এস এম মোজাম্মেল হক :
‘ওরে নবীন ওরে আমার কাঁচা আধ মরাদের ঘা মেরে তুই বাঁচা’-বাংলা কবিতার বিখ্যাত চরণটিতে নবীন তথা প্রাণশক্তিসম্পন্ন যুবাদের সমাজ সংস্কারের জন্য যথোপযুক্ত দায়িত্ববান বিবেচনা করে রুগ্্ণ-দুর্বলের জন্য শক্তি ও সাহসের কান্ডারি হিসেবে তাদেরকে সঙ্গে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানানো হয়েছে। প্রকৃতপক্ষে পরিবর্তনের জন্য যুবারাই নিয়ামক শক্তি। যুবারা যখন দৃপ্ত শপথে এগিয়ে যায়, তখন তাদের রোখার ক্ষমতা কারো থাকে না।
যুগে যুগে ইতিহাসের বাঁকে বাঁকে যার হাজারো প্রমাণ বিদ্যমান। যুবাদের নেতৃত্ব ও সিদ্ধান্ত হয় সব সময় ইতিবাচক আর তাই যুবাদের হাত ধরেই আসে জাতীয় উন্নতি ও অগ্রগতি। যুবাদের মধ্যে যখন সে আত্মোপলব্ধি জাগ্রত হয়, তখন তাদের বাঁধভাঙা শক্তি সকল জরাজীর্ণকে পাশে ঠেলে সৃষ্টিশীলতার মূলমন্ত্রে ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের মাধ্যমে নানা প্রতিকূলতা সত্ত্বেও সাফল্যের তরণি ঠিকই তীরে নোঙ্গর করতে সক্ষম হয়। যার প্রমাণ ২০২০-এর ক্ষমতার রদবদল। মনে করা হয়, তখন নবীন ভোটাররা ক্ষমতার রদবদলে মুখ্য ভূমিকা পালন করে। এবার মধ্যবর্তী নির্বাচনেও যুবাদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ফলাফল নির্ধারণে ব্যাপক ভূমিকা রাখবে বলে অভিজ্ঞ মহলের ধারণা। কারণ হিসেবে বলা যায়, উভয় দলেরই নির্দিষ্ট সমর্থকেরা যার যার পছন্দের পক্ষ অবলম্বন করে থাকেন, যা উভয় পক্ষে ভারসাম্যপূর্ণ। ফলে যেকোনো পক্ষের বিজয়ের জন্য প্রয়োজন দল নিরপেক্ষদের সমর্থন, যা বিজয়ে ব্যাপক ভূমিকা রাখতে সক্ষম হয়।
পৃথিবীর জনশক্তির প্রায় অর্ধেক নারী, যারা এখন আর অবলা বিশেষণে বিশেষায়িত নয় বরং পুরুষের সমকক্ষ এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে পুরুষের চেয়ে অগ্রগামী ভূমিকায়। নারীরা সংসারে, এমনকি রাষ্ট্রীয় নীতিনির্ধারণী পর্যায়েও দক্ষতার সঙ্গে ব্যাপক ভূমিকায় অবতীর্ণ। পৃথিবীতে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডেও নারীরা কোনো অংশে পিছিয়ে নেই। নারীদের এ অবস্থান তাদের মেধা, যোগ্যতা, সদিচ্ছা, সাহস ও সেবার মনোভাব থেকে উৎসরিত। নারীদের ব্যাপক কর্মকাণ্ড তাদের যেমন মর্যাদার আসনে বসিয়েছে, তেমনি তারা নিজেরাও তা উপলব্ধি করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে কখনোই পিছিয়ে থাকার পক্ষপাতী নয়। অন্যদিকে তারা তাদের সামগ্রিক স্বার্থের ব্যাপারে খুবই সচেতন। গত প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে নারী ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ফলাফল নির্ধারণে তাই ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে বলে রাজনৈতিক সচেতন মহলের ধারণা।
আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচনেও তার ব্যতিক্রম হবে না বলে ধারণা করা যায়। নারীর গর্ভপাত বিষয়টি বর্তমানে এত বেশি আলোচিত এবং নারীরা বিষয়টিকে তাদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা সমাধানের ক্ষেত্রে নিজস্ব স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণে অত্যন্ত ফলপ্রসূ বলে মনে করে, যা আইন দ্বারা কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণের যোগ্য নয় বলে তাদের অভিমত। সে কারণে অতি সম্প্রতি গর্ভপাত নিষিদ্ধ সম্পর্কিত সিদ্ধান্তের ফলে দেশজুড়ে নারী-পুরুষ উভয়ের মধ্যেই ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। বিশেষ করে, নারীরা এটিকে তাদের