কাজী মোশাররফ হোসেন
মুসলিমদের জন্য আল্লাহ প্রদত্ত ক্ষমা, রহমত ও নাজাতের মাস রমাদান। সকল মুসলমান এই মাসে আল্লাহর কাছে কৃত অপরাধের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন এবং ফরয, ওয়াজিব ও নফল ইবাদতের মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য লাভ এবং অশেষ নেকী হাসিলের চেষ্টা করে থাকেন। এই পবিত্র মাসের যাকাত ও ফিতরা আদায় করতে হয় যা গরীবদের হক। ইসলামের বিধান মতে যাকাতের শর্ত হচ্ছে অবস্থাপন্ন মুসলমানদের কাছ থেকে ২.৫% হারে সরকার আদায় করে গরীবদের মধ্যে বন্টন করতে পারেন। তবে বাংলাদেশসহ পার্শ্ববর্তী মুসলিম দেশগুলোতে সরকারিভাবে বাধ্যতামূলক যাকাত আদায় করে কোষাগারে জমা দেওয়ার আইন হয়নি। তবে যাকাত বোর্ড স্বেচ্ছায় যারা প্রদান করেন তা গরীব বা যাকাতের হকদারদের মাঝে বিতরণ করে থাকে। সরকার বিভিন্ন সময়ে কালো টাকা সাদা করণের সুযোগ দিয়ে থাকেন। এক্ষেত্রে দেশি-বিদেশি ব্যাঙ্কে গচ্ছিত মোটা অঙ্কের মালিকদের কাছ থেকে অপ্রদর্শিত আয়ের ২.৫% যাকাত হিসেবে সরকারি কোষাগারে নিয়ে এসে তা গরিব ও অসহায় জনগোষ্ঠীর মাঝে বন্টন করতে পারেন। বিভিন্ন সময়ে অনেক উঠতি ধনী ও প্রতিষ্ঠানের ঘোষিত যাকাতের অর্থ ও কাপড় সংগ্রহ করতে গিয়ে প্রতিবছরই অনেক লোক পদদলিত হয়ে মূল্যবান প্রাণ হারান। সরকার তাদের কাছ থেকে বাধ্যতামূলকভাবে যাকাত আদায় এবং বন্টনের ব্যবস্থা করলে এ ধরনের অনাকাঙ্খিত পরিস্থিতি সহজে এড়ানো যায় । আবার যাকাতদাতারাও নিজ নিজ এলাকার অসহায় গরিব কিংবা খয়রাতি প্রতিষ্ঠানে নিজ নিজ উদ্যোগে যাকাতের অর্থ প্রেরণের ব্যবস্থা করে প্রাণহানির ঘটনা এড়াতে পারেন।
সমাজতান্ত্রিক সমাজ ব্যবস্থায়ও বৈষম্য প্রকট আকারে রয়েছে। তা আমরা চিন ও রাশিয়ার দিকে তাকালেই দেখতে পারি। চিনে পৃথিবীর বেশি সংখ্যক কোটিপতি বিদ্যমান রয়েছে।
মানব সভ্যতার ইতিহাসে ইসলামের দ্বিতীয় খলিফা আমিরুল মোমেনীন হযরত ওমর ফারুকের খিলাফতের কথা সর্বজনবিদিত। তাঁর খিলাফতকালে জনগণের মাঝে জামা বানানোর জন্য তিনি কিছু কাপড় বন্টন করেছিলেন। কাপড় এমন পরিমাণ ছিল যে তাতে তাদের লম্বা জামা বানানো সম্ভব ছিল না। পরের শুক্রবার আমীরুল মোমেনিন একটি লম্বা জামা পরে খুতবা দিতে প্রস্তুত হলেন। এ সময় একজন মুসল্লি দাঁড়িয়ে অভিযোগ করলেন, রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে পাওয়া কাপড়ের সাহায্যে আমরা লম্বা জামা বানাতে পারি নি। আপনি কিভাবে