আবু রায়হান
সেদিন ছিল শনিবার। নিউইয়র্ক শহরে সাপ্তাহিক ছুটির দিন। পাঁচ দিন হাড়ভাঙ্গা খাটুনির পর বেশীরভাগ লোকজন শনি-রবিবার বাসায় অলস সময় পার করে। সকালের দিকে রাস্তাঘাটে মানুষজন তেমন একটা থাকে না। ঘন্টাখানেক ধরে খালি ট্যক্সি নিয়ে ঘুরে সবুরের খুব বোরিং লাগছিল। মুখের পানটাও অনেকক্ষন আগে শেষ হয়েছে। সে একঘেয়েমি কাটানোর জন্য একটা নতুন খিলি বের করে মুখে দেয়।
নিজের হাতে বানানো খিলিপানÑচুন, সুপারি ও জর্দার পরিমান মাপমতো দেয়া আছে। সে খুব দ্রুত চিবোতে থাকে। মুখের ভিতর পান যত বেশী মিহি হয়, পানের লাল রং তত বেশী ফোটে। গাড়ীর আয়নায় বার বার নিজের টকটকে লাল জিব দেখতে বড় ভালো লাগে।
অনেকদুরে একজন যাত্রী হাত তুলে দাঁড়িয়ে আছে। এদিকে লাইটপোষ্টের গায়ে লটকে রাখা চৌকো বাক্স সংকেত দেয়া শুরু করেছে। যে কোনো সময় রাস্তার সবুজ আলো বদলে গিয়ে লাল আলো জ্বলে উঠতে পারে। সবুর গাড়ীর গতি আরো বাড়িয়ে দেয়। যে করেই হোক এই যাত্রীকে গাড়ীতে তুলতে হবে। কিন্তু শেষ রক্ষা হয় না। সবুরের বাড়া ভাতে ছাই দিয়ে লাল আলো জ্বলে উঠে। তার মাথায় তখন জেদ চেপে গেছে। সে লাল সংকেত অগ্রাহ্য করে গাড়ী চালিয়ে যেতে থাকে।
দুর্ভাগ্যক্রমে তার পিছনেই ছিল পুলিশের গাড়ী। তারা ওয়া ওয়া শব্দে সাইরেন বাজিয়ে সবুরের পিছু ধাওয়া করে। গাড়ীর মাইকে রাস্তার ধারে ট্যাক্সি পুলওভার করার নির্দেশ দেয়। সে গাড়ী থামালে দীর্ঘদেহী পুলিশ অফিসার তার জানালার পাশে এসে দাঁড়ায়, ‘গুড মর্নিং স্যার। হাউ আর ইউ?’
প্রত্ত্যুত্তরে সবুরেরও হ্যালো জাতীয় কিছু একটা বলা দরকার। কিন্তু তার মুখ তখন পানের পিকে পরিপূর্ন। সবেমাত্র পান মুখে দিয়েছে, জর্দা মাখানো রসকস গিলে ফেলাও সম্ভব নয়। নির্ঘাত মাথা ধরে যাবে, হেঁচকি ওঠা শুরু হবে। এই বহুমুখী সংকট থেকে পরিত্রানের আশায় সে গাড়ীর দরজা খুলে পুলিশের পায়ের কাছে টকটকে লাল পিক ফেলে।
কোন গাড়ীকে পুলওভার করার পর পুলিশ অফিসাররা খুব সতর্ক থাকেন। অপরাধ করা গাড়ীর ড্রাইভারের গুলিতে প্রতিবছর অনেক পুলিশ মারা যায়। তাই তারা এখন নিজের জান বাঁচানোকে প্রধান কর্তব্য হিসেবে বিবেচনা করেন। এই পুলিশ অফিসার প্রমিথিউসের মত দু’পা ফাঁক করে দাঁড়িয়ে, পিস্তলের বাটে হাত রেখে খুব মনোযোগ দিয়ে সবুরের গতিবিধি লক্ষ্য করছিল। তার মুখ থেকে লাল তরল বের হতে দেখে পুলিশ অফিসার চমকে উঠেন, এবং একটু আগে করা অপরাধ ভুলে গিয়ে সহানুভুতি মাখা গলায় জানতে চান,
‘তোমার সমস্যা কি, তোমার মুখ থেকে রক্ত পড়ছে কেন ?’
