আবু রায়হান
ম্যাগাজিনগুলোর সাথে একটি কাগজের প্যাকেটও আছে। সে হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে দেখে। ওজনে বেশ ভারী। এমনকি হতে পারে, বিমান কর্তৃপক্ষ প্রত্যেক যাত্রীর জন্য উপহারের ব্যবস্থা রেখেছেন। প্যাকেট খুলতেই লাল রঙের তরল হড়হড় করে বেরিয়ে এসে তার প্যান্ট, শার্ট, শরীর মাখামাখি হয়ে যায়। সে হতভম্ভ হয়ে পড়ে। আকাশ পথে এ কি ধরনের অভ্যর্থনা ! এর চেয়ে স্থলপথে বাসের কন্ডাক্টর জামাকাপড় ধরে টেনেহিঁচড়ে পেছনের দিকে চালান করে দেয়Ñওটাই তো ঢের ভালো ।
প্রথমে ভয়ে ভয়ে হাত দিয়ে ধরে দেখে এবং পরে তার মেধাবী মগজ খাঁটিয়ে সবুর খুব তাড়াতাড়ি স্থিরসিদ্ধান্তে উপনীত হয়। এই লাল রঙের তরল কোন সেন্ট বা মদ নয়Ñএটি দক্ষিণ এশীয়দের মুখ থেকে নিঃসৃত আদি ও অকৃত্রিম পানের পিক। কেউ একজন প্লেনে বসে মজা করে পান খেয়েছে, আর পিক ফেলার উপায় না পেয়ে বিমানের সুদৃশ্য কাগজের প্যাকেটে ভরেছে, তারপর সবুরের শরীরে মাখাবার জন্য যত্ন করে রেখে দিয়েছে।
বিমানবালা সাধ্যমত তার শরীর ঝেড়েমুছে দেয়। কিন্তু আরেক জনের মুখের লাল, ঝোল তার জামাকাপড়ে লেগে আছে-এই অনুভূতি কি সহজে দূর হবার? খুব ভালো হতো গোসল করতে পারলে। প্লেনে কি গোসলের সু-ব্যবস্থা আছে ? সে উঠে টয়লেট লেখা দরজার দিকে এগুতেই অন্য একজন বিমানবালা এসে পথরোধ করে দাঁড়ায়। প্লেন না ছাড়া পর্যন্ত নাকি টয়লেট ব্যবহার করা যাবে না।
কি মুশকিল! এটা তো বাংলাদেশ রেলওয়ের নিয়ম। তাদের বিধিনিষেধ ধার করে এনে উড়োজাহাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। রেলগাড়িতে অবশ্য এত ইংরেজির ব্যবহার নেই। সেখানে টয়লেটের দরজায় পরিষ্কার বাংলায় লেখা আছে, ‘গাড়ি ছাড়িবার পূর্বে পায়খানা ব্যবহার করা নিষেধ।’
রেলওয়ের সমস্যা বোঝা সহজ। ষ্টেশনের পরিবেশ নোংরা হবার ভয় আছে। স্টেশন মাষ্টার নোংরার মধ্যে থাকতে চান না। বিমানের কি সমস্যা ? মলমূত্র পড়ে রানওয়ে মাখামাখি হয়ে যাবে? কিন্তু তার শরীর যে আরেকজনের জারক রসে মাখামাখি হয়ে আছে, সেটার কি উপায় হবে? বিমানবালাকে বলে দেখবে নাকি, সে ফ্লাইটের আভ্যন্তরিণ দুর্ঘটনার শিকার। তার জন্য নিয়ম শিথিল করা হোক।
অনেক চেষ্টা করেও শরীর থেকে ঘিন্ঘিনে ভাবটা দূর হয়না। বিমানের লোকজন সেন্টের শিশি যোগাড় করে সিটের আশেপাশে ভালো করে ¯েপ্র করে দেয়, তাতেও খুব একটা হেরফের হয় না। অশুচি ভাব ক্রমেই শরীর ও মনে আষ্টেপৃষ্ঠে জেঁকে বসে। তাই পরিশেষে নিতান্ত বাধ্য হয়ে, দায়িত্বজ্ঞানহীন পানখোরদের উপর চটে গিয়ে সবুর হাত ব্যাগ খোলে। তারপর ব্যাগের গভীরতম তলদেশ হাতড়ে সিগারেটের রাংতা দিয়ে নিঁখুতভাবে মোড়ানো অনেকগুলো খিলিপানের একটা বের করে মুখে দেয়। জর্দার পরিচিত ঘ্রাণে কিছুটা স্বস্তি ফিরে আসে। স্বাদে ও গন্ধে এবারের খিলি পান অতীতের সমস্ত রেকর্ড ভঙ্গ করেছে। অশুচি ভাব খানিকটা কমে আসতে গভীর কৃতজ্ঞতার সাথে কুদ্দুস দোকানদারের কথা মনে পড়ে। তিনি সত্যিই রপ্তানি কোয়ালিটির খিলি বানিয়ে দিয়েছেন।
‘সবুর ভাই, পরের বার যখন বাংলাদেশে আসবেন, তখন আমার কথা আপনের মনে থাকবো না। যাতে মনে থাকে তার ব্যবস্থা করতেছি। এমুন পান বানায়ে দিমু-আমেরিকা, ইল্যান্ড কোথাও এর তুলনা পাইবেন না। তখন কুদ্দুস দোকানদারের কথা আপনের স্মরণ হইবো।’
