পলাশ ফোটার দিন

কমলকলি

ফাল্গুন মাস পড়ে গেছে। মাসের প্রথম সপ্তাহ। শীতের আমেজ ছড়িয়ে আছে এখনো। খানিকটা দ্রুত পায়েই খালেদা বাড়ির পথ ধরেছে। গিয়েছিল, তার বন্ধুর বাড়িতে, ফিরতে দেরিই হয়ে গেল। মা নিশ্চয়ই খুব ভাবনায় পড়ে গেছেন। রোকেয়া যে ভীষণ নাছোড় বান্দা। দুপুরের খাওয়াটা না খাইয়েই ছাড়লো না। খালাম্মাও খুব অনুরোধ করেছিলেন।
বাড়ির কাছাকাছি আসতেই কানে আসল কে একজন তাকে ডাক দিয়েছে। খুবই পরিচিত কণ্ঠস্বর। ‘এই খালেদা, দাঁড়াও, শোনো। হন হন করে কোথা থেকে আসছো ? দাঁড়াও-।’
ফিরে তাকায় খালেদা। বেশ খানিকটা দূর থেকেই হাত উঁচু করে ইশারায় থামতে বলছে একজন সুদর্শন যুবক। কাছে এগিয়ে আসে।
‘আনোয়ার ভাই, আপনি। খালেদা খানিকটা বিস্মিত আবার খুশিও।’ কবে এসেছেন। আপনার ক্লাস হচ্ছে না।’
‘হচ্ছে তো আগামীকালই ফিরে যাবো। এসেছিলাম মাকে দেখতে।’ কেন চাচীমার আবার কি হলো?
আর বলো না। এই মফস্বল শহর থেকে ঢাকা শহরে ডাকে একটা চিঠি যেতে আসতে সময় লাগে চার পাঁচদিন । তাই অনাবশ্যক বিড়ম্বনা। মায়ের তেমন কিছুই হয়নি। বয়স হয়েছে তো, আব্বাও নেই, তাই মায়ের মনটা নরম হয়ে গেছে। বড় ভাই ভাবী দেখাশোনা করেন। বড়বুবুও এই শহরেই আছেন। হঠাৎ কেন জানিনে, মায়ের খুব ইচ্ছে হয়েছিল আমাকে দেখতে। তাই এসেছিলাম।
‘ও তাই বলেন, আমি তো ভড়কেই গিয়েছিলাম। অনেকদিন আপনাদের বাড়িতে যাওয়া হয় না।’ খানিকটা সঙ্কোচের সাথেই বলল খালেদা।
‘যেও একসময়। তা যাই হোক, তোমার পড়াশোনা কেমন চলছে। সামনেই তো তোমার এইছএসসি ফাইনাল, আমার যদ্দূর মনে আছে।’
হেসে ফেলেছে খালেদা। তারপর ওড়নার খুঁটে আঙুল পেঁচিয়ে বলল, আনোয়ার ভাই, আপনার স্মরণশক্তি খুবই ভালো। হ্যাঁ, এইচএসসি ফাইনাল সামনেই।
মনে থাকবে না কেন? পাড়া প্রতিবেশী তোমরা। চোখের সামনেই বড় হয়ে উঠেছ। লেখাপড়া করছো। বিএএমএ পাশ করে তারপর কি করবে চাকরি? ‘চাকরি করবো, আনোয়ার ভাই, কলেজে পড়াবো। বাঃ বেশ তো, তারপর মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য এনে বলল, আমারও এম এ ফাইনাল, কিন্তু ওদিকে যা হচ্ছে।
‘কি হয়েছে, আনোয়ার ভাই?’
‘পরে না হয় বলব। তুমি বাড়িতে যাও, তোমার দেরি হয়ে যাচ্ছে।’
‘হবে না, আপনি বলেন।
‘আর বলো না-। দুজনে কথা বলতে বলতে এগিয়ে যাচ্ছে।’
প্রথম ফাল্গুনের মিষ্টি বিকেল। ঝিকমিক করছে রোদের আলো। খানিকটা নিস্তেজ হয়ে এসেছে রোদের স্পর্শটুকু। ‘পাকিস্তান সরকার উর্দুকে করতে চাইছে রাষ্ট্রভাষা। আমরা পূর্ব বাংলার জনগণ তা মানতে রাজি নই। বাংলাই হবে আমাদের মাতৃভাষা ও রাষ্ট্রভাষা। দরকার হলে ভাষার জন্য আমার জীবন দিয়ে দেবো। উত্তেজিত হয়ে উঠেছে আনোয়ার। থর থর করে কেঁপে উঠেছে। ‘হ্যাঁ, শুনেছি আমরাও। এখন কি হবে? উদ্বেগের সাথে আনোয়ারের দিকে তাকিয়েছে খালেদা। এতই সোজা, পাকিস্তান সরকার বললেই হলো? না, এত সোজা নয়। একুশে ফেব্রুয়ারিতে বিরাট মিছিল বার হবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, রাষ্ট্র ভাষা বাংলার দাবিতে।’
তাতে কি কাজ হবে, সরকার মানবে তো?
মানবে না মানে, মানতেই হবে। মুখের চোয়াল দুটি শক্ত হয়ে উঠেছে আনোয়ারের, বাংলাই হবে এই দেশের রাষ্ট্রভাষা, আমাদের মাতৃভাষা। জীবন থাকতে উর্দুকে আমরা রাষ্ট্রভাষা বলে মেনে নেব না। ‘তাই যেন হয়, অস্ফুটে বলল ওঠে খালেদা।’
‘এই দেখ, একদম তোমাদের বাড়ির কাছে এসে গেছি। তা যাও, খালাম্মা, বাড়ির সবাই আবার চিন্তা করবে।’
ভাই চলেন, চা খেয়ে যাবেন। বাড়িতে সবাই আছে এখন। বড় ভাই, আব্বা, মা, ভাবীÑ।
‘না, খালেদা আজ যাই। মায়ের সাথে বাকি সময়টা কাটাই। পরের বার যখন আসবো, তখন শুধু চা নয়, পেটপুরে ভাত খাবো একবেলা। আর শোন, পরীক্ষা যেন ভালো হয় তোমার। পড়াশোনা ঠিকমতো করো।’
‘ঠিক আছে ভাই।’
আমি তা হলে যাই, মা আবার ভাবনা করবেন। কেন যেন মা, আমাকে নিয়ে বড্ড ভাবনায় পড়েছে।
‘মায়েরা সবসময়ই ভাবেন।’
‘তাই বোধ হয়, তাই হবে।’
বাড়ির বাইরে বাঁশের গেটটা খোলাই আছে। কু-ুলতায় ছেয়ে আছে বাঁশের বেড়া। হঠাৎ ফিরে দাঁড়িয়েছে খালেদা, আনোয়ার ভাই, দেখেন, আনোয়ারও ফিরে যেতে উদ্যত হয়েছে। খালেদার ডাকে ফিরে তাকায়, ‘কি হলো?’
ডান হাতটা তুলে দূরে দেখায় খালেদা।
দেবদারু পলাশ, কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো গলাগলি করে দাঁড়িয়ে আছে বাড়ি থেকে বেশ খানিকটা দূরে। পলাশ গাছ আধফোটা লাল কলিতে ভরে আছে। কৃষ্ণচূড়া গাছেও এসেছে অজস্র কলি। ঈষৎ শীতল হাওয়া বয়ে গিয়েছে। অপরূপ লাগছে।
তাই তো বিস্মিত হয়েছে আনোয়ার। দেখো, শিগগিরই পলাশ ফুলগুলো ফুটে যাবে। আসলে এখন তো পলাশ ফোটারই দিন।
সে রাতে অনেকক্ষণ মায়ের সাথে বসে গল্প করলো আনোয়ার।
‘মা, আমাকে নিয়ে তুমি এত বেশি ভাবো কেন বলতো? জানি নে বাপ! তোকে দেখতে খুব মন চাইলো, তাই তো তোকে চিঠি লিখেছিলাম বাপ! সেই এলি, সাতটা দিন কোথা দিয়ে চলে গেল? আর কয়েকটা দিন থাক না বাবা।’
‘ও মা, আমার ফাইনালের আর খুব বেশি দেরি নেই। ক্লাসগুলো বাদ যাচ্ছে যে, আবার আসবো, মা, তুমি শুধু দোয়া করো।’
‘তাড়াতাড়ি আসবি তো বাবা?’
‘আসবো মা, আসবো। ভালোভাবে পাশ করলে তোমার দোয়ায় ভালো চাকরি পাবো মা।’
‘তোর চাকরি হলেই তোর বিয়ে দেবো বাবা।’
তাই! তা দিও, কেমন বউ তোমার পছন্দ মা?
‘তোর যেমন পছন্দ, তেমন বউ-ই আমারও পছন্দ বাবা।’ আনোয়ার হা হা করে হেসে উঠেছে। সেই হাসির জলসায় এসে যোগ দিয়েছে ভাই ভাবীও। ভাবী একগাল হেসে বলল, আমরাই খুঁজে দেব। আনোয়ারের পছন্দের তো কেউ নেই। তাই না? সত্যিই নেই ভাবী, কেউই নেই, ওসব খোঁজার সময়ও নেইÑ হাসছে আনোয়ার।
‘মা, তুমি এখন শুয়ে পড়ো। আগামীকাল সকালেই ঢাকায় রওনা দেব। ভোরবেলাই উঠতে হবে। আর তুমিও তো উঠে পড়বে; আমি জানি বললেও শুয়ে থাকবে না।’
ম্লান মুখে মা হাসি ফুটিয়ে বড় বৌকে বলেছেন, ও বৌমা, মোয়ামুড়কির কৌটো ঠিক করেছ?
