পরবাস জীবনে মায়ের অপূর্ণতা বিরামহীন সংঘর্ষে পথচলা

উইলি মুক্তি

ভোর সাতটা। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। দুশ্চিন্তায় সারারাত ঘুমোতে পারিনি। যথাসময়ে বাচ্চাদের তৈরি করে এই বৃষ্টির মধ্যেও স্কুলে পাঠালাম। বাচ্চাদের মুখ অনেক মলিন কারণ তাদের নানু আজ দেশে ফিরে যাচ্ছেন। দুজনেই নানুকে জড়িয়ে ধরে কাঁদছে। অশ্রু মুছতে মুছতে বিদায় নিলো নানুর কাছ থেকে স্কুলের উদ্দেশ্যে । সকালবেলা অনাকাঙ্খিত একটি কারণে মনটা অনেক বিষন্ন হয়ে গেল। তারপরও সেদিকে ভ্রূক্ষেপ না করে মাকে তৈরি করতে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। আমিও যাবতীয় জরুরি কাগজপত্র গুছিয়ে ঝটপট তৈরি হয়ে নিলাম। একদিকে মাকে যথাসময়ে এয়াারপোর্টে পৌঁছে দিতে হবে, অন্যদিকে আমাকেও ছুটতে হবে হাসপাতালের উদ্দেশ্যে পূর্ব নির্ধারিত অ্যাপয়েনমেন্টে।
আমার বর দানি, একা একা বৃষ্টিতে ভিজে লাগজেগুলো গাড়িতে উঠিয়ে আমাদের জন্য নিচে অপেক্ষা করছিল। আমি, দানি এবং মা রওয়াানা দিলাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। প্রবল বৃষ্টিতে গাড়ির গ্লাসগুলো সব ঝাপসা দেখাচ্ছে। পুরোটা পথ মনের মাঝে একটা ভয়, আতঙ্ক, কষ্ট নিয়ে পৌঁছলাম এয়ারপোর্টে। বাতাসে ছাতা উড়িয়ে নিয়ে যাচ্ছিলো। দানি আমাদের নামিয়ে দিয়ে গাড়ি পার্কিং করতে চলে গেল। এক হাতে ট্রলিসহ ছাতা আর অন্য হাতে মাকে গাড়ি থেকে নামাতে গিয়ে আমিও বৃষ্টিতে ভিজে একাকার হলাম। ভেতরে ঢুকে দেখি বিশাল লম্বা লাইন। লাইন শেষ হতে সাড়ে দশটা বেজে গেলো। মার চেহারার দিকে তাকাতে পারছি না ভয়ে। গত সপ্তাহের কথা মনে করে আতঙ্কিত হয়ে আছি। ঐদিন মার চলে যাবার কথা ছিল কিন্তু আমাদেরকে এয়ারপোর্ট থেকে ফেরত আসতে হয়েছিল। আমার অজ্ঞতা আর ভুলের কারণেই তা হয়েছিল ।
মার সকল প্রয়োজনীয় পেপার্স পাসপোর্ট আমার কাছেই থাকে। কখনো পাসপোর্টের প্রয়োজন হয়নি, তাই চেক করে দেখিনি মেয়াদ আছে কিনা ! লাগেজ স্কেলে উঠিয়েছি সবে, ঐ মুহূর্তে ইমিগ্রেশন অফিসার বললেন পাসপোর্টের মেয়াদ শেষ হয়ে গিয়েছে দু’মাস আগেই। এটি আমাদের জন্য ছিলো বড় ধরনের এক ধাক্কা। মার দিকে তাকিয়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম ! সব প্রস্তুতি সত্ত্বেও দেশে না যেতে পারার বেদনায় মায়ের চোখে অশ্রুসজল দেখে মনোকষ্টে বাসায় ফিরে এসেছিলাম সেদিন। এক সপ্তাহের মধ্যে সব পেপার্স রেডি করে আবার আজ আমরা এখানে, মার চেহারায় যে ভয় দেখতে পাচ্ছি তাতে আমারই ভয় লাগছে । বারবার আড়চোখে মার দিকে তাকাচ্ছি আর নিজেই ভয়ে কুঁকড়ে যাচ্ছি এই ভেবে, পাসপোর্টের পরিবর্তে যে পারমিশন দিয়েছে ফ্লাই করার জন্য তাতে কোনো রকম সমস্যা না হলেই রক্ষা।
