পথ ও প্রবাসের গল্প: প্যারেড নগরী (২)

আবু রায়হান

‘না সপু ভাই, ওরা ভুলে ওটা রেখে গেছে।’ ‘যাক বাচা গেল।’ এতক্ষণে তার হতভম্ব ভাব কেটে যায়। ‘দেনমোহর ভাই, পুলিশে কল দেন… ওদেরকে একটা অ্যাম্বুলেন্সও পাঠাতে বলেন। আমি দেখি শালারা কি কি নিয়ে গেছে…।’
তিন বছর পর মোহর খানের বাসায় আবারও চুরির ঘটনা ঘটে। তবে এবারে অন্য পরিস্থিতিতে, অন্য কায়দায়।
আমেরিকার আসার পর মোহরের এখনো দেশে যাওয়া হয়নি। এ বছর টাকা পয়সার অনটনÑসামনের বছর যাব। পরের বছর বোনের বিয়ে ঠিক হয়ে যায়। জমানো টাকার সবটুকু দেশে পাঠিয়ে দিতে হয়। এভাবে চার বছর পার হওয়ার পর সে ঠিক করে, আমেরিকান সিটিজেন হয়ে তারপর দেশে যাবে। সে পর্ব শেষ হয়েছে। হাতে আমেরিকান পাসপোর্ট চলে এসেছে। এবারে সকল দ্বিধাদ্বন্দ্ব ঝেড়ে ফেলে সে দেশে যাবার তোড়জোড় শুরু করে। এ কান সে কান করে সেই খবর বন্ধু মহলে ছড়িয়ে পড়তে দেরী হয়না। পরবর্তী কয়েক দিন সময় অসময়ে তাদের বাসার ফোন বেজে উঠে।
‘দোস্ত, শুনলাম তুমি দেশে যাবা, যাওয়ার সময় আমার হাজার দুয়েক ডলার সাথে নিয়ে যেও।’
‘ঠিক আছে ।’
‘ওয়াআলাইকুম সালাম। বাবা, শুনলাম তুমি দেশে যাচ্ছ। একমাত্র মেয়েটাকে দেশে রেখে এসেছি। আমেরিকান শ্যাম্পু, সাবানের প্রতি ওর খুব ঝোক। একটা শ্যাম্পু আর দুটো সাবান তোমার কাছে দেবো বাবা, না বলতে পারবে না।’
‘ঠিক আছে চাচি আম্মা। আপনি এই সপ্তাহের মধ্যে জিনিস পৌঁছে দিয়ে যাবেন।’
‘সেটা কিভাবে হবে বাবা! আমি তো বুড়া মানুষ। তাছাড়া, তোমার বাসার ঠিকানাও জানি না। তুমিই কষ্ট করে এসে পোট্লাটা নিয়ে যেও। না বলোনা বাবা!’
স্বল্প পরিচিত একজন ফোন দেন, ‘ভাই, যাবার সময় হাতে করে একটা ল্যাপটপ নিয়ে যাবেন। ভাইয়ের জন্য দেবো। না না, ওজন নিয়ে সমস্যা হবে না। ওটাতো লাগেজে যাচ্ছে না। ওটা আপনার হাতে থাকবে। আরে ভাই, কি যে বলেন! এয়ারপোর্টে কাস্টম্সে ধরলে বলবেন ওটা আপনার ব্যবহারের জিনিস। দেখবেন কিচ্ছু বলবে না। একেবারে পানির মত সহজ।’
অপরিচিত মানুষের কাছ থেকেও ফোন আসে। ‘আপনার এক বন্ধুর কাছ থেকে ফোন নাম্বার পেয়েছি। আমার মা খুব অসুস্থ। তার জন্য কিছু ওষুধপত্র কিনে রেখেছি। দেশে এই ওষুধগুলো পাওয়া যায় না। আপনি যদি দয়া করে …।’
মানবিকতার খাতিরে সে অপরিচিত জনের অনুরোধেও রাজি হয়ে যায়। তারা কালবিলম্ব না করে মালামাল পৌঁছে দিয়ে যান। জামাকাপড়, ঔষধপাতি, প্রসাধন সামগ্রি ও চকলেটের বাক্সে মোহরের ঘর দ্রুত ভরে ওঠতে থাকে। দেশে পাঠানোর খুশিতে সবাই উদার হস্তে কেনাকাটা করেছেন। যার একটা জামা দেবার কথা ছিল, তিনি জামার সাথে বড় এক বাক্স চকলেট নিয়ে এসেছেন। যিনি একটা শ্যাম্পুর কথা বলেছিলেন, তিনি বালতি সাইজের দুইটা শ্যাম্পু আর এক ডজন সাবান নিয়ে এসেছেন। সপু মিয়া পোটলার সাইজ দেখে ওজন অনুমান করে, ‘সতের পাউন্ড!’