‘ও মা, আমি আর ছোট নই। মোড়ামুড়ি দিতে হবে না। ও ভাবী, ঝামেলা করো না।’
‘বেশ তো, মা দিতে চাইছেন। নিয়ে যাও। সময় করে খেও। মাঝে মাঝে এগুলো চায়ের সাথে খেতে ভালোই লাগে।’
টানা বারান্দা দিয়ে নিজের ঘরে যেতে যেতে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে আনোয়ার।
শুক্লা চতুর্দশী চলছে। জোৎস্না তার পেলব ছোঁয়া ছড়িয়ে দিয়েছে সমস্ত ধরিত্রীর বুকে। মুগ্ধ নয়নে সেদিকে তাকিয়ে থাকে আনোয়ার। তার এই ক্ষুদ্র জীবনে এ রকম রাত সে কখনো দেখেনি যেন। কোথা দিয়ে যেন দুটো তিনটে দিন চলে গেল। সেদিন বিকেলে ছোট ভাইটিকে সাথে নিয়ে আনোয়ারদের বাড়িতে বেড়াতে এসেছে খালেদা।
ভাবী তো অবাক। চাচীও অবাক হয়ে গেছেন। ওমা, খালেদা, আমাদের কথা বুঝি এত দিনে মনে পড়লো?
‘বিশ্বাস করো ভাবী, কোথা দিয়ে যে সময় চলে যায়। খুব মনে করি ভাবী, আসা হয় না। তোমরাও তো যাও না আমাদের ওখানে।
আনোয়ারের মা বারান্দায় বসেছিলেন। আয় মা, বোস এখানে। শাহাদত তো লম্বা হয়ে গেছে বেশ।
‘হ্যাঁ, চাচী, এবার ক্লাস এইটে উঠেছে। সেদিন আনোয়ার ভাইয়ের সাথে দেখা হলো। বলেছিলাম, আসবো আপনাদের বাড়িতে।’
‘হ্যাঁ, খালেদা, আনোয়ারের ক্লাশ চলছে তো, তাই তড়িঘড়ি চলে গেছে। বড় ভাবী, চা বিস্কিট আর মুড়ি মাখিয়ে এনেছে। আয় খালেদা, চা খাই। শাহাদত, বিস্কুট নাও।’
ফাল্গুনের আট তারিখ ছিল সেদিন। ফেব্রুয়ারি মাসের একুশ তারিখ। দুঃসংবাদ দ্রুতই এসে পৌঁছেছিল এই মফস্বল শহরেও।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বড় বড় প্ল্যাকার্ড, ফেস্টুন নিয়ে ছাত্রছাত্রীদের বিশাল মিছিল বার হয়েছিল সেদিন। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠেছিল মিছিলের অগ্রসরমান মানুষগুলো। কিন্তু সরকারি পুলিশের ছোড়া বুলেটে ঝাঁঝরা হয়ে গিয়েছে বেশ ক’টি তাজা প্রাণ। কয়েকজন ছাত্রের সাথে আনোয়ারেরও জীবন লীলার ইতি ঘটেছিল ।
ফাল্গুন মাস শেষ হয়ে আসছে। কলেজ থেকে সেদিন বাড়িতে ফিরছে খালেদা। বাড়ি থেকে মাইল খানেক দূরে কলেজ। হেঁটেই আসা-যাওয়া করে। হাঁটতে হাঁটতে চোখ পড়েছে দূরে। যেখানে দেবদারু পলাশ কৃষ্ণচূড়া গাছগুলো দাঁড়িয়ে আছে পাশাপাশি। মাঝে মধ্যে দু-চারটে নারকেল গাছও উঁকি দিয়ে গেছে।
আশ্চর্য, পলাশ ফুলগুলো ফুটে গেছে। নির্নিমেষ দৃষ্টিতে সেদিকে তাকিয়ে থাকে খালেদা। অপূর্ব রক্তিম আভায় যেন রাঙিয়ে আছে পলাশ গাছ। রাঙিয়ে দিয়েছে তার আশপাশের পরিবেশেকে যেন রক্তের রঙ ঝরছে সর্বত্র। বুঝি বাংলা ভাষার জন্য জীবন দেয়া সে সকল শহীদের রক্তে ভিজে লাল হয়ে আছে।
সেদিন খুব খুশি হয়েছিল আনোয়ার আধফোটা পলাশের কলিগুলো দেখে। বলেছিল, খালেদা, ফুলগুলো শিগগিরই ফুটে যাবে। এখন তো পলাশ ফোটারই দিন।
আনমনে হাঁটছে খালেদা। বাড়ির কাছাকাছি এসে গেছে। ওড়নায় চোখ মুছেছে।
হিউস্টন।