পরনির্ভরতা ও জাতীয় মর্যাদা

২৬ মার্চ, ২০১৮ তে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতা অর্জনের ৪৮তম দিবস পার করে এলো। প্রবাসে এবং দেশে এ উপলক্ষে আমরা প্রত্যক্ষ করলাম উৎসবে, উচ্ছ্বাসে বাংলাদেশীদের মাতামাতি। ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রত্যক্ষ লড়াই। দখলদার পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সশস্ত্র প্রতিরোধ শুরু হয়। ১৯৭১ এর ১৬ ডিসেম্বর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে পাকিস্তানি বাহিনী পরাজয় স্বীকার করে আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে সশস্ত্র প্রতিরোধযুদ্ধের সমাপ্তি ঘটলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই স্বাধীনতা অর্জনের পেছনে ছিল ৩০ লাখের মতো বাঙালি কৃষক-শ্রমিক-ছাত্র-জনতার জীবনদান, দুই লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি। আর স্বাধীনতার জন্য বাঙালিদের এই লড়াইয়ে ছিল রাশিয়া ও ভারতের প্রত্যক্ষ সমর্থন, সাহায্য ও সহযোগিতা। ভারতের কয়েক হাজার সৈন্যও প্রাণ দেন এই লড়াইয়ে।
কিন্তু এত আত্মত্যাগ এত বিসর্জন সত্ত্বেও স্বাধীনতার ৪৭ বছর পরেও চরম দুঃখের সঙ্গে লক্ষ করতে হচ্ছে যে আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ পেলেও নাগরিক হিসেবে সার্বভৌমত্ব অর্জন করতে পারিনি। আমাদের রাজনীতি পরনির্ভর যেমন তেমিন রাজনীতিবিদেরাও পরনির্ভর। এই পরনির্ভরতা কাটিয়ে উঠতে না পারার কারণ যারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন পন্থায় ক্ষমতায় গেছেন, তারা স্বাধীন দেশটাকে পরনির্ভলশীরতা কাটিয়ে একটি সার্বভৌম রাষ্ট্রে পরিণত করার উদ্যোগ নেননি। বরং ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে বিদেশি শক্তির কাছে ক্ষমতার নিশ্চয়তা পেলে দেশটাকে তাদের হাতে তুলে দিতে বিন্দুমাত্র কুণ্ঠিত হয়নি।
এ প্রসঙ্গে খুব মনে পড়ে কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের সেই ’কেউ কথা রাখেনি’, কবিতার কথা। বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের পাকিস্তান আমলে যত লড়াকু, সংগ্রামী, ত্যাগ দেখা গেছে। জেল, জুলুম স্বীকার করা এমন কি জীবনদানেও তারা পরোয়া করেননি। স্বাধীন বাংলাদেশে ক্ষমতার স্বাদ পেয়ে সেই সব সর্বস্বত্যাগী রাজনীতিবিদদেরই নতজানু পরনির্ভরশীল হয়ে পড়তে দেখা যায়। তারা জনগণকে যে কথা, যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় গিয়েছে, ক্ষমতায় গিয়েই তারা জনগণকে দেয়া ওয়াদা ভুলে গিয়ে বিদেশি শক্তিকে খুশি করার কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। সেই অবস্থাই চলে আসছে স্বাধীনতার ৪৭ বছর ধরে। আর যারা যত বেশি বিদেশি শক্তির কাছে নত হয়েছে, তাদের মুখে তত বেশি দেশপ্রেমের কথা, উন্নয়নের কথা উচ্চারিত হয়েছে। জনগণকে গণতন্ত্র বঞ্চিত করে, জাতীয় স্বার্থ বিসর্জন দিয়ে যে শাসকগোষ্ঠী যত বেশি বিদেশি শক্তির মুখাপেক্ষি হয়েছে, তারা তত বেশি এক নায়কতন্ত্রের দিকে ঝুঁকেছেন। তারাই গণতন্ত্রকে বিসর্জন দিয়ে উন্নয়নের মূলা ঝুলিয়ে দেশের মানুষকে কঠিন স্বৈরতন্ত্র উপহার দিয়েছে।
