পরের বাড়ি নিজের ঘর

হুমায়ূন কবির

আমার নতুন পরিচিতদের একজন। মাস কয়েক আগে আইসিইউতে ভর্তি। সামান্য চেষ্টাতেই ভালো হয়ে উঠলো। ডিসচার্সের সময় দেখা গেলো ফলোআপের কেউ নেই। হোমলেস শেল্টারে থাকে। ইন্স্যুরেন্স নেই। নিজের কোনো ডাক্তার নেই। ওষুধ কেনার পয়সাও নেই। এটা তো হবার কথা নয়! মেডিকেইড জাতীয় কোনো না কোনো ইন্স্যুরেন্স পাওয়ার কথা এই হতদরিদ্র লোকটার। কেস ম্যানেজমেন্টের মেয়েরা জানালো ওরা সব ঠিকঠাক করে দিয়েছে আগে অনেকবার। কাজ হয়নি। মাতাল হয়ে পড়ে থাকে। ইন্টারভিউর ডাক আসলেও যায় না। ঘরে এসে কেউ কি ইন্স্যুরেন্স দিয়ে যাবে?
অগত্যা শার্লিকে জানালাম আমাদের লিস্টে ঢুকাতে। পরের সপ্তাহেই অফিসে বসে কথা। একটা কোম্পানিতে দারোয়ানের কাজ করতো। সেবার কাজের জায়গায় হঠাৎ একজন অসুস্থ। সেই শিফটে লোক দরকার। ওভারটাইমের লোভে একটানা বাহাত্তর ঘণ্টা কাজ করে তখন। কাজ সেরে ফেরার পথে ঘুমিয়ে পড়ে গাড়িতে। মারাত্মক অ্যাক্সিডেন্ট। শিরদাঁড়া ভেঙে দীর্ঘদিন হাসপাতালে। ভাগ্য ভালো বেঁচে উঠেছে। এরপর থেকেই বোহেমিয়ান জীবন। পঙ্গু হিসেবে সরকারি একটা ভাতা পায়। মদ-গাঁজা খেয়ে শেষ করে ওটা। থাকা-খাওয়া তো শেল্টারে। সামান্য খরচ। এই ধরনের লোকেরা একটা চক্রাবর্তে থাকে। বৃত্তের বাইরে আসতে পারে না নানা কারণে। কিন্তু এ লোকটার দেখলাম স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার আকুল আগ্রহ। একটু আলাপের পরই মনে হলো, একে সাহায্য করা দরকার। ওষুধপত্রের একটা ব্যবস্থা করা হলো অফিস থেকে। কিন্তু হোমলেস শেল্টার থেকে বের করি কীভাবে? আমাকে আশ্বস্ত করলো।
– ওটার ব্যবস্থা হয়ে যাবে ডাক্তার। চিন্তা করো না।
– কীভাবে হবে?
– এখন বলবো না। হলে পরে বলবো।
ওষুধগুলো পেয়ে খুবই কৃতজ্ঞ আর অনুতপ্ত। জানালো মদ-গাঁজা ছেড়েছে। এবার সিগারেটও ছাড়বে। আমিও বাহবা দিয়ে বিদায় দিলাম। না কথা রাখেনি সে। অসুস্থ হয়ে আবারো হাসপাতালে!
– কার্টিস। এটা কি করলে? আবারো যে সেই?
– না ডাক্তার। বিশ্বাস করো মদ-গাঁজা বাদ দিয়েছি। শুধু সিগারেটটা ছাড়তে পারলাম না। তবে একটা ভালো খবর আছে।
– কী খবর?
– আমার বাড়ি হয়েছে। শেল্টার থেকে বের হয়ে এসেছি।
– তাই নাকি? কীভাবে হলো, বলো তো?
উত্তর শুনে অবাক হলাম।
কার্টিসের সবেচেয়ে কাছের বন্ধুটির বিরুদ্ধে মামলার আপিল চলছিলো। আপিলের রায় হলো সেদিন। সাত বছরের জেল। বন্ধুটির বউ মারা গেছে। দশ বছরের একটা ছেলে আছে তাদের। কার্টিসের হাতে তুলে দিয়ে গেছে ছেলেকে। শর্ত হলোÑ কার্টিস তার বাড়িতে থাকবে, আর ছেলেটার দায়িত্ব নেবে।
– খরচাপাতি?