প্লেনের নাক এতক্ষণে উপরে উঠতে শুরু করেছে। মাধ্যাকর্ষণের প্রভাব কাটানোর কারণেই হয়তো পেটের ভিতরে, বুকের ভিতরে বায়ুশূন্য অবস্থা তৈরি হয়েছে। এই অবস্থায় অদ্ভুদ এক অনুভূতির মধ্যে তলিয়ে গিয়ে সে কুদ্দুসের কথা ভাবতে থাকে। জনসংখ্যার ভারে পর্যুদস্ত এক দেশে তার আপনজন বলতে তেমন কেউ নেই। লতায় পাতায় যে দু’চারজন আছে, তাদের কথা কদাচিৎ মনে পড়ে। দেশের মাটি ছাড়ার সময় ঢাকা শহরের এক পান দোকানদার তার সমস্ত চেতনা দখল করে রাখে।
প্রথমদিকে বাকিতে পান খেতে গিয়ে সে খুব সংকোচবোধ করছে। তাকে ইতস্তত: করতে দেখে তিনি কতবার সবুরকে বলেছেন, ‘পকেটে পয়সা থাকলে দেন, না থাকলে নাই । আপনে আমার আপন ভাই ।’
কুদ্দুস দোকানদারের প্রতি প্রচন্ড মমত্ববোধের কারণে, আর শরীরে লেগে থাকা অন্যের রসকষের অস্তিত্ব ভুলে থাকার জন্য সে একের পর এক পান মুখে দেয়। পাশের সিটে বসা চোস্ত জামাকাপড় পড়া ফিটফাট টাইপের সহযাত্রী বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে থাকেন। বোধ হয়, প্রচন্ড বিতৃষ্ণার কারণে সারাটা পথ তিনি সবুরের সাথে একটা কথাও বলেন না।
প্লেন আটলান্টিকের অন্যপ্রান্তে এসে পৌঁছার পর, যখন ঝাপসাভাবে নিউইয়র্কের তটরেখা চোখে পড়ে, তখন সাথে করে আনা সব পান শেষ হয়ে যায়। পান শেষ হয়ে যাবার পর, এতক্ষণ ধরে ভুলে থাকা অশুচিভাব আবার ফিরে আসে। ক্রিষ্টোফার কলম্বাস প্রাণের ঝুঁকি নিয়ে খুব আগ্রহ করে যে দেশ আবিষ্কার করেছিলেন, সবুর গা ঘিন্ঘিন্ ভাব নিয়ে সেই দেশের মাটিতে পা রাখে। এয়ারপোর্টে আমাকে দেখে তার প্রথম কথা ছিল- ‘জাহিদ ভাই, পান খাওয়া দরকার। আমাকে একটা পানের দোকানে নিয়ে চলেন।’
রাজশাহীর পানের বরোজে গরুছাগল ঢুকে পানগাছ নষ্ট করলে বা পানবাহী ট্রাক দুর্ঘটনার শিকার হলে সুদুর নিউইয়র্কেও তার প্রভাব পড়ে। দোকানদার উৎফুল্লচিত্তে ক্রেতাকে জানান দেন, ‘পানের চালান আসে নাই। দাম বাইড়া গেছে।’ টেলিফোনের কল্যাণে সে খবর মুহূর্তে ছড়িয়ে যায় পান ভক্তদের মাঝে। তারা পান বিতরণের ক্ষেত্রে উদার মনোভাব বিসর্জন দেন। শুরু হয় পান ছিড়ে ভাগ করে খাওয়া। পানের চালান পৌঁছতে বেশি দেরী হলে ক্ষেত্রবিশেষ একটি পানপাতাকে ছয়ভাগে ভাগ হতেও দেখা যায়।
নিউইয়র্কের নিয়মিত পান ক্রেতাদের মধ্যে সবুরও একজন। পান, চুন, সুপারি ও জর্দার সমস্ত খবরাখবর তার নখদর্পণে। তবে একদিন পান কেনা শেষে সে বিক্ষুদ্ধ মনে ঘরে ফেরে। ‘বাঙালি দোকানদারের কান্ডটা দেখেছেন, জাহিদ ভাই?’ ‘কি করেছে দোকানদার ?’
‘দোকানের গায়ে বাংলায় লিখে রেখেছে, ‘এখানে ফান পাওয়া যায়’। ব্যাপারটা ভেবে দেখেন তো! ভ্যাগিস আমেরিকানরা বাংলা পড়তে পারে না। পারলে কি কেলেঙ্কারি যে হত, আল্লা মালুম! নিশ্চয়ই বাংলাদেশীদের মান ইজ্জত নিয়ে টানাটানি পড়ে যেত।
আমি তাকে ছেলে ভুলানোর ভঙ্গিতে বলি, ‘বেশি উত্তেজিত হয়োনা। দোকানদার হয়তো ঠিকই লিখেছে। ঐ দোকানে ফান বা মজা বিক্রি হয়। আমেরিকানরা খুব ফান পছন্দ করে তো! যেখানে মজা আছে তারা দলবেঁধে সেদিকেই ছোটে। ওদের দেশে থেকে দিনে দিনে আমরাও মজা শিকারী হয়ে উঠছি।’ আমি এই অস্বস্তিকর প্রসঙ্গ থেকে সরে যাবার জন্য বলি, ‘তুমি কি জানো এদেশে ছাগলের দুধ বিক্রি হয়?’