মায়ের ঔষধ দেবার জন্য যিনি এসেছেন, ঔষধপত্র দেয়া শেষ করে লজ্জিত ভঙ্গিতে ঘাড়ের ঝোলা থেকে তিনপোয়া ওজনের ভিটামিন ট্যাবলেটের শিশি বের করেন, ‘দয়া করে যদি … আমার মা … ।’
মোহর দয়া করে সেটাও রেখে দেয়। তার এই দয়া প্রবণতা দেখে রাগে সপু মিয়ার পিত্তি জ¦লে যায়।
ইমিগ্রেশন ডিপার্টমেন্টের অনুমতি নিয়ে দেশে গিয়ে বিয়ে করে আসার পর সপু মিয়া আর দেশে যেতে পারেনি। কর্তৃপক্ষের অনুমতি মেলেনি। উকিল বলে দিয়েছে তার বৈধ হবার সম্ভাবনা আরো জটিল হয়েছে। সেই জট তাড়াতাড়ি খুলবে বলে মনে হয় না। তাই মোহরের দেশে যাবার সিদ্ধান্তে শুরুতে সে খুশি হয়েছিল। বৌ এর সাথে সহসা দেখা হবেÑএমন সম্ভবনা নেই। যদি কিছু উপহারসামগ্রি পাঠিয়ে তার দুঃখ কমানো যায় ! কিন্তু দিনে দিনে সেই আশাও ক্ষীণ হয়ে আসছে। মোহর খান যেভাবে রাজ্যের মালামাল এনে জড়ো করছে! শেষ পর্যন্ত কার মাল দেশে গিয়ে পৌছুবে, বলা মুশকিল। এই অনিশ্চয়তার ঝুঁকি তার পোষাবে না। তাই সে একাই একটা আলাদা লাগেজ পাঠাবার সিদ্ধান্ত নেয়। এর জন্য যে খরচ হয় দিয়ে দেবে। এতে মোহর খানেরও সম্মতি আছে।
সেদিন সকাল বেলাতেই তারা দুজনে বেরিয়ে পড়ে। সপু মিয়ার পরিবারের জন্য কেনাকাটা বাকি আছে। মিডটাউন ম্যানহাটনের হোলসেল ডিস্ট্রিক্টে সবকিছু নাকি সস্তায় পাওয়া যায়। সপু মিয়ার ইচ্ছা মোহরকে সাথে নিয়ে সেখান থেকে কেনাকাটা করবে। মোহরের নিজেরও কেনাকাটা কিছু বাকী আছে। দেশেতো আত্মীয় স্বজনের অভাব নেই। প্রতি বর্গমাইলে বারশ’ মানুষ বাস করলে আত্মীয়ের সংখ্যা কম থাকে কিভাবে ? সস্তায় কিছু উপহারসামগ্রি কিনতে পারলে মন্দ হয় না। তাছাড়া আজ ভাগ্যগুণে দু’জনের ছুটি মিলে গেছে। তাই মোহর বেশি ইতস্তত: না করে সপু মিয়ার সাথে বেরিয়ে পরে।
গাড়ি নিয়ে ম্যানহাটন শহরে কেনাকাটা করার বিলাসিতা সবার পোষায় না। গাড়ির জন্য নিরাপদ পার্কিং খুঁজে বের করতে অনেকটা সময় ব্যয় হয়। তারপর এ দোকান সে দোকান…। কোন্ পণ্যের নকলে ইতোমধ্যে দেশের বাজার ছেয়ে গেছে, কোন্ জিনিসটা এখনো পাওয়া যায় না, কোন্ প্রসাধনী দেশেই কম দামে কিনতে পাওয়া যায়Ñএই সব হিসাব নিকাশে বেলা গড়িয়ে যায়। অবশেষে পড়ন্ত বিকেলে গাড়ির ট্রাংক বোঝাই মালামাল নিয়ে তারা ঘরে ফেরে।
সারা দিন সপু মিয়া বেশি পরিশ্রম করেছে। শহরে গাড়ি চালিয়ে বেড়ানো, নির্দিষ্ট দোকানটি খুঁজে বের করা, ভাও বুঝে দরদাম হাকানো, মোহর তাকে শুধু অনুসরণ করে বেরিয়েছে। তাই বাসার কাছাকাছি এসে সে বেশির ভাগ কাজ নিজে সারার চেষ্টা করে। গাড়ির ট্রাংক থেকে সব মাল বের করে ঘরের সামনে এনে জড়ো করে। তারপর চাবির খোঁজে পকেটে হাত ভরে দেয়। ততক্ষণে গাড়ি পার্কিং করে সপু মিয়াও তার পেছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
দীর্ঘদিনের অভ্যাস বশে মোহর তালায় চাবি ঢোকানোর চেষ্টা করে, কিন্তু ঢোকে না। সে মুখ দিয়ে বিরক্তিসূচক শব্দ করে আবার চেষ্টা করে। এবারও ব্যর্থ হয়। সিঁড়ির ল্যান্ডিংয়ের লাইট কয়েকদিন ধরে কাজ করছে না। জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে। তাই ভালভাবে বোঝার উপায় নেই সমস্যাটা কোথায়। সে পকেট থেকে সিগারেট লাইটার বের করে আলো জ্বালে। তালার ফুটো নিচের দিকে থাকার কথা, কিন্তু কি এক অলৌকিক কারণে ফুটো উপরের দিকে উঠে গেছে। এদিকে তার দেরী দেখে পেছনে দাঁড়ানো সপু মিয়া অসহিঞ্চু হয়ে উঠে।
‘তালা খুলতে এত সময় লাগে নাকি ?’