বর্তমান বাংলাদেশের দিকে তাকালে নানাভাবেই উপরের কথাগুলোর সত্যতা চোখে পড়বে। সে কথাই আরও স্পষ্ট করে প্রকাশ পেয়েছে একই সংখ্যার ঠিকানার দুটি সংবাদে। ঠিকানার ২০ এপ্রিল সংখ্যার দুটি সংবাদের একটি লিড নিউজ, শিরোনাম ‘দিল্লির সুতায় বাংলাদেশে তিন টেক্কার খেলা’। অপরটিও প্রথম পৃষ্ঠার খবর শিরোনাম ‘রাজনীতিতে বিদেশি প্রভাব/ বাংলাদেশের নির্ভরতা বাড়ছে। স্পষ্ট করেই বলা। বুঝতে অসুবিধা হওয়ার কথা নয় কারও।
২০১৮ সাল বাংলাদেশের নির্বাচনী বছর। ডিসেম্বরের মধ্যেই কোন এক সময় একাদশ জাতীয় সংসদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে বেশ কয়েকটা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনও অনুষ্ঠিত হবে। সিটি নির্বাচনেও জনপ্রিয়তা প্রমাণের লড়াই হবে। শক্তির প্রদর্শনীও হবে। জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ইতোমধ্যেই রাজনৈতিক বিভিন্ন দল যেমন তৎপর, তেমনি বাইরের শক্তিগলোও তৎপর হয়ে উঠেছে। অর্থনৈতিক কারণ ছাড়াও ভূ-রাজনৈতিক কারণে প্রাচ্য এবং পাশ্চাত্যের পরাশক্তি সবারই বাংলাদেশ ঘিরে অতিরিক্ত আকর্ষণ লক্ষ করা যায়। সবাই প্রভাব খাটাতে চায়, অন্তত প্রভাব রাখতে চায় বাংলাদেশে। ক্ষমতায় যারা থাকে তারা বিদেশী শক্তির প্রথম পছন্দ। তা না হলেও অগত্যা দ্বিতীয়, তৃতীয় শক্তি হলেও ক্ষতি নেই। অন্তত পা রাখার একটু মাটি পাওয়া যায়। সরাসরি স্বার্থ আদায়ের সুযোগ না হলেও পানি ঘোলা করা যাবে।
বাংলাদেশ নিয়ে ভারতের সবসময়ই একটু বিশেষ স্বার্থ লক্ষ করা গেছে বাংলাদেশের সেই স্বাধীনতা লড়াই শুরুর আগে থেকেই। তখন পারেনি পাকিস্তানের প্রতি আমেরিকার জোরালো সমর্থন থাকার কারণে। আর গোয়েন্দাগিরিতেও তখন আমেরিকা ছিল বিশ্বজুড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী। এখন রাজনৈতিক অনেকের মতেই বাংলাদেশে ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র’য়ের প্রভাব অপ্রতিদ্বন্দ্বী। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনদের ওপর। দীর্ঘদিন থেকেই এই অবস্থা বিদ্যমান। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন, বিএনপিকে নির্বাচনের বাইরে রাখা- সবই শোনা যায়, ভারতের ছকেই হয়েছে। এবারও তাদের ছকেই নাকি এখন পর্যন্ত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশের ‘নির্বাচনী এক্সপ্রেস’।
তাই প্রতিবেশী দেশের নেক নজরে থাকার জন্য বাংলাদেশের ছোট- বড় সব রাজনৈতিক দলেরই কসরতের সীমা নেই। সবারই প্রচেষ্টা কেউ যেন ভারতের কৃপাদৃষ্টির বাইরে না থাকে। বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলই নাকি বিশ্বাস করে ভারতের আশীর্বাদ ছাড়া এখন আর কারও ক্ষমতার স্বপ্ন দেখা চলবে না। সে কারণেই স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষের জন্য দুঃখজনক হলেও- এটাই এখন চরম বাস্তবতা যে, রাজনীতিবিদরা এখন জনগণের ভোট প্রার্থনা করলেও ক্রমাগত নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে বিদেশী শক্তির ওপর বিশেষ করে তাদের ওপর যারা নানাভাবে নিয়ন্ত্রণ করছে বাংলাদেশের রাজনীতি-অর্থনীতি। তাদের দৃষ্টি এখন তাই দেশ ছেড়ে বিদেশের ওপর। নির্ভরশীলতাও দেশের জনগণের বাইরে বিদেশী প্রভুদের ওপর।