সে প্রসঙ্গ থেকে সরে আসতে চায় না। তাই কথা বলতে ইচ্ছুক নয়। শুধ আক্ষেপের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকেÑখুব মর্মাহত হয়েছে। আমি তা বুঝেও না বোঝার ভান করে সোৎসাহে বলতে থাকি, ‘এখানকার বনেদী ফুড মার্কেটগুলোতে ছাগলের দুধ বিক্রি হয়। দাম, গরুর দুধের দামের চেয়েও বেশি। অনেকে মজা পাবার জন্য নিয়মিত সেই দুধ খায়। ব্যাংকে সাত-আট অংকের ডলার থাকলে এদেশে সব মজা কিনতে পাওয়া যায়। চাইলেই তুমি অক্সিজেন চেম্বারে ঘুমাতে পারোÑধোঁয়া ধুলিমুক্ত নিশ্বাস গ্রহণ। পনেরো মিলিয়ন ক্যাশ ডলার থাকলে চাই কি একবার চাঁদের দেশ থেকেও ঘুরে আসতে পারো। সুতরাং, ফান শব্দটা এদেশে শুধু কথার কথা নয়, এটাকে পণ্য হিসেবে বিক্রিও করা হয়।
‘কিন্তু তাই বলে পান না লিখে ফান লিখবে ?’ তার কন্ঠ থেকে ক্ষুব্ধতার রেশ পুরোপুরি মিলিয়ে যায় না।
এবারে আমার কন্ঠেও অসহিষ্ণুতার প্রকাশ ঘটে, ‘তোমাকে এত করে বোঝানোর চেষ্টা করছি, ওরা পানের কথা উল্লেখ না করে ফান বা মজার কথাও লিখে থাকতে পারে।’
সে আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে, ‘আমি জানি, আপনি যা খুশি বলে বুঝ দেবার চেষ্টা করবেন। তাই প্রমাণস্বরূপ মজা কিনে এসেছি। দোকানে ঢুকে ওদেরকে বলেছি, দুই ডলারের ‘ফান’ দেন। ওরা আমাকে এই মজাগুলো দিয়েছে।’ সে কাগজের প্যাকেট থেকে পান বের করে দেখায়, ‘একটা ফান খেয়ে দেখবেন নাকি ?’=====
==
একজন উদ্যমী মেধাবী মানুষ কোথাও ঠেকে থাকে না। সে নিজের দেশেই হোক কিংবা প্রবাসে হোক। খান এমএ সবুর এ ব্যাপারে দৃষ্টান্ত স্থাপন করে তাক লাগিয়ে দিল। সে তার ভাঙ্গা ভাঙ্গা ইংরেজীতে সবকিছু দিব্যি চালিয়ে নেয়। কাজের স্থানে ম্যানেজার সন্তুষ্ট হয়ে ঘন ঘন তাকে ওভার টাইমের জন্য ডাকে। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমেরিকা আসার চার মাসের মাথায় ড্রাইভিং লাইসেন্স করে ফেলে। নিউইয়র্কে এই কাজটা এত তাড়াতাড়ি করা সম্ভব নয়। সে পাতানো এক বন্ধুর বন্ধুকে ধরে পাশের ষ্টেট নিউজার্সী থেকে ড্রাইভিং টেষ্ট দেয়ার ব্যবস্থা করল। তারপর সেই ড্রাইভিং লাইসেন্স দিয়ে ট্যাক্সি লাইসেন্সের জন্য ক্লাস করা শুরু করে। অনেকের কাছে শুনেছে ট্যাক্সি ড্রাইভিংয়ে আয় রোজগার বেশী। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ট্যাক্সি চালানো শুরু করতে চায়।
আমি দীর্ঘ সময় ধরে নিউইয়র্কে বাস করছি, অথচ এই কৌশলগুলি আজও জানিনা। তার কাজকর্ম দেখে মনে হয়, খুব তাড়া আছে। একদিন এ প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করতেই সে উত্তর দেয়, অবশ্যই তার তাড়া আছে। সে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যেতে চায়।
যারা গ্রীনকার্ড নিয়ে বৈধভাবে আমেরিকায় আসে, তাদের অধিকাংশই প্রথম দিকে এই ধরনের তাড়াহুড়া দেখায়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দেশে ফিরে যাবে। খামোখা বিদেশে পড়ে থাকার মানে হয় না। টাকাই কি জীবনের সব! তারপর একবার যখন উন্নত জীবনের স্বাদ পেয়ে যায়, তখন ভুলেও আর ফিরে যাবার কথা মুখে আনে না। বরং অন্যের মুখে এ ধরনের কথা শুনে বাঁকা চোখে তাকায়। ভাবখানা এই, আমি যা পারিনি সেটা তুমি কিভাবে পারবে! আমি অধম, তাই বলিয়া তুমি উত্তম হইবে? আমি সবুরের কথাকে সে ধরনের একটি কথার কথা ভেবে চুপ করে থাকি।
আমেরিকান সরকার নিম্ন আয়ের লোকজনকে বিনা পয়সায় চিকিৎসা সুবিধা দেবার জন্য মেডিকেইড কার্ড দিয়ে থাকে। সবুরের নামে সেই কার্ড এলে সে আমাকে দেখায়। কার্ডে লিখা ডাক্তারের নাম ঠিকানা দেখে বলি, ‘চলো, তোমাকে একদিন ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই।’
‘ডাক্তার দেখাতে হবে না। আমি ঠিক আছি।’
‘বাইরে থেকে ঠিক দেখতে মনে হলেও ভিতরে সব সময় ঠিক থাকে না। তাছাড়া টাকা-পয়সা তো আর লাগছে না। ফ্রি চেক করাতে অসুবিধে কি?’
তবু তার এক কথা-সে ডাক্তারের কাছে যাবে না, সময়ের অপচয়।
‘তাহলে চলো ডেন্টিষ্টের কাছে যাই। তোমার দাঁতের অবস্থা সত্যিই খারাপ। পানের লাল দাগ পাকাপোক্তভাবে বসে কালো রং ধারন করেছে।’
এবারে কি ভেবে সে রাজী হয়। ইজরায়েলী ইমিগ্রান্ট আবদেল নাসের সবুরের নির্ধারিত ডেন্টিষ্ট। তিনি কাউচে চোখ বন্ধ করে পড়ে থাকা ব্যথায় কাহিল রোগীর কাছে জানতে চান,
‘তোমার দাঁতের অবস্থা এত খারাপ হলো কি করে ?’