‘তালার ফুটা জায়গা মত নেই সপু ভাই। ওটা উপর দিকে উঠে গেছে।’
‘ফুটো তো সবসময় নিচের দিকে থাকে। সেটা উপরে গেল কি মনে করে ? তাজ্জব কান্ড, একেবারে আপসাইড ডাউন!’
সপু মিয়ার মুখে ‘আপসাইড ডাউন’ কথাটা শুনে এই সংকটের মাঝেও মোহরের হাসি পায়। গত কিছু দিন ধরে তার মাথায় এই গান ভর করেছে। পুরো গান নয়, একটি মাত্র লাইনÑগু ষরভব রং ঁঢ়ংরফব ফড়হি. এটা বর্তমানে আমেরিকার জনপ্রিয় র‌্যাপ সঙ্গীত। রাস্তাঘাটে তরুন তরুণীরা তাদের জীবনের বেহাল অবস্থা বোঝানোর জন্য শরীর দুলিয়ে সমবেত কণ্ঠে এই গান গায়। মোহর এমটিভি মিউজিক চ্যানেলে এই গানের ভিডিও দেখেছে। কমবয়সী কালো গায়ক বাম হাত দিয়ে খুুলু খুলু জিন্সের প্যান্ট ধরে রেখেছে। যে কোনো সময় টিভি ক্যামেরার সামনে সেই প্যান্ট কোমর থেকে খসে যেতে পারে। আর সে ডান হাতের কব্জি উল্টে পাল্টে বোঝানোর চেষ্টা করছে কিভাবে তার জীবনের উপরের অংশ নিচের দিকে চলে গেছে। সপু মিয়া এই গান এত পছন্দ করেছে যে, এই লাইনটির ভাবানুবাদও করে ফেলেছে,
‘আমার জীবন এখন উল্টো হয়ে ঝুলছে।’
তাদের দরজায় তালা কেন ডাউনসাইড আপ হয়ে গেল তা ভাবতে ভাবতে অনেক কসরতের পর সেটা খোলে। দরজা খোলার পর ভিতরের অবস্থা দেখে মোহরের চোখ ছানাবড়া হয়ে যায়। জিনিসপত্র সব বিচ্ছৃংখলভাবে ছড়িয়ে আছে। জামাকাপড় রাখার ক্লোজেট, থালাবাসন, মসলাপতি রাখার ক্যাবিনেটের দরজা হা করে খোলা। বন্ধুবান্ধবের দিয়ে যাওয়া জিনিসপত্র ড্রইংরুমের এক কোনায় স্তুপ করে রাখা ছিলÑসেই স্তুপের প্রায় পুরোটাই অদৃশ্য। শুধু কমদামের দুই একটি প্যাকেট নিতান্ত অবহেলায় পড়ে আছে। এর মধ্যে থালাবাসন ধোয়ার তরল সাবানের একটি প্যাকেটও আছে।
বেডরুমের কথা ভেবে মোহরের আতঙ্ক হয়। সেখানে লকারের মধ্যে ক্যাশ টাকা এবং দামী বৈদুতিক সামগ্রি আছে। সপু মিয়া জরুরী কণ্ঠে তাকে কি যেন বলছে। তার কথা মোহরের কাছে পৌঁছায় না। সে নিশিতে পাওয়া মানুষের মত পায়ে পায়ে বেডরুমে গিয়ে ঢোকে। লকারের সব ড্রয়ার খোলা। ভিতরে রাখা তিনহাজার ডলার, ভিডিও ক্যামেরা, দুটি ষ্টিল ক্যামেরা, সপু মিয়ার বউয়ের জন্য কেনা গয়না, কিছুই নেইÑসব ফক্ফকা। চোরেরা তাদের চিঠি পোষ্ট করার ডাকটিকেটগুলিও নিয়ে গেছে। ঐ তিন হাজার ডলার তার নিজের টাকা নয়। এক বন্ধু এসে দিয়ে গেছে। দু হাজার ডলার সেই বন্ধুর বাপকে দিতে হবে। এক হাজার ডলার মোহরকে ধার দিয়েছে, দেশে গিয়ে হাত খরচ করবে বলে। এদিকে ফ্লাইটের মাত্র নয় দিন বাকী। এই অল্প সময়ে সে কিভাবে কি করবে!