সবুর তাকে বোঝানোর চেষ্টা করে, সে এক ধরনের বাংলাদেশী ক্যান্ডি খাচ্ছে! এই ক্যান্ডি থেকে লাল রস বের হয়। এটা রক্ত নয়।
পুলিশ অফিসার তার কথায় বিভ্রান্ত হন না। আমেরিকার নিজস্ব ও আমদানিকৃত যত ধরনের ক্যান্ডি পাওয়া যায় তার সবগুলি খেয়ে তিনি বেড়ে উঠেছেন। আজ পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ক্যান্ডির কথা শোনেননি, যেটা খেলে রক্ত বের হয়। তিনি মুহুর্তে ইতি-কর্তব্য ঠিক করেন। হাতের ওয়াকিটকি অন করে অ্যাম্বুলেন্স ডেকে পাঠান।
অ্যাম্বুলেন্সের ষ্ট্রেচারে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে সবুরকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। একজন পুলিশ ভয়ানক অসুস্থ্য(?) এই ড্রাইভারের ট্যাক্সি নিজে চালিয়ে এনে থানার হেফাজতে রাখেন। অ্যাম্বুলেন্সের ভিতর হাফ ডাক্তাররা এবং হাসপাতালের ফুল ডাক্তাররা তাকে তন্নতন্ন করে পরীক্ষা করেন। কিন্তু আপাতদৃষ্টিতে রক্তপাতের কোন কারন তারা খুঁজে পান না। তবু, আরো নিশ্চিত হবার জন্য অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি লাগিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়।
সমুহ বিপদ বুঝতে পেরে সবুর অনেক আগেই মুখের পান গিলে ফেলেছে। তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে এরা যখন হাসপাতালে ধরেই এনেছে, ফ্রি চেকআপ হয়ে গেলে সমস্যা কি! যন্ত্রপাতির পরীক্ষাতেও কোনো ধরনের সমস্যা ধরা না পড়ায় ডাক্তাররা তার প্রতি আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। এক সময় ফাঁক বুঝে সে বাথরুমে ঢুকে পড়ে। ভালো করে কুলি করে মুখ থেকে পানের অবশিষ্ট দুর করে, এবং এর পরেই ডাক্তারদের দৃষ্টিতে পুরোপুরি সুস্থ্য হয়ে যায়। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কাগজে দস্তখত নিয়ে আপদ বিদায় করে দেয়।
পরবর্তী কয়েকদিন সে আমার সামনে আসতে ইতস্তত: করে, কথা বলতে লজ্জা পায়। তবুও এক ছুটির সন্ধ্যায় তার সাথে দেখা হয়ে যায়।
‘কি একটা বিচ্ছিরি ব্যাপার ঘটে গেল, তাই না জাহিদ ভাই ?’
আমি তার কথা না শোনার ভান করে পেপার পড়তে থাকি। আমার নীরবতা দেখে সে পাশে এসে বসে।
‘আপনি কি আমার প্রতি খুব রেগে আছেন ?’