– এখন তো শেল্টারের খরচ নেই। মদ-গাঁজার খরচও নেই। তাই যা ভাতা পাই, তাতেই চলবে কায়ক্লেশে। আর সেদিন স্যোসাল সিকিউরিটি অফিসে ইন্টারভিউ দিয়ে এসেছি। ইন্স্যুরেন্সটা ফেরত পাবো। ওষুধের ব্যবস্থাটাও হয়ে যাবে। দেখলে তো ডাক্তার, আমি এবার ঠিক পথেই যাচ্ছি!
-তা তো দেখলাম। কিন্তু তোমাদের বিশ্বাস হয় না। একবার নেশা করছো তো ধরা পড়ে গেছো!
– সেটা হবে না। এখন আমার একটা ছেলে আছে। বুঝলে না?
কার্টিসকে হঠাৎ দায়িত্ববান মনে হলো। অন্যরকম মানুষ। আগেরবারের মতো না একদম।
– তোমার গার্লফ্রেন্ড থাকে তোমার সঙ্গে?
– না, সে মার সঙ্গে থাকে। বন্ধু শর্ত দিয়ে গেছে, তার বাড়িতে গার্লফেন্ড নিয়ে থাকতে পারবো না।
– মানছো ওটা?
– কি যে বলো। বন্ধুকে কথা দিয়েছি। না মেনে উপায় আছে? লোরেটাও আমাকে বুঝিয়েছে। সাত বছর এইভাবে কাটিয়ে দেবো। নিজেরা ভালো মানুষ হবো। ছেলেটাকে মানুষ করবো। এরপর দুজনে ঘর বাঁধবো। মায়ের বাড়িটা তো এক সময় সেই পাবে।
মনে হলো কার্টিস স্বপ্ন দেখছে। এই সময় মানুষের চেহারায় একটা দ্যুতি চলে আসে! কার্টিসের চেহারায় এখন সেই আলো! ভেবেছিলাম জিজ্ঞেস করবো, বন্ধুটি কোন অপরাধে জেলে গেছে? আর কার্টিসের মতো একজনের কাছেইবা ছেলেকে দিয়ে গেলো কেনো? আত্মীয়-স্বজন কেউ কি ছিলো না? আজ আর সেটি করা হলো না। পরের ভিজিটের জন্য জমা রাখলাম।
ভিজিট শেষে কার্টিস দরজা দিয়ে বের হচ্ছে আর আমি দেখছি। মনে হলো কি এক অদ্ভুত বলয়। বাড়ি ছেড়ে জেলে ঢুকলো বন্ধুটি। আর শেল্টার ছেড়ে বাড়িতে ঢুকলো কার্টিস। সাত বছর জেলবাসের সময়। দুজনরাই আত্মশুদ্ধির সময়। কিশোর ছেলেটি তরুণ হবে ততোদিনে। নিজেই নিজের ভালোমন্দ বুঝবে। কার্টিসের আর দায়ভার থাকবে না। বন্ধুটিও বের হয়ে আসবে জেল থেকে। একসময় সবাই মুক্ত হবে, যার যার মতো করে।
শিকারী শিল্পী
মহিলাটি আমার রোগী বেশ অনেক বছর যাবত। অনেক বলে-কয়ে স্বামীটিকে নিয়ে এসেছে এবার। আমাকে আগেই বলেছে, একরোখা স্বামী তার। ডাক্তারদের কাছে যেতে চায় না। যে কোনো কারণেই হোক ডাক্তারদের পছন্দ করে না।
– তার নাক ডাকায় বিছানা কাঁপে। বললে বিশ্বাস করে না। তোমার কাছে আসতে রাজি হয়েছে। এই সুযোগে যদি অন্য ব্যাপারেও একটু বুঝিয়ে দাও। আমার ধারণা তোমার কথা শুনবে।
ভেবিছলাম একরোখা ভয়ঙ্কর টাইপের কাউকে দেখবো। চেহারা সুরতে কিছুটা ছাপ থাকলেও কথাবার্তায় দেখলাম খুবই অমায়িক।
আমি ওদের রুমে ঢুকেই দেখি লোকটা একটা কাগজে ছবি আঁকছে। বউ পরিচয় করিয়ে দিলো। লোকটার তেমন ভাবান্তর নেই। একটু হাসি দিয়েই আবার ছবিতে মনোযোগ। বউটা দেখলাম খানিকটা অপ্রস্তুত।
– ডাক্তার। কিছু মনে করো না। সে কিন্তু কানে কম শুনে। ডান কানে আগে একদম শুনতো না। এখন বাম কানেও শুনে না। তাই কথাবার্তা এড়িয়ে চলে।
– এড়ালে কীভাবে হবে? আমার তো জানতে হবে বিষয়-আশয়।
– সেটা আমি বলে দেবো।
আমার মনে হলো এতো কম বয়সে লোকটার শ্রুতি নষ্ট হওয়ার কি কারণ? দেখি না একটু চেষ্টা করে।
কাছে চেয়ার টেনে বসলাম। বাম কানের কাছে মুখ নিয়ে কথা শুরু করলাম। দেখা গেলো কাজ চালানোর মতো কথা শোনে ঠিকই। ভাবলাম এই কানের সমস্যাটা নিয়েই প্রথম প্রশ্নটা করি। হাল্কা কথা দিয়েই শুরু হলো।
– তোমার বউয়ের ধারণা তুমি কানে একদম শোনে না। বউয়ের কথা বোঝো কীভাবে?