‘এখন কি হবে সপু ভাই?’
‘হওয়ার কিছুতো বাকী নেই। যা হবার হয়ে গেছে। আপনি পুলিশে কল দেন।’
হতবিহ্বল মোহর এই শহরে বিপদের কান্ডারী নাইন ওয়ান ওয়ান নাম্বারে কল দেয়।
‘পুলিশ ডিপার্টমেন্ট!’
‘হ্যালো! আমি মোহর খান। আমার ঠিকানা…। আমরা কেউ বাসায় ছিলাম না। কিছুক্ষণ আগে ঘরে ফিরে দেখি কে বা কারা তালা ভেঙ্গে সমস্ত মালামাল চুরি করে নিয়ে গেছে।’
‘তুমি বলছ যে, তোমার ঘরে ব্রেক ইন ঘটেছে, ঠিক ?’
ব্রেক ইন জিনিসটা আবার কি! মোহর দ্বিধায় পড়ে যায়। এই জাতীয় শব্দ সে আগে কখনো শোনেনি। কিন্তু এটা শব্দের মানে জিজ্ঞেস করার উপযুক্ত সময় নয়। তাছাড়া ওদের কথা বোঝার দরকারই বা কি। তার কথা ওরা বুঝলেই হয়। তাই সে আবার বলে,
‘হ্যাঁ হ্যাঁ, চোর এসে আমার ঘরের সব মালামাল নিয়ে গেছে। সব ফকফকা …।’
‘ও.কে। সংক্ষিপ্ত সময়ের মধ্যে তোমার ঠিকানায় পুলিশ পৌঁছে যাবে।’
ফোন রেখে দিয়ে মোহর সপু মিয়াকে জিজ্ঞেস করে, ‘ওরা ব্রেক ইন বলছে কেন, এর মানে কি’
শব্দটা সপু মিয়ার কাছেও নতুন। সে খানিকক্ষণ চিন্তা করে বলে,
‘এর মানে হতে পারে, ডাকাতরা আইন সম্মতভাবে ঘরে ঢোকে নাই। আগে তালা ভেঙ্গেছে, তারপর ইন করেছে। এই কারণেই বোধ হয় ওরা ব্রেক ইন বলে।’
সাত মিনিটের মাথায় দু’জন পুলিশ এসে উপস্থিত হয়। তারা অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে সারা অ্যাপার্টমেন্ট পর্যবেক্ষণ করে। এ সময় সপু মিয়া উঠে গিয়ে লকারের ড্রয়ার বন্ধ করতে নিলে তাদের একজন হুকুমজারি করেন, ‘খবরদার! তোমরা কেউ কিছু ছোবে না। তাতে অপরাধের ক্লু নষ্ট হতে পারে। আমাদের বিশেষজ্ঞ লোকজন একটু পরে আসবে। তারা সবকিছু পরীক্ষা করে দেখবে। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি নিয়ে আসছে বলে ওদের সময় বেশি লাগছে।’
আরো দশ মিনিট পর সেই বিশেষজ্ঞদল এসে হাজির হয়। তাদের প্রস্তুতি দেখে মোহরের হতাশ বুকে আশা বাসা বাঁধে। তাদের ঘাড়ে ঝোলানো যন্ত্র, কপালে লাগানো যন্ত্র। কোমড়ে ঝুলানো যন্ত্র, বেল্টে লাগানো যন্ত্র। একজন কোথাও ঝুলানোর জায়গা না পেয়ে একটা ব্যাগের ফিতা কামড়ে ধরে আনছে। এদেরকে দেখে এভারেস্ট জয়ী হিলারী-তেনজিং এর কথা মনে পড়ে। মোহর পাঠ্যপুস্তকে তাদের পর্বত জয়ের ছবি দেখেছিল। তবে তাদের শরীরে এদের তুলনায় আরো কম যন্ত্র ঝোলানো ছিল।
তারা যন্ত্রপাতির ভারমুক্ত হয়ে সারা ঘরময় আটা ছিটানো শুরু করে। ঘরের নতুন কার্পেট, বইয়ের তাক, টেবিলের ড্রয়ার, বিছানার ম্যাট্রেসÑআটায় আটায় একাকার হয়ে যায়। তাই দেখে মোহরের হৃদয় কাতরে উঠে।
‘এরা তো আটা দিয়ে ঘর ভরে ফেলল। এই আটা খেয়ে জার্মান তেলাপোকা আরো দ্বিগুণ গতিতে বংশবৃদ্ধি করবে।’