না। রেগে থাকব কেন ? খারাপ কিছু তো ঘটে নাই, বরং শাপে বর হয়েছে। পুলিশ অফিসার রেড লাইট টিকেট ইস্যু করলে আড়াইশো ডলার জরিমানা গুনতে হত! লাইসেন্সে তিন পয়েন্ট যোগ হত। আগামী আঠার মাস ঐ তিন পয়েন্টের বোঝা বয়ে বেড়াতে হত। ছয় পয়েন্ট যোগ হলে এক মাসের জন্য ট্যাক্সি লাইসেন্স সাসপেন্ড। আরো আছে…। ডিপার্টমেন্ট অব মোটর ভেহিকেলের হিসেব মতে তুমি এখনো শিক্ষানবীশ ড্রাইভার। ড্রাইভিং শুরুর প্রথম একবছর কোন ট্রাফিক আইন লঙ্ঘন করা যাবে না। বড় ধরনের খেসারত দিতে হয়। সুতরাং খারাপ বলা চলে না। তোমার পানের পিক অনেকগুলি সমস্যার সমাধান করেছে।’
সে চুপচাপ কথা শোনে। ঠাট্টা করছি, না প্রশংসা করছিÑবোঝার চেষ্টা করে। আমি এবারে বাংলা সংবাদপত্রের একটি বিশেষ খবরের প্রতি তার দৃষ্টি আকর্ষন করি, ‘এটি পড়ে দেখো’।
লন্ডনের মেয়র তার শহরের দক্ষিন এশীয় অধিবাসীদের দৃষ্টি আকর্ষন করেছেন। তাদের মুখ-নিঃসৃত পানের পিকের কারনে শহরের পরিবেশে বিপর্যয় ঘটছে। রাস্তাঘাট, ফুটপাত, বাগান, বিনোদন কেন্দ্রÑসবকিছু তাদের স্বাভাবিক সৌন্দর্য্য হারিয়ে খয়েরি বর্ন ধারন করছে। এই পিক পরিস্কার করতে জনগনের ট্যাক্সের পয়সা পানিতে ভেসে যাচ্ছে। এজন্য তিনি পানভক্ত নাগরিকদেরকে যত্রতত্র পানের পিক না ফেলার জন্য সকাতর অনুরোধ জানিয়েছেন।
খবর পড়ে সে হাসতে শুরু করে। হাসতেই থাকে। তার মনের মেঘ কেটে গেছে ভেবে সাহস করে বলি,
‘এবারে পান খাওয়া ছেড়ে দাও। তোমার বয়স কম, সামনে অনেক পথ বাকি। এই অল্প বয়সে কিসের এত পান খাওয়া!’
‘পান খাওয়া ছেড়ে দেবো ?’ সে ব্যথিত চোখে আমার দিকে চেয়ে থাকে। ‘সেটাতো আমার পক্ষে সম্ভব নয়, জাহিদ ভাই !’
‘কেন সম্ভব নয় ? কি সমস্যা।’
‘সমস্যা অনেক, সবচেয়ে বড় সমস্যাÑআমি পান খাওয়া ছাড়তে চাইনা।’
এরপর তাকে আর কি বলা যায় ভেবে পাই না। সে-ও চুপ করে বসে থাকে। তারপর এক সময় ধীর অনুত্তেজিত স্বরে বলে,
‘জাহিদ ভাই। পান খাওয়া নিয়ে সবাই আমার উপর বিরক্ত হয়। যাদের কাছাকাছি যাই, তারা সবাই…। প্লিজ, আপনি বিরক্ত হবেন না। আপনার কাছে আমি খুব ঋনী। এই দুনিয়ায় আমার পরিচিত মানুষের সংখ্যা এমনিতেই খুব কম, এই প্রবাসে আরও কম। আপনার সহযোগিতা ছাড়া এই শহরে আমি টিকতে পারতাম না।’ সে কিছুক্ষন চুপ মেরে থাকে। মনে মনে কথা গুছিয়ে নেয়। তারপর আবার শুরু করে,
