটি অভিযোগ করেছে তারা দ্রুত এগিয়ে লোকটিকে ধরল। অতঃপর তারা তাকে তার কাছে নিয়ে এলে সে বলল, হ্যাঁ, এ সেই ব্যক্তি। তারা তাকে নিয়ে রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে উপস্থিত হলেন। তিনি তার সম্পর্কে ফায়সালা করতেই আসল অপরাধী দাঁড়িয়ে বলল, হে আল্লাহর রাসূল! আমিই অপরাধী। তিনি ধর্ষিতা মহিলাটিকে বললেন, তুমি চলে যাও, আল্লাহতায়ালা তোমাকে ক্ষমা করেছেন আর নির্দোষ ব্যক্তি সম্পর্কে উত্তম কথা বললেন। যে ধর্ষণের অপরাধী তার ব্যাপারে তিনি বললেন, তোমরা একে পাথর মারো। তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-কে বললেন, সে এমন তাওবাহ করেছে যে, মাদীনাবাসী যদি এরূপ তাওবাহ করে, তবে তাদের পক্ষ থেকে তা অবশ্যই কবুল হবে। (সুনানে আবু দাউদ, ৪৩৭৯ নং হাদিস)
উপরোক্ত হাদিস দ্বারা এটাই প্রমাণিত হয়েছে, অপরাধীকে শাস্তি দেয়ার ক্ষেত্রে কোনোরূপ ছাড় দেয়া যাবে না। আর অপরাধী স্বেচ্ছায় অপরাধের কথা স্বীকার করে তাওবাহ করলে তার তাওবাহ আল্লাহতায়ালা কবুল করবেন বলে কুরআন ও হাদিসে অনেক প্রমাণ রয়েছে। আমাদের দেশের সংবিধানের আইন অনুযায়ী অপরাধীর শাস্তির বিধান কার্যকর করা হলে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা হবে এবং অপরাধের মাত্রা কমে আসবে বলে আশা করা যায়।
৬. ন্যায়বিচার করা আল্লাহর নির্দেশ : ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে অন্যতম প্রতিবন্ধকতা হলো আত্মীয়তা। অপরাধী বিচারকের মাতা-পিতা, সন্তান-সন্তুতি, বন্ধু-বান্ধব, প্রতিবেশী অথবা নিকটাত্মীয় হলে অনেক ক্ষেত্রে বিচারক ক্ষমতার অপব্যবহার করে ভিন্ন পথ অবলম্বন করে ন্যায়বিচার করা থেকে বিরত থাকেন। যা আল্লাহতায়ালার নির্দেশের সম্পূর্ণ অমান্য হয়ে থাকে। আল্লাহতায়ালা সর্বক্ষেত্রে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার জন্য নির্দেশ দিয়েছেন। আল্লাহতায়ালা বলেন, হে মুমিনগণ! তোমরা আল্লাহর (সন্তুষ্টির) উদ্দেশ্যে সাক্ষ্যদানকারী, সুবিচার প্রতিষ্ঠাকারী হও এবং যদিও এটা তোমাদের নিজের অথবা মাতা-পিতার ও আত্মীয়স্বজনের প্রতিকূল হয়। যদিও সে সম্পদশালী কিংবা দরিদ্র হয়। আল্লাহ তাদের (ন্যায়বিচারকের) জন্য যথেষ্ট। (সূরা আন-নিসা, ১৩৫ নং আয়াত)
আল্লাহতায়ালা আমাদের ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার ক্ষেত্রে যার যার অবস্থান থেকে যথাযথ দায়িত্ব পালন করে সমাজ থেকে অপরাধ দমনের মাধ্যমে সুন্দর সমাজ গঠনের তাওফিক দান করুন।
আমিন।