লম্বা জামা বানালেন। এমন সময়ে হযরত ওমর (রাঃ) এর ছেলে ওঠে দাঁড়িয়ে বলল্লেন, আমি আমার পাওয়া সরকারি কাপড়টুকু আমার পিতাকে দিয়েছি। আর দু জনের কাপড় দিয়ে একটিমাত্র লম্বা জামা বানানো হয়েছে। আরা জামাটি একদিন আমার বাবা এবং পরের দিন আমি পরিধান করব। হযরত ওমর সম্পর্কে আরও অনেক ঘটনা আছে যা মানুষের অন্তরকে ভীষণভাবে নাড়া দেয়। রাতের বেলায় নাগরিকদের অবস্থা স্বচক্ষে দেখার জন্য ছদ্মবেশে সারা শহর ঘুরে বেড়াতেন। আর অবরুদ্ধ জেরুজালেম যাত্রাপথের অর্ধেক অংশ ভৃত্যকে উটের পিঠে বসিয়ে ও নিজে দড়ি টেনে এবং বাকি অর্ধেক নিজে উটের পিঠে চেপে ও ভৃত্য দড়ি টেনে পাড়ি দিয়েছিলেন । তবু তাকে মুনাফিক মুসলমানদের হাতেই জীবন দিতে হয়েছে। পৃথিবীর সর্বশ্রেষ্ঠ দাতা হযরত ওসমান গণিকেও মুনাফিকের হাতে প্রাণ দিয়েছেন। চতুর্থ খলিফা হযরত আলীও এই মুনাফিকদের হাতেই প্রাণ দিয়েছেন।
আজকাল একদল গুপ্তঘাতক ইসলামের নামে অকারণে মানুষ খুন করার উন্মাদনায় মেতে উঠেছে। আবার একশ্রেণীর ক্ষমতাধর রাজনীতিক ও প্রভাবশালী ব্যক্তি মনুষ্যত্বকে নির্বাসনে দিয়ে জনগণের হক জেনে-শুনে আত্মসাত করছে। পরকালীন শাস্তি ও মৃত্যুভীতি সম্পর্কে উদাসীনতার কারণেই তারা এ জঘণ্য পাপে লিপ্ত রয়েছেন। তাদের অন্তরে মনুষ্যত্ববোধ জাগ্রত হোক এবং তারা এই মহাপাতকী খেলা থেকে বিরত হোন এটাই আমাদের কামনা। বিশ্ববিজয়ী আলোকজান্ডার তাঁর সহকর্মীদের বলেছিলেন- ‘মৃত্যুর পর আমার হাত দু‘টো কফিনের বাইরে রেখো যেনো জনগণ দেখতে পায় বিশ্ববিজয়ী আলেকজান্ডার একেবারে শূন্য হাতে পৃথিবী ত্যাগ করছেন। আমাদেরও একদিন এ নশ্বর পৃথিবী ছেড়ে যেতে হবে। মৃত্যুর পর আমাদেরকে নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে জবাবদিহি করতে হবে। বাংলাদেশের রাজনীতিতে নানা উত্থান-পতনের নায়কদের অনেকেও জগত থেকে বিদায় নিয়ে গেছেন এবং সময়ের অগ্রযাত্রায় সকলেই যেতে হবে। একদিন সকলকেই নিজ নিজ কৃতকর্মের জন্য বাধ্যতামূলক জবাবদিহি করতে হবে।
আসুন এবারের ঈদুল ফিতরে শপথ নেই- মুনাফেকী করব না, কারো মৌলিক অধিকার হরণে শামিল হব না, কাউকে বাস্তুচ্যুত করব না। রোহিঙ্গাদের মত পৃথিবীর সকল বাস্তুচ্যুত জনগণ নীড়ফেরা পাখির মত সসম্মানে ফিরে যাক নিজেদের জন্মভূমিতে। অন্ন, বস্ত্র, বাসস্থান, শিক্ষার মত মৌলিক অধিকারগুলো ধরাধামে প্রতিষ্ঠিত হোক। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে এই হোক শপথ ও প্রার্থনা।
-লস এঞ্জেলেস।