আল্লাহ পাক সহায়। এগারটা বিশে মার ফ্লাইট। এগারটা বাজার দশ মিনিট বাকি, সকল যাত্রী ভেতরে চলে গিয়েছেন, শুধু তিনজন হুইল চেয়ারের অপেক্ষায়। তার মধ্যে আমার মা একজন। মা চলে যাচ্ছে বুকের মাঝে শূন্যতা অনুভব করছি কিন্তু প্রকাশ করতে পারছি না। মনে চরম অস্থিরতাও বিরাজ করছে, কারণ বারটার মধ্যে হসপিটালে পৌঁছাতে হবে। আজ আমার অপারেশন হবে। বিদায় বেলায় পুত্রসম দানিকে জড়িয়ে ধরে মা হু হু করে কাঁদেেছন, আর বলছিলেন, মেয়েটা আমার অনেক সহজ সরল, অনেক কিছু বুঝতে পারে না। রাগ করে নয় আদর দিয়ে ওকে সব করাতে পারবে। সে আদরের কাঙাল। অসুস্থ তাকে দেখে রেখো। আমি মাকে হুইল চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে সিকিউরিটি চেকইনের জন্যে তাগিদ দেই। কেননা, মা-ই ছিল শেষ যাত্রী। বুকের ভেতরে হাতুড়ি পেটানোর আওয়াজ হচ্ছিলো যেনো নিজের কানেই সেই আওয়াজ শুনতে পাচ্ছি। শেষ পর্যন্ত মার কান্নার আওয়াজ আরো বেড়ে গেলো। নিজেকে আর ধরে রাখতে পারলাম না। মাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। তাড়াহুড়ো, ব্যস্ততা, হাসপাতাল, অপারেশন এমনতর নানাবিধ চিন্তায় বিদায়টাও ঠিকমত দেয়া হল না। কিছুই বলা হলো না আমার মা’কে ।
বৃষ্টি যেনো কিছুতেই থামছে না। মনে হচ্ছে আকাশ আজ আমার কষ্টে কান্নায় বৃষ্টি হয়ে লুটিয়ে পড়ছে ধরিত্রীতে। এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে আমাদের গাড়ি হাওয়ার বেগে ছুটতে লাগলো হসপিটালের উদ্দেশ্যে। আমাকে নামিয়ে দিয়ে ম্যানহাটনের ব্যস্ত রাস্তায় পার্কিংয়ের খোঁজে চলে গেলো সে। যাবতীয় ফরমালিটি শেষে আমায় অন্যসব রোগীদের সাথে ওয়েটিং রুমে বসিয়ে রাখা হল। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে চেপে রাখা কষ্ট অশ্রু হয়ে ঝরতে লাগলো। পাঁচ মাসে বিদেশের মাটিতে মার সাথে কাটানো সমগ্র স্মৃতির গহ্বরে হারিয়ে গেলাম। দানি কাছে নেই, একা অপেক্ষা করছি অপারেশন এর জন্য। প্রত্যেক রোগীর সাথে আপনজনরা বসে আছে। একমাত্র আমিই একা, সাথে কেউ নেই। একসময় একজন নার্স রিচ বেন্ড পরাতে এসে দেখলো ঠান্ডায় কাঁপছি। কিছুক্ষণ পর সে একটি গরম কম্বল এনে আমার গায়ে জড়িয়ে দিয়ে বললো, আমি এখন ভালো ফিল করছি কিনা। মাথা নাড়িয়ে সম্মতি প্রকাশ করলাম। কম্বলের উষ্ণ আমেজে আমার চোখ বন্ধ হয়ে এলো। অদ্ভুত এক ঘোরের জগতে চলে গেলাম যেন ! আচমকা নার্স এসে ডেকে তুলল। জানতে চাইলো আমার সাথে কে এসেছে। জানালাম, আমার হাজবেন্ড। দানির নাম্বার চেয়ে নিলো। তখন দুপুর দুটো। আমার আশেপাশের রোগীদের এক এক করে নিয়ে যাচ্ছে ওটিতে; আত্মীয়রা যে যার মত তাদের প্রিয়জনদের বিদায় জানাচ্ছে। কেউ চুমু খেয়ে কেউ জড়িয়ে ধরে। আমিই শুধু একা, অসহায়। মমতার, ভালবাসার হাতখানি মাথায় বুলিয়ে দেবার কোন প্রিয়জন পাশে নেই। কষ্টে চোখের জলে ভেসে চলেছি। নার্স এসে বারবার প্রেসার চেক করে জানতে চায়, আর ইউ ওকে ? কাঁদতে কাঁদতে মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেই। তোমার হাজবেন্ড কখন আসবে? আমরা ফোন করে তাঁকে পাচ্ছি না। দানি তখনো আসেনি পার্কিং করে। ম্যানহাটনের রাস্তায় পার্কিং পাওয়া চাট্টিখানি কথা নয় ! এদিকে স্কুল থেকে বাচ্চাদের বাড়ি ফেরার সময় হয়ে গিয়েছে। কষ্ট, চিন্তা, অপেক্ষা সব মিলিয়ে চোখে অন্ধকার দেখতে লাগলাম। কী ভীষণ একা, অসহায় লাগছিল নিজেকে ! তবুও কাছের একজনকে ফোন দিলাম এই আশায় যদি কোন সহযোগিতা পাই। কিন্তু না, ভাগ্য আমার এতটাই প্রতিকূলে যে সেখান থেকেও কোনো সাড়া পাওয়া গেলো না। বাসায় মেয়েকে ফোন দিয়ে খোঁজ নেই। ছোট ভাইকে টেককেয়ার করতে বলি। চুলা না জ্বালাতে সতর্ক করি। শেষে একাই আমাকে দু জন নার্স এসে ওটিতে নিয়ে যেতে যেতে বললো, তোমার হাজবেন্ডের জন্য আর অপেক্ষা করা যাবেনা। তোমার প্রসিডিওর শেষ হলে আমরা তাঁকে কল দিব। অশ্রু সংবরণের চেষ্টা করছিলাম। ডাক্তার জানতে চাইলেন, কাঁদছো কেনো ? তুমি কি ভয় পাচ্ছো? ঐ সময়ে আর কিছুই বলার ইচ্ছে হলো না। অশ্রুসিক্ত চোখে শুধু ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকলাম। ওটির বেডে শুয়ে ব্যথায় কাতর আমি কত কী ভাবছিলাম ! ধীরে ধীরে এনেসথেসিয়ার প্রভাবে অন্য জগতে চলে গেলাম যেন। দু ঘণ্টা পর নার্স আমাকে ওটি থেকে বের করে অবজারভেশন রুমের বেডে রেখে গেলো। এনেসথেসিয়ার প্রকোপ এতটাই ছিল যে আমার জেগে উঠতে সময় লাগলো পাঁচ ঘণ্টা। টের পেলাম শিয়রে কারো উষ্ণ হাতের ছোঁয়া ! চোখ খুলতেই দেখি দানি আমার পাশে দাঁড়িয়ে। ওকে দেখে জড়িয়ে ধরে হুহু করে কান্নায় ভেঙে পড়লাম। কিছুক্ষণ পর টের পেলাম কাঁদতেও ক্লান্ত লাগছে। কয়টা বাজে ? কথা বলতে যেয়ে দেখি গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হচ্ছে না । পুরো গলা ক্রাক হয়ে আছে । কোনো রকম ইশারায় বাচ্চাদের খোঁজ নিলাম। আগের দিনের খাবার ছিলো তা দু ভাই বোন ভাগাভাগি করে খেয়ে ঘুমিয়ে পড়েছে। আমি কাঁদছি। আমার সন্তানদের কথা ভাবছি। কষ্টে বুক ভেঙ্গে যাচ্ছে। নার্সকে অনেক কষ্টে বললাম, আমি বাসায় যাবো আমাকে ডিসচার্জ করে দাও। কিন্তু আমি উঠে বসতে অসমর্থ ছিলাম বলে বাসায় আসার জন্য ওরা কিছুতেই ডিসচার্জ করতে চাচ্ছে না। আমার প্রেসার হাই আমি দাঁড়িয়ে থাকতে পারছি না, গলা দিয়ে ব্লিডিং হচ্ছে । শেষ পর্যন্ত আমার অনেক পীড়াপীড়িতে ওরা বাধ্য হলো ছাড়তে। তার আগে আমাকে এক ঘন্টা দাঁড় করিয়ে হাঁটালো আমি চলতে