‘রাজনীতিতে বিদেশী প্রভাব/ বাংলাদেশের নির্ভরতা বেড়েছে’ সংবাদটিতে কোনো রকম অস্পষ্টতা না রেখেই বলা হয়েছে যে, ‘বিদেশি প্রভাবশালী শক্তিসমূহের ওপর বাংলাদেশের নির্ভরতা, সমর্থন লাভের চেষ্টাও নজিরবিহীনভাবে বেড়েছে। দুর্বল, অস্থিতিশীল রাজনৈতিক অবস্থানের কারণেই বিদেশি মুরব্বিদের সহযোগিতা-সমর্থন লাভে সরকারের পাশাপাশি বিরোধী দল, বিশেষ করে প্রধান বিরোধী শক্তি নিরলস চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আসলে বিদেশী গুরুত্বপূর্ণ শক্তির সমর্থনপ্রত্যাশী যেমন বাংলাদেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, তেমনি বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অগ্রগতি এবং ভূ-রাজনৈতিক কারণে সামরিক এবং সামুদ্রিক গুরুত্ব বিবেচনায় বাংলাদেশও বিদেশি শক্তিসমূহের কাছে গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। তারা বাংলাদেশের রাজনীতিবিদদের নিজেদের মতো করে নিয়ন্ত্রণে রাখতে চায়। বিশেষ করে যারা ক্ষমতায় আছে এবং যারা ক্ষমতায় যাওয়ার সামর্থ রাখে।
ঠিকানার সম্পাদকীয়তে এ কথা বারবার বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশকে প্রজাতন্ত্র বলা হলেও নির্বাচনপূর্ব সময় ছাড়া প্রজাতন্ত্রের মানুষকে অর্থাৎ তাদের চাওয়া-পাওয়াকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি, এখনও দেয়া হয় না। সব সময় শাসকগোষ্ঠীর স্বপ্নের কথাই বলা হয়, কখনও জানার চেষ্টা করা হয় না প্রজাকুলের কোন স্বপ্ন আছে কি না। অথচ প্রজাতন্ত্রে প্রজাদের স্বপ্ন, প্রজাদের অধিকারই গুরুত্ব পাওয়ার কথা ছিল। তাদেরই স্বপ্ন বাস্তবায়নের এবং অধিকার সংরক্ষণেরই শাসককুলের সেবক হিসেবে দায়িত্ব পালনের কথা ছিল। ভাগ্য বদল হওয়ার কথা ছিল তাদেরই। বাংলাদেশ প্রজাতন্ত্র হওয়া সত্ত্বেও সবকিছু উল্টো হয়েছে। যারা ক্ষমতা গিয়েছে ভাগ্যবদল হয়েছে তাদের। স্বপ্নও পূরণ হয়েছে তাদের। ক্ষমতা এখন অর্থ-বিত্ত, প্রভাব-প্রতিপত্তি অর্জনের সবচেয়ে বড় এবং শক্তিশালী অস্ত্র। এই অস্ত্রের মালিক হওয়ার জন্যই জাতীয় স্বার্থ, জাতীয় মর্যাদা বিসর্জন দিয়ে সবাই বিদেশি শক্তির আশীর্বাদ লাভের আরাধনা করে।
অথচ মুক্তিযুদ্ধে এত জীবন উৎসর্গ করার পেছনে কেবল স্বাধীনতা অর্জনের স্বপ্নই ছিল না মানুষের, স্বপ্ন ছিল তারা সব রকম অধিকার ফিরে পাওয়ার পাশাপাশি সার্বভৌম দেশের মর্যাদাবান নাগরিক হবে। নির্বাচন কেবল শাসকগোষ্ঠীর ক্ষমতা অর্জনের মধ্য দিয়ে তাদের ভাগ্যবদলের মাধ্যমে হবে না। অথচ আজ দেখা যাচ্ছে- নাগরিক সমাজের মর্যাদা এবং অধিকার সংরক্ষণে শাসককুলের তৎপরতা নেই। নিজেরা ক্ষমতার জন্য জনগণের মর্যাদা ও অধিকারকে গুরুত্ব না দিয়ে বিদেশী শক্তিকেই প্রাধান্য দিচ্ছে। বিদেশি শক্তির ওপর শাসককুলের পরনির্ভরতা যত বাড়ছে, জাতির মর্যাদা তত কমছে।
এই বিদেশ-নির্ভরতার অবসান না ঘটলে, আমরা কোনদিনই মর্যাদার সঙ্গে মাথা তুলে বলতে পারব না- আমরা প্রকৃত স্বাধীন-সার্বভৌম দেশের নাগরিক।