সেই ডাক্তার ইতিমধ্যে সবুরের মুখে দু’খানা যন্ত্র ঢুকিয়ে দিয়েছেন। ‘ছেদন যন্ত্র আর শোষন যন্ত্র’। ছেদন যন্ত্র দাঁতের গোড়ায় জমে থাকা ময়লা কেটে বের করে। করাত দিয়ে কাঠ ফাড়াই করার মত ব্যাপার। কাঠের গিরায় আটকে গেলে করাতের শব্দ বদলে যায়। তখন ঘ্যাস্ঘ্যাস্ শব্দের পরিবর্তে মিহি চিকন আওয়াজ বের হয়। ময়লার পরিমান বেশী হলে ছেদন যন্ত্রও সেভাবে মিহি সুরে শব্দ করে, তখন সবুরের খুব ব্যথা লাগে। সে শরীর শক্ত করে ব্যথার লগ্ন শেষ হবার অপেক্ষায় থাকে। শোষন যন্ত্রের পাইপ মুখের ভিতর জমা হওয়া পানি ও ময়লা টেনে নিয়ে যায়। সে যন্ত্রও হুলুস্থুল শব্দ করে। বিরতিহীন শব্দের মধ্যে এই ত্রিশংকু অবস্থায় ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দেবার রিস্ক নেয়া ঠিক হবে কিনা, বুঝতে না পেরে সে চুপ মেরে থাকে।
ওয়েটিং রুমে তার অপেক্ষায় বসে আছি। সে অপারেশন রুম থেকে বেরিয়ে এসে পাশে বসে।
‘কি বললো ডাক্তার?’
‘বাংলাদেশী চকোলেট খেতে নিষেধ করেছে।’
‘বাংলাদেশী চকোলেট! তুমি খুব চকোলেট খাও নাকি ?’
‘না। ডাক্তার আসলে চকোলেট বলেনি, বলেছে ক্যান্ডি। এদেশে আপনারা তো চকোলেটকে ক্যান্ডি বলেন, তাই না? পান, চুন, সুপারি, জর্দাÑএগুলিকে একত্রে কি নামে ডাকা হয় ডাক্তার তা জানে না। তাই সে নাম দিয়েছে ক্যান্ডি। বলেছে, তোমরা সবাই যে বাংলাদেশী ক্যান্ডি চাবাও, মুখ লাল হয়ে যায়, এখন থেকে ঐ ক্যান্ডি আর খাবে না। এগুলি খেলে দাঁতের ক্ষতি হয়।’
‘ডাক্তার তো উপকারী কথাই বলেছে। এখন থেকে তাহলে পান খাওয়া ছেড়ে দাও।
‘আপনার মাথা খারাপ হয়েছে, জাহিদ ভাই? ডাক্তারের কথা শুনে পান খাওয়া ছেড়ে দেবো! তার রোগীকে কিছু বলা দরকার, বলেছে। আমার পান খাওয়া দরকার, আমি খাবো। জীবনে কখনও শুনেছেন, একা একজন ডাক্তার গুরুত্বপূর্ন কোনো ইস্যুতে সঠিক সিদ্ধান্ত দিয়েছে। সে জন্য ডাক্তারদের বোর্ড মিটিং দরকার। সেখান থেকে তারা সম্মিলিত সিদ্ধান্ত দেয়। অনেক সময় বোর্ড বসেও লাভ হয়না। একই ইস্যুতে একদল ডাক্তার উত্তরের পথ ধরলে, অন্যদল সরাসরি দক্ষিন মেরুর দিকে রওয়ানা দেয়। পানের মত একটা অতি গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে একজন ডাক্তারের মতামতকে গুরুত্ব দেবার দরকার আছে বলে মনে হয়না।’
‘তাছাড়া এই ডাক্তার পান খায় না বলে আমাকেও খেতে নিষেধ করেছে। যদি সে পান ভক্ত হতো, তাহলে আমাকেও উৎসাহিত করতো। সবখানে এই নিয়ম চলে। পছন্দ করলে বক্তব্য হবে উৎসাহব্যাঞ্জক, আর পছন্দ না করলে পুরোপুরি উল্টো।’
তার বক্তব্য দেবার ধরন ও একাগ্রতা দেখে বেশ মজা পাই। এতে সে আরো উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
‘আপনি আমার কথা বিশ্বাস করছেন না। খুব তাড়াতাড়ি পানের উপকারিতা ও অপকারিতা সম্পর্কে যতগুলি যুক্তি থাকতে পারে, লিখে দেখাব। তখন ঠিক বিশ্বাস করবেন যে কিছু বাড়িয়ে বলছি না।’
সে সত্যি সত্যি তথ্য যোগাড়ের কাজে লেগে যায়। সংগৃহীত তথ্য-উপাত্তের সত্যতা যাচাই করে। তারপর বায়োলজির প্রাকটিক্যাল খাতার অনুকরনে মাঝখানে দাগ টেনে ভাইরাস ও ব্যাকটেরিয়ার পার্থক্য বর্ননার মত লিখে এনে আমাকে পড়তে দেয়।
পান খাওয়া ডাক্তার পান পছন্দ না করা ডাক্তার
১। পানের রস শরীরের জন্য উপকারী। ইহা হজমে সহায়তা করে।
২। পানের সাথে চুন বা ক্যালসিয়াম কার্বনেট খাওয়া হয়। কিছু ডাক্তার ও বিজ্ঞানী মনে করেন যে, ইহা শরীরের জন্য অতি প্রয়োজনীয় একটি রাসায়নিক উপাদান।
৩। আমাদের প্রত্যন্ত অঞ্চলে জনগনের মনোরঞ্জনের ব্যবস্থা অত্যন্ত সীমিত। পান খাওয়ার মাধ্যমে তারা প্রতিদিন একাধিকবার মজা গ্রহন করে। পান সম্পর্কে অনুৎসাহ মুলক প্রচারনা এই বৃহৎ জনগোষ্টির জীবনে নেতিবাচক প্রভাব বয়ে আনবে।
৪। জন্মলগ্ন থেকে সাদা দাঁত দেখে আমাদের দৃষ্টিশক্তি একঘেয়েমির শিকার। পান খাওয়া দাঁতের কারনে চোখের দেখায় বৈচিত্র্য আসে। এতে চোখ সতেজ থাকে। উদাহরন স্বরুপ বলা যায়- চুল সাধারনত কালো হলেও ইদানিং মেহেদী ও অন্যান্য রং ব্যবহার করে চুলের রঙে বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা চলছে।
৫। পানের দাঁত নষ্ট করার কোন ক্ষমতাই নেই। দাঁত দিয়েছেন আল্লাহ্পাক, রক্ষাও করবেন তিনি। ১। পানের সাথে সুপারি ও জর্দার মিশ্রনের ফলে ইহা উপকারের তুলনায় বেশী ক্ষতিসাধন করে।
২। ক্যালসিয়াম কার্বনেট শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। পানের মাধ্যমে এই বিষ প্রতিনিয়ত শরীরে গ্রহন করছি বলেই আমাদের গড় আয়ু খুব কম।
৩। আমাদের দরিদ্র জনগনের আয়ের উল্লেখযোগ্য অংশ পান, সুপারি, চুন, জর্দ্দা বা খয়ের কেনার মত অপ্রয়োজনীয় খাতে খরচ হয়ে থাকে। পান বিদেশে রপ্তানী করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব। কিন্তু জনগন সব পান খেয়ে ফেলার কারনে দেশ প্রতিবছর বিপুল পরিমান রাজস্ব থেকে বঞ্চিত হয়।
৪। পানের রস দাঁতের এনামেলের শুভ্রতা নষ্ট করে ফেলে। লাল ও কালো রঙের দাঁত দেখতে বড় দৃষ্টিকটু লাগে।
৫। শরীরের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সমূহের যথাযথ রক্ষনাবেক্ষনের জন্য আমাদের ধর্মে সুষ্পষ্ট নির্দেশ আছে। নিজের দাঁত নিজে না মাজিলে কি আসমানী কেউ আসিয়া মাজিয়া দিয়া যাইবে ?