এই অ্যাপার্টমেন্টে অসংখ্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র তেলাপোকা আছে। শুধু এখানে নয়-যারা তরকারীতে মসলাপাতি ব্যবহার করেন তাদের সবার বাসাতেই কমবেশি আছে। এরা দেখতে ক্ষুদ্র হলেও এদের প্রজনন ক্ষমতা খুব বেশি। অতিমাত্রায় বংশ বিস্তার করে। সবখানে এদের অবাধ বিচরণ। কৌটা, বৈয়াম, সিলভারের হাড়িÑসবকিছু ধরে ঝুলে থাকার অবিশ্বাস্য ক্ষমতা আছে। গৃহিণী ডালে মশলা ঢালবেন, হাত বাড়িয়ে তাক থেকে কৌটা টেনে নেন। সেই কৌটার অন্য পিঠে তেলাপোকা ঝুলছে, গৃহিনী টের পান না। তিনি কৌটা উপুর করে মসলা ঢালেন-ঝাঁকুনি খেয়ে সেই পোকা ঝপ করে পড়ে ডালের সাগরে তলিয়ে যায়। আমন্ত্রিত অতিথি খাবার টেবিলে বসে রোষ্টের ঝোলে সেদ্ধ তেলাপোকা পেয়ে সবার অলক্ষে সরিয়ে ফেলেন। সবাইকে ব্রিবত করে কি লাভ ! তার নিজের ঘরেও এই সমস্যা আছে। কোনো ঔষধপাতি, চিকিৎসা ব্যবস্থা দিয়েই এদেরকে প্রতিরোধ করা যায় না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মান বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য গতির সাথে তুলনা করে অনেকে এই পতঙ্গকে জার্মান তেলাপোকা বলে ডাকে। উপাধিটা মোহর খানের খুব মনে ধরেছে।
সপু মিয়া তার ভুল শুধরে দেয়। ‘এটা গমের আটা নয়, এক ধরনের পাউডার। ফিঙ্গারপ্রিন্ট সনাক্তকরণে ব্যবহৃত হয়।’
সেই অপরাধী সনাক্তকরণের চেষ্টা দীর্ঘ সময় ধরে চলে। সেই সময়ে তাদের দুজনের চুপচাপ বসে থাকা ছাড়া অন্য কিছু করার থাকে না। সেই সুযোগে অনেক অসংলগ্ন চিন্তাভাবনা এসে মোহরের মাথায় ভর করে। অনেকে তাকে এই সময়টাতে সাবধানে থাকতে বলেছিল। ইতোপূর্বে অনেক বাংলাদেশীর বাসায় নাকি দেশ ভ্রমণের সময়ে চুরি ডাকাতি হয়েছে। চোরেরা কিভাবে নাকি টের পেয়ে যায়। তাদের সংঘবদ্ধ দল দক্ষিণ এশিয় অধিবাসীদেরকে নিবিড় পর্যবেক্ষণে রাখে। কার বাসায় হঠাৎ করে কেনাকাটার ধূম বৃদ্ধি পেয়েছে, কার বাসায় লোকজন শপিং ব্যাগ হাতে ঘন ঘন আসা যাওয়া করছে। তারপর একদিন গৃহবাসীদের অনুপুস্থিতির সুযোগে পুকুর চুরি সেরে ফেলে।
এত নির্ভুল হিসেব কি একদল চোরের পক্ষে করা সম্ভব ? নাকি তাদের পরিচিত কেউ বিভীষণ সেজে এই কাজ করেছে! এমনকি হতে পারে যারা তার দেশে যাবার খবর জানে, তাদের মধ্যে কেউ এর সাথে জড়িত। এমনতো নয় যে, তার স্ব-জাতিরা সবাই ধোঁয়া তুলসী পাতা। তাদের কেউ কেউ মোহরের চোখের সামনেই ছোটখাট অন্যায় করছে। চোখের আড়ালে বড় অন্যায় করতে অসুবিধে কোথায়! আবার এমনও হতে পারে, সেকেন্ড জেনারেশন বাংলাদেশীদের কেউ এর সাথে জড়িত। এদের অনেকের এখানে জন্ম হয়েছে। অনেকে খুব ছোটবেলায় বাবা মায়ের হাত ধরে এদেশে এসেছে। এদের সবাই যে সু-নাগরিক হয়ে উঠেছে তা নয়। এদেশে বেড়ে উঠার কারণে এদের সাহস ও বুদ্ধিমত্তা পিতৃপুরুষদের তুলনায় অনেক বেশি। মোহরের বুক থেকে দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে। সঠিক দিক নির্দেশনার অভাবে এদের অনেকে অন্ধকারের পঙ্কিল পথে পা বাড়িয়েছে।
