পরমাণুযুদ্ধ কতদূর!

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়েছিল ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর। শেষ হয় জাপানের দুটি শহরÑহিরোশিমা ও নাগাসাকিতে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো আণবিক বোমা বিস্ফোরণের মধ্য দিয়ে ২ সেপ্টেম্বর ১৯৪৫ সালে। ৬ আগস্ট আমেরিকা প্রথম অ্যাটম বোমা ফেলে হিরোশিমায়। দ্বিতীয় বোমা ফেলে একই মাসের ৯ তারিখে। এরপর জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে ২ সেপ্টেম্বর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের অবসান ঘটে। ছয় বছরের যুদ্ধের আঁচ থেকে কোনো দেশই রক্ষা পায়নি। মনে করা হয়, এই যুদ্ধে সাড়ে তিন কোটি থেকে ছয় কোটি মানুষ মৃত্যুবরণ করে, যা সেই সময় বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৩ শতাংশ। আমেরিকার সৈন্য মারা গিয়েছিল ৪ লাখ ৭ হাজার। বেসামরিক মৃত্যু ছিল প্রায় ২ লাখ ৯৮ হাজার। রাশিয়ার সবচেয়ে বেশি, ১ কোটি ৮০ লাখ, মানুষ মারা যায়।

আমেরিকার অবস্থানগত কারণে বেসামরিক প্রাণহানি খুব কম হয়। অ্যাটম বোমার প্রথম ব্যবহারে হিরোশিমায় প্রাণহানি ঘটে প্রায় দেড় লাখ মানুষের। নাগাসাকিতে মৃত্যু প্রায় ৮০ হাজার। তবে বলা হয়, সেই অ্যাটম বোমার প্রতিক্রিয়া এখনো যারা জন্ম নিচ্ছে, তাদের অনেকের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর কেটে গেছে ৭৮ বছর। বিজ্ঞানের অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে। সেই আলোকে বর্তমানে অ্যাটম বোমার ব্যবহার যদি এখন হয়, তবে ১৯৪৫ সালের চেয়ে প্রাণহানি এবং ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ কতগুণ হতে পারে-সে হিসাব কষার জন্য জীবিত মানুষের সন্ধান পাওয়া যাবে কি না, সন্দেহ রয়েছে।

এখন যুদ্ধ চলছে রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যে। ইউক্রেনের ওপর রাশিয়ার চাপিয়ে দেওয়া এ যুদ্ধ। যুদ্ধের বয়স এক বছর অতিক্রম করে গেছে। এখন রাশিয়ার পক্ষ থেকে পরমাণুযুদ্ধের হুমকি শোনা যাচ্ছে। যুদ্ধের হুমকি কানে এলেই সভ্য ও শান্তিপ্রিয় মানুষের বুকে কম্পন শুরু হয়। যুদ্ধ মানেই মানুষের মৃত্যু। যুদ্ধ মানেই শান্তি ও সভ্যতার মৃত্যু। দুটি বিশ্বযুদ্ধ ছাড়াও যুদ্ধ হয়েছে কোরিয়া, ভিয়েতনাম, আফগানিস্তান ও ইরাকে। যুদ্ধ হয়েছে ইরাক ও কুয়েতের মধ্যে। কেউ কাউকে স্থায়ী দখলে রাখতে পারেনি। কিন্তু কেউই মানুষের প্রাণ ফিরিয়ে দিতে পারেনি। আসলে জীবন একবার চলে গেলে আর ফিরে পাওয়া যায় না। আমাদের চেয়ে এ সত্য আরো ভালোভাবে জানে সভ্য দুনিয়ার মানুষ। এখনো খণ্ড খণ্ড আঞ্চলিক যুদ্ধ চলছে। সেসব দেশে মানুষই শুধু মরছে না, যারা বেঁচে আছে, তারাও কেবল মরেনি বলেই বেঁচে রয়েছে। তাদের জীবনযাপন এখন একেবারেই দুঃসহনীয় এবং মানবেতর। কোটি কোটি শিশু চরম অপুষ্টিতে ভুগছে। শিক্ষা, খাদ্য, আশ্রয় ও স্বাস্থ্যসুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। হাজার হাজার বছরের সভ্যতা ধ্বংস হয়ে যায় যুদ্ধে। অথচ এই যুদ্ধ না হলে অস্ত্রের উৎপাদন হতো না। সভ্যতা আরও সুন্দর হতো। একজন মানুষও না খেয়ে মরত না।