আমেরিকায় পা রাখার সাত মাস পরে সবুর ট্যাক্সি চালানো শুরু করে। রাতের শিফটে বারো ঘন্টা কাজ। যাতায়াত, গাড়ী বদল সবকিছু মিলিয়ে চৌদ্দ পনের ঘন্টার ধাক্কা। রোববার ডাবল শিফটে আঠার ঘন্টা গাড়ী চালায়। যখন কথা বলে, তার কন্ঠে অবসাদ টের পাওয়া যায়। তাকে কিছুটা রিলাক্স করে কাজ করতে বলি। জবাবে তার সেই একই কথা, তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে যেতে হবে।
‘কখন ফিরে যেতে চাও ?’
আমার কন্ঠের রুক্ষতা বোধহয় সে টের পায়। কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে কিছুক্ষন তাকিয়ে থাকে। তারপর বিষন্ন স্বরে বলে, ‘প্রয়োজন মিটলেই চলে যাবো।’
প্রবাস জীবনের দীর্ঘ সময়ে একথাও বহুবার শোনা হয়েছে, প্রয়োজনটা একটু মিটলেই আর বিদেশের মাটি কামড়ে পড়ে থাকব না। তারপর গ্রামের বাড়ী পাকা হলো, শহরে অ্যাপার্টমেন্ট কেনা হলো, ছেলে-মেয়েদের উচ্চ শিক্ষা শেষ হলো-এখন তাদের প্রয়োজন আরও বেড়েছে। এই যুবক কি সে খবর রাখে ? কেউ যদি বলে দিত প্রয়োজনের সীমারেখা কোথায়-তাহলে খুব ভালো হতো। সবুর কি জানে তার নিজের প্রয়োজন কতটুকু ? সে খুব বিষন্ন মুখে বসে আছে। তাকে সহজ করার জন্য তরল কন্ঠে বলি,
‘বলো শুনি, তোমার কি কি প্রয়োজন ?’
‘ক্লাস নাইন থেকে প্রাইভেট টিউশনি করা শুরু করেছি। এভাবে খুড়িয়ে খুড়িয়ে এতদুর এসেছি। আগে মানুষের ছেলে-মেয়ের লেখাপড়ার তত্ত্ব¡াবধান, তারপর নিজের পড়াশুনা। অনেকদিন… নিজের বই খুলে দেখারও সময় পাই না। বিরক্তি ধরে গেছে। কিছুদিন নিশ্চিন্তে লেখাপড়া করতে চাই। টিউশনি করতে না হলে মাষ্টার্সে খুব ভালো রেজাল্ট করবো। আর, আমার বন্ধকী পৈত্রিক ভিটা ছাড়িয়ে নিতে চাই।’
আমি প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি। কোথাও আঘাত দেয়া হবে কিনা বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করা থেকে বিরতি থাকি।
‘ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দেবার সময় ফরম ফিলাপের টাকা ছিল না। কোথাও থেকে যোগাড় করতে পারিনি। শেষে বাধ্য হয়ে পৈত্রিক ভিটা বন্ধক রেখে ফরম ফিলাপ করি। ঐ ভিটায় আমার বাপের কবর আছে। মায়ের কবর আছে। মাঝে মাঝে যখন মনে হয়, টাকার অভাবে বাধ্য হয়ে বাপ-মায়ের মৃতদেহ অন্যের কাছে বন্ধক রেখেছি, তখন গলা ছেড়ে কাঁদতে ইচ্ছে করে।’ বলেই আমাকে হতভম্ভ করে দিয়ে সে হাউমাউ করে কেঁদে উঠে।
আমি নির্বাক বসে থাকি। একসময় তার কান্নার বেগ কমে আসে। সে সোফা থেকে উঠে বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। চোখে মুখে পানি ছিটিয়ে ভেজা দাগ মুছে ফেলে। তারপর ফ্রিজ থেকে পোটলা বের করে পান সাজাতে লেগে যায়। খুব আলতোভাবে পানের উপর চুন ঘষতে থাকে, একজন শিল্পী রংতুলি দিয়ে যেভাবে ছবি আঁকে। আমি তাকিয়ে থেকে তার হাতের কাজ দেখি। বোধহয়, বাবা-মাকে বন্ধক রাখার শোক ভুলতেই আজ বেশী করে জর্দা দিয়ে পান মুখে দেয়। প্রথম কিছুক্ষন মনোযোগ দিয়ে চকাস্ চকাস্ শব্দে পান চিবায়। মুখে পিক জমা হলে আবার বাথরুমে গিয়ে ঢোকে। সাদা বেসিনে ইতিমধ্যেই লাল দাগ পড়েছে। একদিন ভালো করে ডলে পরিস্কার করতে হবে। তাকে বলা দরকার যেন বেসিনে এভাবে পিক না ফেলে। তবে আজ নয়Ñঅন্য একদিন।
‘বুঝলেন জাহিদ ভাই, কিছু টাকার খুব দরকার বলে এদেশে এসেছি। আমি সারা জীবন খুব কষ্ট করেছি তো, সেজন্য দেশের জন্য টান বেশী। খুব মায়া…। বিদেশে গিয়ে তারাই স্থায়ীভাবে থাকতে চায়, যারা দেশে সুখে থাকে। আমি তাদের দলে পড়ি না।’
এই ক’মাসে সে নিউইয়র্ক শহরের সমস্ত বাঙ্গালী দোকানের নাম জেনে গেছে। কোন্ দোকানে পানের দাম কম, কারা সলিড রাজশাহীর পান বিক্রি করে, কারা ঝাল পানকে রাজশাহীর বলে চালিয়ে দিতে চেষ্টা করেÑসমস্ত তথ্য তার নখদর্পনে। আগের চেয়ে বেশী পরিমানে পান কিনতে হয় বলে এসব খবর তাকে জানতে হয়।