আচ্ছা, এতসব জিনিস পত্র সরিয়ে নিতে চোরদের কতক্ষণ লেগেছে। নিশ্চয়ই তাদেরকে বেশ কয়েকবার আসা-যাওয়া করতে হয়েছে। এতবড় অ্যাপার্টমেন্ট বিল্ডিংয়ের কারও অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়েনি? তারা যদি কেনাকাটা শেষ করে আরও দু ঘন্টা আগে ফিরতে পারতো, তাহলে কি এই দুর্ঘটনা ঠেকানো যেত? মোহর তিক্ততার সাথে ভাবে, তারা দু’জন যখন হোলসেল ডিস্ট্রিকের দোকানদারদের সাথে পন্যের দাম পাঁচ পয়সা, দশ পয়সা কমাবার জন্য প্রাণান্তকর ঝুলাঝুলি করছিল, চোরেরা তখন তার ঘরের জিনিস বিনা দামে নিয়ে গেছে।
একসময়ে বিশেষজ্ঞদের ক্লান্তিকর তদন্ত কাজ শেষ হয়। তারা গৃহত্যাগের আগে গৃহবাসী দু’জনের আঙ্গুলের ছাপ নেয়। যাতে ভুলক্রমে তাদের নামে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি না হয়। অফিসারদের একজন মোহরের হাতে একটা নেমকার্ড ধরিয়ে দেয়,
‘আমি মুলার। এই কেসের তদন্তকারী অফিসার। তোমরা যে কোনো সময়ে যে কোনো প্রয়োজনে আমার সাথে যোগাযোগ করবে। তোমাদের একজন কাল থানায় গিয়ে এই ব্রেক ইনের ঘটনা রিপোর্ট করবে। কি কি জিনিস খোয়া গেছে তার তালিকা দিয়ে আসবে। কারো কোনো প্রশ্ন?’
সপু মিয়া অফিসারের দিকে এগিয়ে আসে। ‘হুজুর, আমাদের মাল উদ্ধারের সম্ভাবনা কতটুকু’
মি. মুলার হতাশায় মাথা নাড়েন, ‘বিশেষজ্ঞদের তদন্তের ফলাফল না দেখে মন্তব্য করা ঠিক হবে না। তবে আমেরিকায় ব্রেক ইনের ঘটনায় সাফল্যের হার খুব কম। অপকর্মের নায়করা হাতে গ্লোভস্ পরে অপকর্ম করে। ফলে বেশির ভাগ সময় অপরাধীকে সনাক্ত করা যায় না। অপরাধী ধরা পড়লেও মাল উদ্ধার হয় না। চুরি ডাকাতির সাথে সাথে তারা আগে থেকে ঠিক করে রাখা পার্টির কাছে মাল বিক্রি করে দেয়। সেই টাকা দিয়ে শোফারসহ মার্সিডিজ গাড়ি ভাড়া করে। নতুন বান্ধবীকে নিয়ে মার্সিডিজে চড়ে নামীদামী নাইট ক্লাবে যায়, শহরের সেরা রেস্টুরেন্টে ডিনার খায়। ধরা পরার অনেক আগেই টাকা শেষ করে ফেলে। ধরা পড়লে মালামালের দাম শোধ দেয় বেশিদিন জেল খেটে দিয়ে। তাতে কি তোমাদের কোনো লাভ হবে? গুডলাক জেন্টল্মেন। গুডনাইট।’
ঘর খালি হয়ে যাবার পর মোহরের উপর একরাশ অবসাদ এসে ভর করে। দেশে যাবার আকাঙ্খা, উচ্ছ্বাস কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। চোরেরা যেন সব উদ্যম চুরি করে নিয়ে গেছে। সে সোফায় গা এলিয়ে পড়ে থাকে। একসময় আনমনে পুলিশ অফিসারের দিয়ে যাওয়া কার্ডে চোখ বুলায়। কার্ডের উপরে অচেনা প্রতীক দিয়ে একটি মনোগ্রাম আঁকা। তাতে লেখা- ঋবফবৎধষ ইঁৎবধঁ ড়ভ ওহাবংঃরমধঃরড়হ. যুক্তরাষ্ট্রের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দ সংস্থা, মানে এফবিআই। মোহর উত্তেজনায় সোজা হয়ে বসে। যে অফিসারের সাথে তারা দু’জন এতক্ষন ধরে কথা বলছিল, তিনি সাধারণ পুলিশ ননÑএকজন এফবিআই অফিসার। সারাজীবন বইপত্র আর পত্রিকায় এফবিআই এর নানা কান্ডকীর্তির কথা পড়েছে। এতদিনে তাদের একজনের দেখা মিলল। সে কৌতুকের স্বরে সপু মিয়াকে বলে,
‘সব খারাপ ঘটনার একটা ভালো দিকও আছে।’
‘কেন, কি সু-সংবাদ পেলেন ?’