‘আব্বা মারা যাওয়ার পর আমরা যখন সর্বস্বান্ত হয়ে গেলাম, তখন আমি ছাড়া মা’র আর কোনো অবলম্বন ছিল না। অনেক বয়স পর্যন্ত আমি মায়ের সাথে ঘুমাতাম। ঝড়-বাদলার রাতে ভাঙ্গা বেড়ার ফাঁক দিয়ে বাতাস এসে ঘরে ঢুকতো। বৃষ্টির ছাঁট লেগে কাঁথা বালিশ ভিজে যেত। ঠান্ডায় হি হি করে কাঁপতে থাকলে মা আমাকে আঁচলে জড়িয়ে নিতেন। তবুও পুরোপুরি ঠান্ডা দুর হতো না। মা তখন বলতেন, একটা পান খাবি বাবা! পান খেলে শরীর গরম হয়।
তখনও পান খাওয়ার অভ্যাস হয়নি। পানের ঝাল ভাবটা সহ্য করতে পারতাম না। তার মুখেরটা খেতে চাইতাম। মা মুখ থেকে পান বের করে আমার মুখে দিতেন। মা পাখিকে কখনো তার ছানাকে খাওয়াবার দৃশ্যটা দেখেছেন, জাহিদ ভাই? এখন, যতক্ষন মুখে পান থাকে মনে হয় মায়ের কাছাকাছি আছি। কারো মুখ থেকে পানের সুগন্ধ ভেসে এলে মা’র কথা মনে পড়ে।’
সে বারবার চোখ মোছে। আমি স্থানুর মত বসে থাকি। আমার চোখে কেবলই দুর্যোগ কবলিত এক রাতের ছবি ভাসতে থাকে। বাতাসের শোঁ শোঁ শব্দ কানে এসে বাজে। গাছের ডালপালা ভাঙ্গে। বিদ্যুতের চমকানি ভাঙ্গা বেড়ার ভিতরে ঢুকে সারা ঘর আলোকিত করে তোলে। সবুরের অসহায় বিধবা মায়ের চোখে ঘুম নেই। ঘরের চাল উড়ে গেলে শিশুপুত্রকে নিয়ে কোথায় দাঁড়াবেন! শিশুটির চোখেও দানা বেঁধেছে কি এক অজানা ভয়। প্রকৃতির সমস্ত তান্ডব থেকে রক্ষার জন্য মা তাকে আঁচলে জড়িয়ে ধরে আছেন।
আমার অ্যাপার্টমেন্টের বাইরে নিউইয়র্ক নগরীতে ইতিমধ্যে রাত নেমেছে। আলোয় আলোয় ঝলমল করছে কাঁচের তৈরী ঘর। রাত আরও গভীর হলে এর অধিবাসীরা ছুটবে বার আর নাইটক্লাব গুলির দিকে। রঙিন পানীয় আর সংগীতের অপূর্ব মুর্ছনায় তারা তলিয়ে যাবে অন্য ধরনের এক সুখের জগতে। বাইরের পৃথিবীর সীমাহীন দুঃখ বেদনার হাত কখনোই তাদের নাগাল পায়না।
কি অদ্ভুদ বৈপরীত্য! পৃথিবীতে বৈষম্য এত বেশী কেন ?
নিউইয়র্ক ছেড়ে চলে যাবার দিন আমি সবুরকে কেনেডি এয়ারপোর্টে নামিয়ে দেই। গাড়ী থেকে ব্যাগ নামানো শেষ হতে জিজ্ঞেস করি,
‘সারা রাস্তায় খাবার মত যথেষ্ট খিলি পান সাথে নিয়েছো তো ?’
সে লালচে দাঁত কেলিয়ে হাসে, ‘এই একটা ব্যাপারে কখনো ভুল হয় না। আমার জন্য দোয়া করবেন, জাহিদ ভাই।’
জীবন তাকে পিছনদিকে টানে। সে ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু থামে না। অনিশ্চিত পথের যাত্রী এই যুবকের পথচলার কষ্ট মনে করে আমার চোখে পানি আসে। আমি গভীর মমতায় তাকে বুকে জড়িয়ে ধরি।
নিউইয়র্ক। [আবু রায়হান বইয়ের জগতের মানুষ এবং অহর্নিশ বই পড়তে ভালোবাসেন। প্রবাস জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝেও সাহিত্য চর্চায় নিমগ্ন থাকেন রায়হান।]