ট্যাক্সি চালানোর শুরুর দিকে সে খুব টেনশনে ছিল। রাস্তাঘাট ঠিকমতো চিনতো না। শহরের আইন-কানুন ভালভাবে জানতো না। তাছাড়া যাত্রীদের রকম-সকমও বড় বিচিত্র। এইসব সমস্যা ক্রমান্বয়ে কমে গেলে সে কিছুটা স্বস্তিবোধ করে, এবং সেই সাথে উপলদ্ধি করে, ড্রাইভিংয়ের কারনে দিনের বেশীরভাগ সময়েই পান না খেয়ে থাকতে হয়। একটানা পনের ঘন্টা পান না খেলে জীবনে আনন্দ কোথায়! আর আনন্দ ছাড়া বেঁচে থাকার মানেটাই বা কি!
সে এই সমস্যা নিয়ে পরিচিত দোকানির সাথে কথা বলে। অভিজ্ঞ পান ব্যবসায়ী তাকে সহজ সমাধান বাতলে দেয়।
‘সারাদিন পান না খেয়ে গাড়ী চালান মানে? মাথা ঠিক না থাকলে কোন্দিন কি দূর্ঘটনা ঘটে। ট্যাক্সির কাজ হইল স্বাধীন ব্যবসা। মাথার উপর বস্ নাই, ভুলক্রটি ধরার কেউ নাই। পানের খিলি বস্তা ভইরা নিয়া যাবেন, আরামসে গাড়ীতে বসে পান খাবেন। আপনি কি জানেন, নিউইয়র্কের অসংখ্য ট্যাক্সি ড্রাইভার পান খায় আর গাড়ী চালায় ?’
সে দোকানির উপদেশ শিরোধার্য্য করে সেই মোতাবেক কাজ করে। কাঁধে ঝুলানোর জন্য একটি কাপড়ের ব্যাগ কিনে ফেলে। আগে ঝাড়া হাত-পায়ে কাজে যেত, এখন কাঁধে ব্যাগ ঝুলিয়ে নেয়। সেই ব্যাগের ভিতরে থাকে প্লাষ্টিকের ’জিপলগ’ ব্যাগ। জিপলগের ভিতর সারা দিনের চাহিদা মেটাবার মত যথেষ্ট পরিমান খিলিপান থাকে। দিনের তাপমাত্রা অনুযায়ী খিলিপানের সাথে এক দুই টুকরো বরফ দেয়া হয়। পানের সাথে বরফ রাখার কারন জিজ্ঞেস করলে উত্তর দেয়,
‘এতে পান ভেজা ও সতেজ থাকে। শুকিয়ে ন্যাত্ন্যাতে হয় না। যখনই মুখে দেই, একটা ফ্রেশ অনুভুতি পাওয়া যায়।’
‘ট্যাক্সি চালাবার সময় এভাবে পান খাও, যাত্রীরা কিছু বলে না?’
‘এদেশের লোকজন পারতপক্ষে অন্যের ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে মাথা ঘামায় না। তারপরও কেউ যদি কিছু জিজ্ঞেস করে, সেই ডেন্টিষ্টের কাছ থেকে শেখা উত্তর দেবো, ‘এক ধরনের বাংলাদেশী ক্যান্ডি খাই। লাল ক্যান্ডি !’
এত আয়োজন এবং এত প্রস্তুতি সত্ত্বেও, শুধুমাত্র ভিন্ন সমাজব্যবস্থার কারনেই একদিন ছোটখাটো একটা বিপত্তি ঘটে যায়।
সেদিন ছিল শনিবার। নিউইয়র্ক শহরে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পাঁচ দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বেশীরভাগ লোকজন শনি-রবিবার বাসায় অলস সময় পার করে। সকালের দিকে রাস্তাঘাটে মানুষজন তেমন একটা থাকে না। ঘন্টাখানেক ধরে খালি ট্যক্সি নিয়ে ঘুরে সবুরের খুব বোরিং লাগছিল। মুখের পানটাও অনেকক্ষন আগে শেষ হয়েছে। সে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একটা নতুন খিলি বের করে মুখে দেয়।
নিজের হাতে বানানো খিলিপান-চুন, সুপারি ও জর্দার পরিমান মাপমতো দেয়া আছে। সে খুব দ্রুত চিবোতে থাকে। মুখের ভিতর পান যত বেশী মিহি হয়, পানের লাল রং তত বেশী ফোটে। গাড়ীর আয়নায় বার বার নিজের টকটকে লাল জিব দেখতে বড় ভালো লাগে।
অনেকদুরে একজন যাত্রী হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে লাইটপোষ্টের গায়ে লটকে রাখা চৌকো বাক্স সংকেত দেয়া শুরু করেছে। যে কোনো সময় রাস্তার সবুজ আলো বদলে গিয়ে লাল আলো জ্বলে উঠতে পারে। সবুর গাড়ীর গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। যে করেই হোক এই যাত্রীকে গাড়ীতে তুলতে হবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। সবুরের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে লাল আলো জ্বলে উঠে। তার মাথায় তখন জেদ চেপে গেছে। সে লাল সংকেত অগ্রাহ্য করে গাড়ী চালিয়ে যেতে থাকে।
দুর্ভাগ্যক্রমে তার পিছনেই ছিল পুলিশের গাড়ী। তারা ওয়া ওয়া শব্দে সাইরেন বাজিয়ে সবুরের পিছু ধাওয়া করে। গাড়ীর মাইকে রাস্তার ধারে ট্যাক্সি পুলওভার করার নির্দেশ দেয়। সে গাড়ী থামালে দীর্ঘদেহী পুলিশ অফিসার তার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘গুড মর্নিং স্যার। হাউ আর ইউ ?’