স্বাধীন সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধক হিসেবে বিবেচনা করছে। তাদের এ মতামতের সঙ্গে নীল শিবিরের একমত পোষণের ফলে ভোটাধিকার প্রয়োগের ক্ষেত্রে তাদের সমর্থন নীল শিবিরের পক্ষেই থাকবে বলে বিশেষজ্ঞদের ধারণা। এহেন পরিস্থিতিতে যুবা ও নারী ভোটারদের ব্যাপক অংশগ্রহণ ঘটলে নীল শিবির তার সুফল পাবে বলে অনেকের ধারণা। তবে এ ক্ষেত্রে তাদের উদ্বুদ্ধ করার দায়িত্ব সংশ্লিষ্ট মহলের। অন্যথায় এর সুফল হাতছাড়া হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই তৃণমূল পর্যায়ে তাদের ভোটদান নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই।
প্রতিটি দেশের মধ্যবিত্ত শ্রেণি মূলত দেশের চালিকাশক্তি। সংখ্যায় যেমন তারা অধিক, তাদের ভূমিকাও তেমনি জোরালো। মধ্যবিত্ত শ্রেণির চাহিদা খুবই সামান্য, খেয়ে-পরে সম্মানের সঙ্গে বেঁচে থাকাকেই তারা যথেষ্ট মনে করে। তবে তাদের এই সামান্য চাহিদা পূরণে সরকারের যথেষ্ট সদিচ্ছা থাকা প্রয়োজন। অন্যথায় তারা বিগড়ে গেলে সরকার পরিচালনা করাই ক্ষমতাসীনদের জন্য দুরূহ হয়ে ওঠে। এদের চাহিদার প্রধান বিষয় হলো জীবনযাত্রা পরিচালনায় আয়ের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যয়ভার নির্বাহের মতো যৌক্তিক বাজারমূল্য নিশ্চিত, রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায় আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি করে জীবনের নিরাপত্তা বিধান, সমতার ভিত্তিতে নাগরিক অধিকারের প্রতি গুরুত্ব আরোপ, শিক্ষা-স্বাস্থ্য ও মৌলিক অধিকারসমূহ নিশ্চিতকরণ ইত্যাদি।
এর ব্যত্যয় ঘটলে ভোটাধিকারের ক্ষমতাবলে রাষ্ট্র পরিচালনায় ক্ষমতার পালাবদলে ব্যাপক ভূমিকা রাখে। তাই এই শ্রেণিটিকে সকল রাজনৈতিক দলের আস্থায় রাখতে হয়। আসন্ন মধ্যবর্তী নির্বাচন অন্য নির্বাচনের চেয়ে অনেকটা ভিন্ন মাত্রার। বৈশ্বিক পরিস্থিতির কারণে অন্য সব দেশের মতো যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ সমস্যাবলিও অভিন্ন। ঊর্ধ্বমুখী বাজারদরের কারণে সীমিত আয়ের মানুষের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ খুবই দুরূহ হয়ে পড়েছে। তবে সরকার এ ব্যাপারে সচেতন এবং কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের ফলে বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় এখানকার ইনফ্লাশন অনেকটা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে। কিন্তু সরকারের তরফ থেকে তা জনগণকে বোঝানোর তেমন কার্যকর উদ্যোগ অনেকটা ধীরগতির, যা মধ্যবর্তী নির্বাচনে বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে। নীল দলের সমর্থক গোষ্ঠী বেশির ভাগ ইমিগ্র্যান্ট হওয়ার ফলে মিশ্র গাত্র বর্ণ ও নানা ভাষাভাষী হওয়ার কারণে তাদের নিকট নিজ ভাষায় বিষয়াবলি তুলে ধরার জন্য নিজ নিজ ভাষার কমিউনিটি থেকে ওয়ার্কিং গ্রুপ তৈরি করে নির্বাচনী এলাকাভিত্তিক তৃণমূল পর্যায়ে উদ্বুদ্ধ করা গেলে তার সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা অনেক বেশি। নির্বাচনের খুব বেশি সময় বাকি নেই বিধায় কোনোভাবেই কালক্ষেপণ করা সমীচীন নয়। উভয় দলই যেহেতু বিজয়ের ব্যাপারে আশাবাদী, তাই জনসমর্থনের জন্য তাদের ভালো উদ্যোগগুলোকে জনগণের কাছে তুলে ধরা জরুরি। এ কাজে যে দল যত দক্ষতার সঙ্গে জনমত নিজেদের পক্ষে টানতে পারবে, সে দলই বিজয়ের সুফলভোগে সমর্থ হবে।
লেখক : কবি, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও গবেষক। জ্যামাইকা, নিউইয়র্ক।