‘এই যে একজন এফবিআই কর্মকর্তার দেখা পেলাম। এখন ঠেকা বে-ঠেকায় তার শরণাপন্ন হওয়া যাবে।’
‘ভালো দিক শুধু ঐ একটাই না, আরো আছে। আসলে চোরেরা আপনার মহা উপকার করেছে। মাশাআল্লাহ্!’
‘চোরেরা উপকার করেছে?’ মোহর ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে।
‘এতগুলি ব্যাগ বাংলাদেশে নিয়ে যেতে জান ফানাফানা হয়ে যেত। চোরেরা আপনার বোঝা কমিয়ে দিয়েছে। এখন আরাম করে দেশভ্রমণ করতে পারবেন।’
এরপর সপু মিয়া তাকে আগামীকালের কথা মনে করিয়ে দেয়। থানায় গিয়ে চুরি যাওয়া মালের তালিকা করে দিয়ে আসতে হবে। বন্ধু বান্ধবদের কাছ থেকে জানতে হবে কার পোটলায় কি কি জিনিষপত্র ছিল। মোহর তার কথামত সবার কাছে ফোন করতে শুরু করে।
পরদিন থানায় গেলে থানা সহকারিণী তার হাতে একটি ফরম ধরিয়ে দেন।
‘এই ফরমে চুরি যাওয়া দ্রব্যের তালিকা লিখে ফেলো।’
মোহর ফরমটি হাতে নিয়ে পড়ে দেখে। এখানে সব মিলিয়ে অনধিক পনেরটি দ্রব্যের তালিকা করা যাবে। কিন্তু তার বাসা থেকে চুরি যাওয়া মালামালের সংখ্যা পঞ্চাশেরও অধিক। এটা হয়তো ব্যাচেলর অ্যামেরিকানদের জন্য তৈরি ফরম। প্রবাসী বাঙালির দেশভ্রমণ কালীন সময়ে সাথে নেয়া মালামালের তালিকার জন্য আলাদা কোনো ফরম নেই? সমস্যার কথা থানা সহকারিণীরর কাছে খুলে বলতে তিনি অভয় দেন, ‘তুমি লেখা শুরু কর। প্রয়োজনে আলাদা সাদা কাগজ দেয়া যাবে।’
সে আলাদা তিন পাতা কাগজ নেয়। তারপর পকেট থেকে রাফ তালিকা বের করে সেটা দেখে লেখা শুরু করে। লিখতেই থাকে…। তাকে তালিকা নিয়ে গলদঘর্ম হতে দেখে সহকারিনী একসময় কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে আসেন।
‘তুমি এত কি লিখছো! ফরমটা দাও তো, দেখি।
তিনি তালিকার মাঝামাঝি পর্যন্ত চোখ বুলান। তারপর চশমার উপর দিয়ে মোহরের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করেন, ‘তালিকা দেখে মনে হচ্ছে দোকানে ডাকাতি হয়েছে। তুমি কি একজন দোকানদার?’
দেশে যাবার দুদিন আগে তদন্তের অগ্রগতি সম্পর্কে মোহরের জানতে ইচ্ছে হয়। তাই সে কার্ডে লেখা নাম্বারে ডায়াল করে।
‘হ্যালো মিঃ মুলার ক্যামন আছো ? আমি মোহর খান।’
‘হ্যালো মিঃ খান! তোমার কেমন চলছে?’
‘মিঃ মুলার! আমি তিন মাসের জন্য দেশে বেড়াতে যাচ্ছি। তুমি আমার রুমমেটের নাম্বার লিখে রাখো। যে কোনো প্রায়োজনে তার সাথে যোগাযোগ করো। ভালো কথা, আমার কেসের কি কোনো অগ্রগতি হলো?’