প্রত্ত্যুত্তরে সবুরেরও হ্যালো জাতীয় কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু তার মুখ তখন পানের পিকে পরিপূর্ন। সবেমাত্র পান মুখে দিয়েছে, জর্দা মাখানো রসকস গিলে ফেলাও সম্ভব নয়। নির্ঘাত মাথা ধরে যাবে, হেঁচকি ওঠা শুরু হবে। এই বহুমুখী সংকট থেকে পরিত্রানের আশায় সে গাড়ীর দরজা খুলে পুলিশের পায়ের কাছে টকটকে লাল পিক ফেলে।
কোন গাড়ীকে পুলওভার করার পর পুলিশ অফিসাররা খুব সতর্ক থাকেন। অপরাধ করা গাড়ীর ড্রাইভারের গুলিতে প্রতিবছর অনেক পুলিশ মারা যায়। তাই তারা এখন নিজের জান বাঁচানোকে প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন। এই পুলিশ অফিসার প্রমিথিউসের মত দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, পিস্তলের বাটে হাত রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে সবুরের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। তার মুখ থেকে লাল তরল বের হতে দেখে পুলিশ অফিসার চমকে উঠেন, এবং একটু আগে করা অপরাধ ভুলে গিয়ে সহানুভুতি মাখা গলায় জানতে চান,
‘তোমার সমস্যা কি, তোমার মুখ থেকে রক্ত পড়ছে কেন?’
সবুর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে এক ধরনের বাংলাদেশী ক্যান্ডি খাচ্ছে! এই ক্যান্ডি থেকে লাল রস বের হয়। এটা রক্ত নয়।
পুলিশ অফিসার তার কথায় বিভ্রান্ত হন না। আমেরিকার নিজস্ব ও আমদানিকৃত যত ধরনের ক্যান্ডি পাওয়া যায় তার সবগুলি খেয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ক্যান্ডির কথা শোনেননি, যেটা খেলে রক্ত বের হয়। তিনি মুহুর্তে ইতি-কর্তব্য ঠিক করেন। হাতের ওয়াকিটকি অন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠান।
অ্যাম্বুলেন্সের ষ্ট্রেচারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে সবুরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন পুলিশ ভয়ানক অসুস্থ্য(?) এই ড্রাইভারের ট্যাক্সি নিজে চালিয়ে এনে থানার হেফাজতে রাখেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর হাফ ডাক্তাররা এবং হাসপাতালের ফুল ডাক্তাররা তাকে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে রক্তপাতের কোন কারন তারা খুঁজে পান না। তবু, আরো নিশ্চিত হবার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়।
সমুহ বিপদ বুঝতে পেরে সবুর অনেক আগেই মুখের পান গিলে ফেলেছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরা যখন হাসপাতালে ধরেই এনেছে, ফ্রি চেকআপ হয়ে গেলে সমস্যা কি! যন্ত্রপাতির পরীক্ষাতেও কোনো ধরনের সমস্যা ধরা না পড়ায় ডাক্তাররা তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক সময় ফাঁক বুঝে সে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ভালো করে কুলি করে মুখ থেকে পানের অবশিষ্ট দুর করে, এবং এর পরেই ডাক্তারদের দৃষ্টিতে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাগজে দস্তখত নিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়।
পরবর্তী কয়েকদিন সে আমার সামনে আসতে ইতস্তত: করে, কথা বলতে লজ্জা পায়। তবুও এক ছুটির সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা হয়ে যায়।
‘কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেল, তাই না জাহিদ ভাই?’
আমি তার কথা না শোনার ভান করে পেপার পড়তে থাকি। আমার নীরবতা দেখে সে পাশে এসে বসে।
‘আপনি কি আমার প্রতি খুব রেগে আছেন?’