পারি কিনা, শরীরে শক্তি ছিল না। কিন্তু মনের জোর দিয়ে আমি ওদেরকে হেঁটে দেখালাম। ওরা দানির গ্যারান্টি নিলো আমাকে বাসায় ভালো নার্সিং দিতে পারবে কিনা। অবশেষে শেষ রাতে আমি বাড়ি ফিরে এলাম । বাচ্চাদের গালে আদর মেখে ওদের ঘুমের নিষ্পাপ চেহারা মন ভোরে দেখে চোখের জলে আমি আমার ঘরে যেয়ে শুয়ে পড়লাম । মানুষের জীবন কতটা বিচিত্র আজ এই ভিনদেশে থেকে প্রতিটি মুহূর্তে আমাদের উপলব্ধি করতে হয় আমরা কতটা পরবাস জীবনে মায়ের অপূর্ণতা অসহায় আত্মীয় -স্বজন ছাড়া। নিজের মা এর বিদায় বেলায়ও আবেগ প্রকাশ করার অবকাশ পাইনি নিজের অসুস্থতার কারণে । হসপিটালে একা পড়ে ছিলাম কেউ ছিলো না পাশে। বাচ্চারা ওদের মায়ের জন্য অপেক্ষা করে শেষে আধপেট না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়েছে । মাঝে মাঝে এই ভেবে মন অশান্ত হয়ে উঠে, যদি দুনিয়া ছেড়ে চলে যেতে হয়, তবে আমার ছোট বাচ্চাগুলোকে কে দেখবে ? গায়ে জ্বর, বুকে, গলায় তীব্র ব্যথা। তারপরও বিছানা ছেড়ে উঠে এসেছি। রান্না করতে হচ্ছে। ছোট বাচ্চাটাকে খাওয়াতে হবে, মা হয়ে বাচ্চাদের কি করে না খাইয়ে রাখবো ? কারণ বাসায় কেউ নেই সাহায্য করার মতো, সবাই কাজে। কাজতো বন্ধ করা যাবে না এদেশে ! অসুস্থ হলেও উপায় নেই । অনুভূতিতে কেবলি শূন্যতা। গত পাঁচটি মাস মা ছিলেন আমার কাছে, এই বিদেশের বাড়িতে। আজ তিনি কাছে নেই। যেখানেই হাত দেই সেখানেই মার হাতের ছোঁয়া পাই। অসুস্থ ছিলাম বলে আমাকে কাজ করতে দিতেন না। বেশির ভাগ কাজই আমি ঘুম থেকে উঠার আগে মা শেষ করে ফেলতেন। যে ঘরে মা থাকতেন, সেখানে মায়ের শরীরের, পান সুপারির ঘ্রাণ। যেন মা এখনো এ ঘরেই আছে। কোরআন তেলওয়াতের আওয়াজ, সুরা পড়ে বাচ্চাদের শরীরে ফুঁ দেয়া, ভালো-মন্দ জ্ঞান দেয়া, সবই মার দখলে ছিলো এই পাঁচ মাস। আমার সন্তানেরা আগের মতো আর হাসে না। সারাক্ষণই নানুর সাথে কতো হাসাহাসি খুনসুটি করতো, আর আমি দৌড়ে যেতাম শুনতে ওরা কী নিয়ে হাসছে। আমার বাচ্চারা এখন নীরব। আল্লাহ্ পাক সব মায়েদের এক নৈসর্গিক শক্তি দিয়ে দিয়েছেন। শত কষ্টের মাঝেও মা তার বাচ্চাদের বুকের মধ্যে আগলে রাখে। আমার মা আমার কাছে যেমন মূল্যবান, তেমনি আমার শাশুড়িও তার ছেলের কাছে অনেক মূল্যবান। দুজনকে একই পাল্লায় মূল্যায়ন করলে কখনো কোনো মাকে বৃদ্ধাশ্রমে যেতে হতো না। দুনিয়াতে কোথাও কোন বৃদ্ধাশ্রম থাকতো না। ‘‘প্রদীপ হয়ে মোর শিয়রে
কে জেগে রয় দুঃখের ঘরে
সেই যে আমার মা
বিশ্ব ভুবন মাঝে তাহার নেইকো তুলনা”
মা দিবসে সব মায়েদের জন্য প্রাণঢালা ভালোবাসা, শুভেচ্ছা আর শুভকামনা। সবাই ভাল থাকুন সুস্থ থাকুন অন্যকেও ভালো থাকার সুযোগ দিন এই প্রত্যাশায়।
-নিউইয়র্ক।