– ওটা সহজ হিসাব। আমার চোখ তো থাকে ওর চেহারায়। ঠোঁট নাড়া দেখেই বুঝে ফেলি।
– বউ সায় দিলো। দীর্ঘদিনের অভ্যাসে লোকটা এখন ‘লিপ রিডিং’-এ পারদর্শী। এভাবেই চলছে।
– তো কানে যে শোনে না, সেটা কি জন্ম থেকেই?
– না না। টের পেয়েছি টিনএজ থেকে। তবে লোকজন ধরতে পেরেছে বছর দশেক আগে। আর আড়াল করা যায়নি।
– শুরুটা হলো কীভাবে?
উত্তরে স্বামী-স্ত্রী দুজনের মিলে যা বললো, তার সংক্ষেপে এ গল্প।
ছোট বেলার বাউ-ুলে ছিলো। অল্প বয়সেই শিকারের নেশা পেয়ে বসে। হরিণ শিকার দিয়ে শুরু। এরপর সব ধরনের শিকার। শেষ নেশাটা হলো পাখি শিকার। খাঁচা থেকে ছেড়ে দেয়া উড়ন্ত কবুতরকে গুলি করে নামাতো। এটা বেআইনি খেলা এখন। তবে কিছুদিন আগে পর্যন্ত লুকিয়ে চলতো বেশ। শিকারের খুব ভালো হাত তার। শার্প শুটার হিসেবে নাম ছড়িয়ে গেলো। সবাই পরামর্শ দিলো শুটিং কম্পিটিশনে যেতে। তা যাওয়া যায়। কিন্তু নেশা তো পাখি শিকারের। শিকার ছাড়া গুলি করে কি মজা? এর সমাধানও হলো। স্কিট শুটিংয়ে যাও। ওতে মাটির পাখির ঝাঁককে ছুঁড়ে দেয়া হয় আকাশে। গুলি করে নামাও। স্পোর্টসও হলো, শিকারের মজাটাও পেলে। শুরু হলো স্কিটিং। নিজের এলাকা ছেড়ে অন্য রাজ্য থেকেও পুরস্কার আর মেডেল নিয়ে আসলো অনেক।
সেই টিনএজ থেকেই বন্দুক চালিয়ে আসছে। কানে কিছু লাগাতো না তখন। গ্রামের ছেলে। কেউ কিছু বলতো না। পরে স্পোর্টসে গিয়ে লাগিয়েছে। কিন্তু ততোদিনে ডান কানটা একদম নেই।
কানের সমস্যার শানে নজুল বোঝা গেলো। কিন্তু এই গেছো প্রকৃতির লোকটা ছবি আঁকা শিখলো কিভাবে?
– ওটা হয়েছে হরিণ শিকারের সময়। একটানা বসে থাকতে হতো মাঁচায়। বসে বসে বনের শোভা দেখতাম, আর আঁকতাম। আমি নেচারের ছবিই আঁকি বেশি। নেচার ভালোবাসি খুব।
– কোন মিডিয়াম? জলরং?
– স্কেচই করি বেশি। চারকল।
তার আঁকা ছবি দেখলাম। আমার জানালার বাইরের দৃশ্যটা এঁকেছে। বলপয়েন্ট পেন দিয়ে আঁকা স্কেচ। তেমন আহামরি কিছু নয়। তবুও মনে হলো এই লোকটার শিল্পী মনটার সঙ্গে তার রক্ত তাঁতানো শিকারের কি বিচিত্র অমিল! শুধু খেলার নামে উড়ন্ত কবুতরকে গুলি করে নামিয়ে আনে যে লোক, সে কীভাবে প্রকৃতি প্রেমিক হয়? বিষয়টা ভাবাচ্ছে আমাকে। মানুষের ভেতরে অগোচরেই কি একটা খেলার নেশা থাকে? যার সঙ্গে তাঁর অন্য মনের মিল নেই?
প্রথিতযশা চিকিৎসক ও মননশীল সাহিত্যিক, টেনেসি।