বহমান সম্পাদকীয়তে পরমাণুযুদ্ধের আতঙ্ক নিয়ে লেখার প্রেক্ষাপট নিয়ে যেটুকু বলা হলো, তা কেবল ভূমিকা মাত্র। বিশ্ববাসী জানে, মাত্র কয়েকটি দেশের হাতে পরমাণু বোমা রয়েছে। যেসব বোমা সুন্দর এ পৃথিবীটাকে ধ্বংস করে দিতে পারে। সেসব আণবিক শক্তির অন্যতম রাশিয়া। বর্তমানে ইউক্রেনের বিরুদ্ধে রাশিয়া যুদ্ধ করছে। এ যুদ্ধ রশিয়ারই চাপিয়ে দেওয়া। যুদ্ধ এক বছর অতিক্রান্ত হয়েছে। সমাপ্তির লক্ষণ নেই। দিন দিন প্রবল হচ্ছে। অন্যান্য পরাশক্তিও যুদ্ধের অবসানে কার্যকর কোনো উদ্যোগ না নিয়ে যুদ্ধ যাতে দীর্ঘস্থায়ী হয়, সে লক্ষ্যে ইউক্রেনকে যুদ্ধের জন্য নানা প্রকার রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক সব যুদ্ধাস্ত্র দিয়ে ইউক্রেনের শক্তি বৃদ্ধি করে চলেছে। অনেকেই মনে করেন, অন্যের ঘাড়ে বন্দুক রেখে শত্রুকে পরাজিত করা। ইউরোপ-আমেরিকার চিরশত্রু রাশিয়া। ইউক্রেনকে দিয়ে রাশিয়াকে শিক্ষা দেওয়ার এই সুযোগ তারা হাতছাড়া করতে চায় না।

এ যেন সেই ব্যাঙের গল্পের মতো : ‘যা তোমাদের জন্য খেলা, তা আমাদের জন্য মৃত্যু।’

ইউক্রেনের সঙ্গে যুদ্ধের এক বছর পর রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন পরমাণু হামলার হুমকি দিয়ে বিশ্বের শান্তিপ্রিয় মানুষের মনে আতঙ্ক ধরিয়ে দিয়েছেন। রাশিয়া পশ্চিমাদের হুমকি দিয়ে বলেছে, পশ্চিমারা ইউক্রেন থেকে সরে না গেলে প্রয়োজনে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করা হবে। রাশিয়ার স্থানীয় সময় গত ২১ ফেব্রুয়ারি পার্লামেন্টে দেওয়া ভাষণে পুতিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে করা কৌশলগত পরমাণু অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি ‘নিউ স্টার্ট’ স্থগিতের ঘোষণা দিয়ে এ হুমকি দেন। এ ঘোষণার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বজুড়ে প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র রাশিয়ার এ সিদ্ধান্তকে ‘দুর্ভাগ্যজনক ও দায়িত্বহীন’ বলে মন্তব্য করেছে। বিশ্বনেতাদের মধ্যে পুতিনকে একজন ‘অস্থির চিত্ত’র নেতা বলে মনে করা হয়। পুতিনের এই হুঁশিয়ারি দেওয়ার আসল উদ্দেশ্য কী, তা জানা না গেলেও এমন হতে পারে, যুদ্ধ অবসানে পশ্চিমাদের ওপর চাপ প্রয়োগ করতেই তার এ হুঁশিয়ারি। বিশ্ববাসী মনে করে, পরমাণুযুদ্ধের হুমকি সামনে রেখে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা পাগলামি ছাড়া আর কিছুই নয়। কোটি কেটি শিশুকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পুষ্টিবঞ্চিত এবং কোটি কোটি মানুষকে অভুক্ত রেখে যারা নিজেদের ‘বিশ্বনেতা’ বলে দাবি করে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলায় মেতে থাকেন, তাদের সেই দাবি একেবারেই বেমানান। তাদের উন্মাদ, মুনাফাখোর পুঁজিবাদী মোড়ল ছাড়া কিছুই বলা যায় না।

আজকের পরিস্থিতিতে আমরা সব পক্ষের শুভবুদ্ধির উদয় হোক কামনা করি। আমরা একটি যুদ্ধমুক্ত বিশ্ব চাই। চাই শান্তি ও সভ্যতা বিরাজমান একটি বাসযোগ্য ভূমি।