‘দুঃখিত মিঃ খান, তোমার জন্য খারাপ খবর আছে। তোমার ঘরে অন্য কারো ফিঙ্গার প্রিন্ট পাওয়া যায়নি। অপরাধীরা গে¬াভস্ পরে এসেছিল।’
মোহরের ইচ্ছা হয় বলে, তোমরা এত উন্নত যন্ত্রপাতি আবিষ্কার কর, এখনো গে¬াভস্ দেখে অপরাধী ধরার পদ্ধতি আবিষ্কার করতে পারো নাই? কোনটা অপরাধীর গ্লোভস, আর কোনটা ভালো মানুষের গ্লোভস- এই পার্থক্য তোমাদের জানা উচিত। একজন এফবিআই এজেন্টকে এসব কথা বলা যায় না। অফিসারের পরবর্তী প্রশ্নে তার চমক ভাঙ্গে।
‘মিঃ খান, যদি কিছু মনে না কর, একটা প্রশ্ন করতে পারি?’
‘অবশ্যই পার, নো প্রবলেম।’
‘থানায় জমা দেওয়া তোমার চুরি যাওয়া জিনিস পত্রের তালিকাটা দেখেছি। শুধু কৌতুহলের কারণে জানতে চাচ্ছি, তোমার ঘরে নয়টা শ্যাম্পু ছিল। তোমার মাথা কি খুব ঘন ঘন ময়লা হয়?’
দেশ থেকে ফিরে এসে মোহর মামলার ব্যাপারে আগ্রহবোধ করে না। যদি কোনো খবর থাকে তাহলে ওরাই তাকে জানাবে। দেশে বেরিয়ে আসার কারণে অনেক ধার দেনা হয়েছে। চুরির ক্ষতি পুষিয়ে নিতে হবে, সে মনপ্রাণ ঢেলে দিয়ে কাজ শুরু করে। প্রবাস জীবন তো আর আনন্দ ফূর্তির লীলাভূমি নয়-একটার পর একটা ঝামেলা লেগেই আছে। কালক্রমে সে এই ঘটনার কথা পুরোপুরি ভুলে যায়।
এফবিআই এজেন্টের সাথে শেষ কথোপকথনের পর দেড় বছর পেরিয়ে গেছে। এক সন্ধ্যেবেলা মোহর কম্পিউটারে বসে গেম খেলছিল। ফোনে দুবার রিং হতে সে হাত বাড়িয়ে রিসিভার তুলে নেয়। ‘হ্যালো!’
‘আমি এজেন্ট মূলার। আমাকে তোমার মনে আছে ? তোমার বাসায় ব্রেক ইনের ঘটনা তদন্ত করছি।’
‘বলো মিঃ মুলার। তোমাকে আমার মনে আছে।’
‘শুধু একটা প্রশ্ন, তুমি রিপোর্টে লিখেছ, তোমার ঘর থেকে তিন হাজার ডলার চুরি হয়েছে। কি কারনে তুমি এতগুলি ক্যাশ টাকা ঘরে রেখেছিলে?’
‘পে¬নের টিকেটে ক্যাশ টাকা দিলে সেলস্ ট্যাক্সের টাকা মাপ পাওয়া যায়। তাছাড়া আমার দেশে যাওয়ার কথা ছিল। বাংলাদেশে বেড়াতে গেলে ক্যাশ টাকা লাগে, ওখানে ক্রেডিট কার্ড চলে না।’
‘অল রাইট। আমি তোমার পয়েণ্ট ধরতে পেরেছি। সময়মতো তোমার সাথে আবার যোগাযোগ করবো।’
তারপর একে একে দশটি বছর চলে গেছে। এজেন্ট মুলার আর যোগাযোগ করেনি। নিউইয়র্কে সংঘটিত অপরাধের তালিকায় আরো একটি অমীমাংসিত অপরাধ যোগ হয়েছে। তাতে সমালোচনাকারীদের সুবিধে হয়েছে-সপু মিয়ার বউয়ের গহনা ফেরত আসেনি। তবে এখনো মাঝে মাঝে মোহরের মনে হয়, যে কোনোদিন তিনি ফোন করবেন। তারপর হয়তো জানতে চাইবেন, ‘তুমি একজন ব্যাচেলর মানুষ হয়েও ঘরে এতগুলি বেবিফুড রেখেছিল কেন?’ অথবা ‘ক্যান্ডি খেলে মানুষ মোটা হয়, অথচ তুমি একজন মোটা মানুষ হয়েও এতবেশি ক্যান্ডি কিনেছিলে কেন?’ অথবা, …. …. … অন্য কিছু। সে প্রতীক্ষায় আছে।
নিউইয়র্ক। [ আবু রায়হান বইয়ের জগতের মানুষ এবং অহর্নিশ বই পড়তে ভালোবাসেন। প্রবাস জীবনের শত প্রতিকূলতার মাঝেও সাহিত্যচর্চায় নিমগ্ন থাকেন রায়হান।]