পর্দার আড়ালে কূটনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ

নূরুল ইসলাম : দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলো নানা বার্তা দিচ্ছে বাংলাদেশকে। সরকার ও বিশেষ ব্যক্তিদের সঙ্গে সিরিজ বৈঠক করছে প্রভাবশালী দেশগুলো। দেশের অভ্যন্তরীণ ইস্যুতে পর্দার আড়ালে কূটনীতিতে চলছে স্নায়ুযুদ্ধ। সরকারি দল আওয়ামী
লীগের প্রত্যাশা কূটনীতিতে ভুল-বোঝাবুঝির অবসান হবে। ক্ষমতাপ্রত্যাশী বিএনপির দাবি, নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্বের প্রভাবশালী দেশগুলোর সঙ্গে সরকারের সম্পর্ক নিম্নগামী হচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, চীন, ভারত, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়াসহ আরও অনেক দেশের চোখ এখন বাংলাদেশের দিকে। ইতিমধ্যে ঢাকা সফর করে গেছেন প্রভাবশালী রাষ্ট্রগুলোর গুরুত্বপূর্ণ কূটনীতিকেরা। সম্প্রতি ক্ষমতাসীন দল থেকে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, চলতি বছরের শেষ দিকে জাতীয় নির্বাচন হয়ে যেতে পারে। তাই কূটনৈতিক অঙ্গনেও এখন চলছে নির্বাচনী হাওয়া। গত ১৫ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্র, ভারত ও দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছে সরকার। একই দিন রাতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সিনিয়র উপদেষ্টা ডেরেক শোলে বাংলাদেশের কয়েকজন সিনিয়র সাংবাদিকের সঙ্গে বৈঠক করে দেশের মানবাধিকার, রাজনীতি ও অর্থনীতির বিভিন্ন দিক সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন, গণমাধ্যম ছাড়াও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে এ নিয়ে চলছে বিস্তর আলোচনা। সচেতন মহলের অনেকের মধ্যে কৌতূহল সৃষ্টি হয়েছে আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে শীর্ষ দেশগুলোর পক্ষ থেকে কী বার্তা আসছে, তা নিয়ে। নির্বাচন ইস্যুতে কোন পথে এগোচ্ছে দেশ? নির্বাচন বর্তমান সরকারের অধীনে হবে, নাকি নির্দলীয় সরকারের অধীনে হবে?
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়া-বিষয়ক সহকারী মন্ত্রী ডোনাল্ড লু গত জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময়ে ঢাকা সফর করেন। তার সফরের আগের রাতে আকস্মিকভাবে চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী চিন গ্যাং এক ঘণ্টা ঢাকা সফর করেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নীতি উপদেষ্টা ডেরেক এইচ শোলের ১৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা সফরের তারিখ নির্ধারিত ছিল। তার ঢাকা সফরের দিনই হঠাৎ করেই দুই দিনের রাষ্ট্রীয় সফরে ঢাকায় আসেন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন খাতরা। বাংলাদেশের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তারকারী প্রভাবশালী দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ দুই ব্যক্তির একই সঙ্গে ঢাকা সফর নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে কৌতূহলের সৃষ্টি হয়েছে। এমন কী রহস্যজনক অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে যে দুই দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিকে একই দিনে ঢাকা সফর করতে হলো? কী বার্তা দিচ্ছেন তারা?
রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা মনে করছেন, ক্ষমতাসীন সরকার এবার দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন কীভাবে করবে, এটি বিদেশিরা এবার আগেই জানতে চাচ্ছেন। এটি এখন স্পষ্ট, এবার জাতীয় নির্বাচনে বড় কূটনৈতিক প্রভাব থাকবে। এতে দেশের লাভ-ক্ষতি এখন থেকেই হিসাব করছে একটি মহল। অনেকে এ-ও মনে করছেন, দেশের নিজস্ব বিষয়গুলো নিয়ে পর্দার আড়ালে কূটনীতিতে স্নায়ুযুদ্ধ চলছে।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর নীতি উপদেষ্টা ডেরেক এইচ শোলে ও ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন খাতরা ১৫ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে পৃথক বৈঠক করেছেন। বৈঠকে ডেরেক শোলে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কী বিষয়ে আলোচনা করেছেন, তা জানা যায়নি। তবে ডেরেক শোলের সঙ্গে বৈঠকের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স্পষ্টই বলেছেন, নির্বাচনে জনগণ আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে আমরা দেশ পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করব। কখনো ভোট কারচুপির মাধ্যমে ক্ষমতায় আসতে চাই না। আমি সারা জীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই করেছি। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে ভারতের পররাষ্ট্রসচিব বিনয় মোহন খাতরার আলোচনার বিষয় প্রকাশ করা হয়েছে। বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন প্রধানমন্ত্রীর স্পিচ রাইটার মো. নজরুল ইসলাম। তিনি জানান, প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে ভারতীয় পররাষ্ট্রসচিব বলেছেন, শেখ হাসিনা ও তার নেতৃত্বের প্রতি আমাদের (ভারত) পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অগ্রগতিসহ সব ধরনের উন্নয়ন প্রচেষ্টায় প্রতিবেশী দেশ হিসেবে ভারত বাংলাদেশের পাশে থাকবে।
এ বিষয়ে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুুরী বলেন, তারা (মার্কিন প্রতিনিধিদল) পরিষ্কার বার্তা দিয়েছে, দেশে গণতন্ত্র নিম্নগামী থাকবে, নিচের দিকে চলে যাবে, তাদের (সরকার) সঙ্গে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কও নিম্নগামী হবে, সহযোগিতা কমে আসবে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন বলেন, গত সাত মাসে আমেরিকার উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিরা একের পর এক দেশে এসে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য কাজ করেছেন। তাদের দেশে গিয়ে নেতাদের সঙ্গে আলাপ করার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন। এটি সম্ভব হয়েছে প্রধানমন্ত্রীর দৃঢ়তার জন্য। ভুল-বোঝাবুঝি সব দূর করে ভালো সম্পর্ক তৈরি করা উভয় দেশের চাওয়া। তিনি আরো বলেন, কূটনীতিকেরা বাংলাদেশকে তাদের জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ দেশ মনে করেন। কারণ, বাংলাদেশে বিভিন্ন সুযোগ রয়েছে। কোভিডের সময় বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় আয়ের দিক থেকে প্রথম ছিল। দেশে নতুন নতুন যে সম্ভাবনা আছে, সেসবের সঙ্গে তারা সম্পৃক্ত হতে চান।
আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, আগামী নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য, সুষ্ঠু, অবাধ হবে। পাশাপাশি নির্বাচন কমিশন কর্তৃত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে এবং নির্বাচন কমিশনকে সরকার সব ধরনের সহযোগিতা করবে। আমরা আগামী নির্বাচন সামনে রেখে প্রস্তুতি নিচ্ছি। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বাংলাদেশে অংশগ্রহণমূলক জাতীয় সংসদ নির্বাচন দেখতে চায়। ইইউর সাতটি দেশের সঙ্গে কথা বলেছি। তারা চায় আগামী নির্বাচনে বিএনপিসহ সব দল অংশগ্রহণ করবে।
সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, সার্বিকভাবে বলতে গেলে বিশ্বে একটি সংকট চলছে। এই সময়ে সব দেশই চাইছে ব্যবসা-বাণিজ্য ও সহযোগিতার উন্নয়ন ঘটাতে। সেটি ওইসব দেশের জন্য যেমন প্রয়োজন, আমাদের দেশের জন্যও প্রয়োজন। ফলে এই সফরগুলো কাকতালীয়ভাবে একই সঙ্গে হলেও আমার মনে হয়, সবার আলাদা আলাদা অ্যাজেন্ডা আছে। তারা মানবাধিকার, গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা-এসব বিষয় নিয়ে কথা বলবেন। ইন্দো-প্যাসিফিক ইস্যুও আছে।