‘না। রেগে থাকব কেন ? খারাপ কিছু তো ঘটে নাই, বরং শাপে বর হয়েছে। পুলিশ অফিসার রেড লাইট টিকেট ইস্যু করলে আড়াইশো ডলার জরিমানা গুনতে হত! লাইসেন্সে তিন পয়েন্ট যোগ হত। আগামী আঠার মাস ঐ তিন পয়েন্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হত। ছয় পয়েন্ট যোগ হলে এক মাসের জন্য ট্যাক্সি লাইসেন্স সাসপেন্ড। আরো আছে…। ডিপার্টমেন্ট অব মোটর ভেহিকেলের হিসেব মতে তুমি এখনো শিক্ষানবীশ ড্রাইভার। ড্রাইভিং শুরুর প্রথম একবছর কোন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা যাবে না। বড় ধরনের খেসারত দিতে হয়। সুতরাং খারাপ বলা চলে না। তোমার পানের পিক অনেকগুলি সমস্যার সমাধান করেছে।’
সে চুপচাপ কথা শোনে। ঠাট্টা করছি, না প্রশংসা করছি-বোঝার চেষ্টা করে। আমি এবারে বাংলা সংবাদপত্রের একটি বিশেষ খবরের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষন করি, ‘এটি পড়ে দেখো’।
লন্ডনের মেয়র তার শহরের দক্ষিন এশীয় অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। তাদের মুখ-নিঃসৃত পানের পিকের কারনে শহরের পরিবেশে বিপর্যয় ঘটছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বাগান, বিনোদন কেন্দ্র-সবকিছু তাদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য হারিয়ে খয়েরি বর্ন ধারন করছে। এই পিক পরিস্কার করতে জনগনের ট্যাক্সের পয়সা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এজন্য তিনি পানভক্ত নাগরিকদেরকে যত্রতত্র পানের পিক না ফেলার জন্য সকাতর অনুরোধ জানিয়েছেন।
খবর পড়ে সে হাসতে শুরু করে। হাসতেই থাকে। তার মনের মেঘ কেটে গেছে ভেবে সাহস করে বলি,
‘এবারে পান খাওয়া ছেড়ে দাও। তোমার বয়স কম, সামনে অনেক পথ বাকি। এই অল্প বয়সে কিসের এত পান খাওয়া!’
‘পান খাওয়া ছেড়ে দেবো ?’ সে ব্যথিত চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। ‘সেটাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, জাহিদ ভাই !’
‘কেন সম্ভব নয় ? কি সমস্যা।’
‘সমস্যা অনেক, সবচেয়ে বড় সমস্যা-আমি পান খাওয়া ছাড়তে চাইনা।’
এরপর তাকে আর কি বলা যায় ভেবে পাই না। সে-ও চুপ করে বসে থাকে। তারপর এক সময় ধীর অনুত্তেজিত স্বরে বলে,
‘জাহিদ ভাই। পান খাওয়া নিয়ে সবাই আমার উপর বিরক্ত হয়। যাদের কাছাকাছি যাই, তারা সবাই…। প্লিজ, আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছে আমি খুব ঋনী। এই দুনিয়ায় আমার পরিচিত মানুষের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম, এই প্রবাসে আরও কম। আপনার সহযোগিতা ছাড়া এই শহরে আমি টিকতে পারতাম না।’ সে কিছুক্ষন চুপ মেরে থাকে। মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়। তারপর আবার শুরু করে,
‘আব্বা মারা যাওয়ার পর আমরা যখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম, তখন আমি ছাড়া মা’র আর কোনো অবলম্বন ছিল না। অনেক বয়স পর্যন্ত আমি মায়ের সাথে ঘুমাতাম। ঝড়-বাদলার রাতে ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস এসে ঘরে ঢুকতো। বৃষ্টির ছাঁট লেগে কাঁথা বালিশ ভিজে যেত। ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে থাকলে মা আমাকে আঁচলে জড়িয়ে নিতেন। তবুও পুরোপুরি ঠান্ডা দুর হতো না। মা তখন বলতেন, একটা পান খাবি বাবা! পান খেলে শরীর গরম হয়।
তখনও পান খাওয়ার অভ্যাস হয়নি। পানের ঝাল ভাবটা সহ্য করতে পারতাম না। তার মুখেরটা খেতে চাইতাম। মা মুখ থেকে পান বের করে আমার মুখে দিতেন। মা পাখিকে কখনো তার ছানাকে খাওয়াবার দৃশ্যটা দেখেছেন, জাহিদ ভাই? এখন, যতক্ষন মুখে পান থাকে মনে হয় মায়ের কাছাকাছি আছি। কারো মুখ থেকে পানের সুগন্ধ ভেসে এলে মা’র কথা মনে পড়ে।’
সে বারবার চোখ মোছে। আমি স্থানুর মত বসে থাকি। আমার চোখে কেবলই দুর্যোগ কবলিত এক রাতের ছবি ভাসতে থাকে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ কানে এসে বাজে। গাছের ডালপালা ভাঙ্গে। বিদ্যুতের চমকানি ভাঙ্গা বেড়ার ভিতরে ঢুকে সারা ঘর আলোকিত করে তোলে। সবুরের অসহায় বিধবা মায়ের চোখে ঘুম নেই। ঘরের চাল উড়ে গেলে শিশুপুত্রকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন! শিশুটির চোখেও দানা বেঁধেছে কি এক অজানা ভয়। প্রকৃতির সমস্ত তান্ডব থেকে রক্ষার জন্য মা তাকে আঁচলে জড়িয়ে ধরে আছেন।
আমার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে নিউইয়র্ক নগরীতে ইতিমধ্যে রাত নেমেছে। আলোয় আলোয় ঝলমল করছে কাঁচের তৈরী ঘর। রাত আরও গভীর হলে এর অধিবাসীরা ছুটবে বার আর নাইটক্লাব গুলির দিকে। রঙিন পানীয় আর সংগীতের অপূর্ব মুর্ছনায় তারা তলিয়ে যাবে অন্য ধরনের এক সুখের জগতে। বাইরের পৃথিবীর সীমাহীন দুঃখ বেদনার হাত কখনোই তাদের নাগাল পায়না।
কি অদ্ভুদ বৈপরীত্য! পৃথিবীতে বৈষম্য এত বেশী কেন ?
নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাবার দিন আমি সবুরকে কেনেডি এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেই। গাড়ী থেকে ব্যাগ নামানো শেষ হতে জিজ্ঞেস করি,
‘সারা রাস্তায় খাবার মত যথেষ্ট খিলি পান সাথে নিয়েছো তো ?’
সে লালচে দাঁত কেলিয়ে হাসে, ‘এই একটা ব্যাপারে কখনো ভুল হয় না। আমার জন্য দোয়া করবেন, জাহিদ ভাই।’
জীবন তাকে পিছনদিকে টানে। সে ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু থামে না। অনিশ্চিত পথের যাত্রী এই যুবকের পথচলার কষ্ট মনে করে আমার চোখে পানি আসে। আমি গভীর মমতায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি।