ড. এবিএম এনায়েত হোসেন :
মৌলভী সাহেবের বংশ ঠিকই বাড়তে শুরু করেছে। পর পর দু’দুটো পুত্র সন্তান এসেছে আমাদের পরিবারে। বাবা দুপুর বেলায় খেতে বসে আজকাল প্রায়ই সেজ ভাবির প্রসঙ্গ টানছেন। কারণ, মৌলভী সাহেব বাজারের হিসাব-কিতাব ঠিকমত মিলাতে পারছিলেন না। তাছাড়া বাবা বেশি বিরক্তি প্রকাশ করা শুরু করলেন, যখন থেকে মা টের পেলেন যে সেজ ভাবির বিড়ি খাওয়ার অভ্যাস আছে। খবরটি তিনি বাবার কানেও দিলেন। আর এই বিড়ি কেনার অর্থ যোগাড় করতে গিয়েই মৌলভী সাহেব বাজারের হিসাব মিলাতে পারেন না! এখানেই এর শেষ নয়। পরে একদিন এটাও ধরা পড়লো যে, নেশার টাকা যোগাড় করতে সেজ ভাবি ঘরের চাল পর্যন্ত মাকে লুকিয়ে বিক্রি করছেন। বাবা এ কথা শোনার পর থেকে প্রায়ই তার ভবিষ্যৎ বাণীর পুনরাবৃত্তি করছেন। বলেনÑ আমি বলেছিলাম না কুদুর মা! এই বুদোর বংশই এ বাড়ির সব মান-সম্মান সমূলে বিনষ্ট করবে! এখন দেখলে তো?
মা তখন নিশ্চুপ নিরুপায়! গাছ কাটলে মাথায় পড়ে! নিজের পেটের সন্তান, তাও আবার সবার মধ্যে সবচাইতে সিধা এবং বোকা। রোজগার করে খাবার মত সামর্থ্যও নেই। আলাদা সংসার করে দিলেও তো সমস্যা মিটবে না। ও চলবে কি করে? অনেকটা বিষ খেয়ে বিষ হজম করার অবস্থা মা-বাবার!
ছেলেবেলায় আমরা সুযোগ পেলেই এক বয়েসী সবাই মিলে তছলুদের দালানের পশ্চিমে এবং ‘মুরিদ’ সরদার-এর ঘরের মাঝখানে অবস্থিত একটা গলি পথে কাঁচের মার্বেল দিয়ে খেলতাম। কখনও কখনও ডাংগুলিও খেলেছি। তবে কে একজনের চোখে গুঁটি লেগে চোখ যায় যায় অবস্থা শুনে আর এ খেলায় যোগ দিতাম না!
প্রায়ই দেখতাম তছলুর বাপ ময়লা, তেলসিঁটে একখানা ধুতি পরে কখনও খালি গায়ে, কখনও বা একটা ময়লা ফতুয়া গায়ে দিয়ে দালানের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে অনর্গল ইংরেজিতে কিসব বলে যাচ্ছে! সবাই বলাবলি করতোÑ মাথা খারাপ তো, তাই!
অনেক ছেলেমেয়েই তাঁকে দেখে দূর দিয়ে চলে যেতো। দুষ্টু ছেলেরা পাগল খেপানোর জন্য ছোট-খাট দু’একটা ইট-পাটকেলও ছুঁড়ে মারতো। কিন্তু তাই বলে উনি কোনদিনও আমার সাথে কোন খারাপ ব্যবহার করেননি। দেখা হলেই ইশারায় আমাকে কাছে ডাকতেন। তারপর বলতেনÑ ছোট বেয়াই! এক ছিলিম তামাক হবে না কি?
আমি জানতাম উনার বালাখানার সুগন্ধি তামাকের প্রতি বেশ নেশা আছে। আমি বলতামÑ আসেন আমার সাথে।
উনি এসে আমাদের বড়ঘরের কোণায় দাঁড়িয়ে থাকতেন। আসলে বাবার ভয়ে সামনে আসতেন না। আমি লুকিয়ে হাতে করে সামান্য কালো রঙের সুগন্ধি তামাক দিয়ে দিলেই উনি খুশি হয়ে চলে যেতেন।
আবার যেদিন নেশায় পেতো, অথচ আমাকে দেখতে পাচ্ছেন না, তখন সোজা এসো আমাদের খোপের ঘরের (বড় টালির ঘরের পূর্ব পাশে একটা লম্বা বারান্দাকে বাবা আমাদের জন্য পড়ার ঘর বানিয়েছিলেন) বেড়ায় টোকা মারতে থাকতেন। বাবা বারান্দায় বসা থাকলে কখনও আসতেন না। অন্যথায় ভিতর বাড়িতে ঢোকার বেকি বেড়ার কাছ থেকেই আমাকে ডাকাডাকি করতেন।
তছলুর বাবার বয়স তখন প্রায় পঞ্চাশের কাছে হবে হয়তো। বেশ আট-সাঁট দেহ, গায়ের রঙ কিছুটা ময়লা। মাথায় বেশ বড় একটা টাক। তবে আশেপাশে কোঁকড়ানো চুলগুলো তখনও কাঁচা-পাকা। দিনের মধ্যে বেশ কয়েকবার দেখতাম মসজিদের পাশেই যে টিউবওয়েল, তা চেপে অনবরত দু’পায়ে পানি ঢালছেন। কখনও বা হাত-পা এবং মাথায় ঠাণ্ডা পানি দিচ্ছেন। আমার এ বয়সে এমনটি করার পেছনে তেমন কোন কারণ খুঁজে পাইনি। মনে হতো এটা হয়তো বা উনার মাথা খারাপের জন্যই! কিন্তু পরে বড় হয়ে, বিশেষ করে নিজের জীবনের ক্রান্তিলগ্নে এসে, বুঝতে পারছি কেন তছলুর বাপ ওভাবে হাতে-পায়ে ঠান্ডা পানি ঢালতেন সারাবছর, কী শীত বা কী গ্রীষ্মে! যাদের পিত্ত গরম, তারাই বুঝতে পারবে হাত-পা জ্বালার কী কষ্ট!
তছলুর একটা ছোট বোন ছিল। নাম ‘চিনি’। বয়সে আমার থেকে দু’এক বছরের হয়তো বড়ই হবে। তবে আমরা একই সাথে খেলতাম। আমি ওকে ডাকতাম চিনিখালা বলে, আর ও ডাকতো ‘ছোট মামা’ বা কখনও ‘ছোটকা’ মামা বলে। লাটিম গাছের গোলগাল দলগুলো একটু বড় হলেই তা পেড়ে লাটিমের মাঝখানটায় একটা শলার (নারকেলের পতা থেকে তৈরি করা ঝাড়ু বা ঝাঁটা থেকে ভেঙে নিতাম) কাঠি ঢুকিয়ে দু’হাতের তালু দিয়ে পাক খাইয়ে পালিশ করা মাটিতে কিংবা শানবাঁধানো মেঝের উপর ছেড়ে দিতাম। লাটিমটা ঘুরতে থাকতো অবিরত। এদিক-ওদিক অনেকক্ষণ ঘুরে শেষে কাঁত হয়ে পড়ে যেতো।
আমরা যার যার লাটিম ঘুরিয়ে পাল্লা দিতামÑ কারটা কতক্ষণ বেশি ঘুরতে পারে। কে প্রথম, কে দ্বিতীয়, এবং কে তৃতীয় হয়। আর এ খেলার আসর বসতো প্রায়ই তছলুদের দালানবাড়ির দক্ষিণ বারান্দায়। কারণ, অন্য কোথায়ও অতটা সুন্দর, মসৃণ শান-বাঁধানো মেঝে ছিল না।
আমি, চুনচালে, নবীর (সম্পর্কে আমার চাচাতো ভাই) আর চিনিখালা একদিন সকালবেলায় লাটিম ঘুরানোর পাল্লা দিচ্ছিলাম। তছলুর বাপ (জনাব জালাল উদ্দিন আহমেদ) দালানবাড়ির ভিতরে তাঁর ঘরেই ছিলেন। কি নিয়ে যেনো নবীর আর চিনি খালার মধ্যে একটু বচসা হয়েছিল। সম্ভবত চিনি খালার লাটিমটার ঘোরা শেষ হবার আগেই নবীর হাত দিয়ে সেটা থামিয়ে দিয়েছিল।
এ নিয়ে দু’জনের কেউ কাউকেই আর লাটিম ঘোরাতে দিচ্ছিল না। এমন সময় চিনি খালা কাঁদতে কাঁদতে গিয়ে পাগল বাপকে বললো-
বাপজান! দেখেন তো, আমাকে লাটিম খেলতে দিচ্ছে না।
বেয়াই সাহেব (তছলুর বাবা) একলাফে ঘরের ভেতর থেকে বারান্দায় বেরিয়ে এসেই চিৎকার দিয়ে বললেন কে দিচ্ছে না? কোন হারামজাদার বাচ্চা তোরে খেলতে দেয় না রে?
চিনি খালা উত্তরে বললো- এই তো বাপজান নবীর। নবীর আমারে খেলতে দিচ্ছে না।
এ কথা বলা মাত্রই আর যায় কোথায়? নবীরকে মারলেন কষে এক থাপ্পড়! তারপর বললেনÑ ফের যদি ওরে খেলতে না দিস, তোরে দু’হাতে উঠায়ে আছাড় দিয়ে মারে (মেরে) ফেলাবো। জানিস তো আমি কে?
ঘটনার আকস্মিকতায় আমরা সবাই চুপ! আর ওদিকে নবীর ভয়ে এক চড় খেয়েই পরনের প্যান্টটা ভিজিয়ে একশেষ। আমরা খেলা ছেড়ে যে যার বাড়ির দিকে দে ছুট। একজন পাগলেরও যে আত্মজার প্রতি এতটা বাৎসল্য ও মমতাবোধ থাকতে পারে, তা আমরা কেউই সেদিন ভাবতে পারিনি!